প্রান্তিক মৎস্যজীবী যাতে প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলোতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সে দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন।
পড়ন্ত মাঝারি বয়সের হারাধন ছোট্ট ডোঙা নিয়ে মাছ ধরছিলেন আধমরা বিলের মধ্যে। এই বিলটা তেহট্ট ১ নম্বর ব্লকের কানাইনগর পঞ্চায়েতে। ডোঙাটা নিয়ে পাড়ের কাছে আসতে আলাপ জমানো গেল। কথায় কথায় প্রশ্ন করলাম, আচ্ছা, এই বিলটার নাম কী? একটু থেমে তিনি উত্তর দিলেন, “সবাই তো বিল বলেই জানে। তবে বিলটার নাম আছে শুনেছি। আমার আব্বা জানে।” পরে ওই অঞ্চলের বছর পঁয়ষট্টি-র প্রাক্তন উপপ্রধান বলেছিলেন, জলাভূমিটার নাম শরডাঙা বিল।
কিন্তু এক প্রজন্মের মধ্যে কী করে হারিয়ে যাচ্ছে ঘরের পাশের জলাশয়ের নাম? গল্প করতে করতে জানা গেল, আব্বা চার ভাইবোনের সংসার টেনেছেন শুধুমাত্র বিলের মাছ ধরে। ‘মেলা মাছ’ জালে উঠত। নিজেই সেই মাছ বাজারে বিক্রি করতেন। বর্ষার জল নদীতে মিশলে নদী ফুলেফেঁপে ওঠে। তার পর সেই জল খালের পথ দিয়ে ঢুকে পড়ে বিলে। এই সময় বর্ষার নতুন জলের সঙ্গে মাছের ডিম, মাছের চারা ভেসে আসত। ডিম ফুটে বাচ্চা হত। ছোট মাছ আকারে বড় হত। এরাই ধরা পড়ত জালে।
এই ভাবেই স্থানীয় মৎস্যজীবীরা এজমালি জলাভূমির উপর নির্ভর করতেন। তাঁদের যাপনটাই ছিল জলাভূমি-কেন্দ্রিক। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে জলাভূমির উপর অত্যাচার বাড়তে আরম্ভ করল। জালটা গুটোতে গুটোতে হারাধন জেলে বলেই ফেললেন, বামফ্রন্ট শাসনের শেষের দশ বছর নদী, খাল, বিলের জমি দখলের মচ্ছব হয়েছে। যে বিলের আকার দেড়শো বিঘের উপর ছিল, লুট হতে হতে তা একশো বিঘেতে এসে ঠেকেছে। একের পর এক জলাজমিতে পাট্টা পড়েছে। রাতারাতি জমির চরিত্র বদল হয়েছে। লুট হয়ে গিয়েছে নদীর সঙ্গে বিলের জুড়ে থাকা খালটা।
খালটার পথ জুড়ে আজ চাষের জমি। নদীর জল না আসায় বিলে মাছ কমে গেল এক ধাক্কায় অনেক গুণ। পেটের জ্বালা মেটাতে মাছ ধরার বিকল্প খোঁজা শুরু। কাজের সুযোগ নেই এই রাজ্যে। তাই হারাধনকে এই রাজ্য ছেড়ে যেতে হয়েছিল চেন্নাইতে, নির্মাণশিল্পে কাজ করতে। গ্রামের মানুষদের ভাষায়, ‘দক্ষিণে যাওয়া’। লকডাউন না হলে তিনি হয়তো বাড়িও ফিরতেন না। যে দিন থেকে নদী, খাল, বিলগুলোর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করেছে, সেই দিন থেকেই জলাভূমিগুলো মরতে বসল। জীবন-জীবিকার সঙ্গে জুড়ে থাকা খাল বিল জলাভূমি এক সময় স্থানীয় মানুষেরাই দেখভাল করতেন। কারণ এই সব জলাশয়, জলাভূমি তাঁদের দৈনন্দিন কাজে লাগত। যত মানুষের দৈনন্দিন জীবনে জলাভূমির উপর নির্ভরতা কমল, ততই খাল, বিল, জলাভূমির নামগুলোও মন থেকে হারিয়ে গেল ধীরে ধীরে।
বদলে যাচ্ছে মূল্যবোধও। আজ যাঁদের বয়স পঞ্চান্ন বা ষাটের কোঠায়, তাঁরা ভাবতেই পারেন না, নদীর জলে বিষ মিশিয়ে নদীতে মাছ ধরবেন। সারা দিনে যদি মাছ না-ও মেলে, তবু নদীকে দূষিত করা চলে না। কিন্তু আজকের প্রজন্মের মৎস্যজীবীদের অনেকেরই মূল লক্ষ্য হল কত কম সময়ে, কত বেশি মাছ ধরা যায়। তাতে নদীর কী হবে, পরের প্রজন্মের জীবিকার কী হবে, ভাবার সময় তাঁদের নেই।
নদী, খাল, বিলের উপর নির্ভরশীল মৎস্যজীবীরা সরকারের কাছেও উপেক্ষিত। কারণ, সরকার পুকুরে মাছ চাষের প্রচার বেশি করছে। এক জন মৎস্যজীবী ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে চাইলে প্রথমেই তাঁর কাছে পুকুর তৈরি করার জমি দেখতে চাওয়া হচ্ছে। নিম্নবিত্ত মৎস্যজীবীর তো তা নেই। সেই ফাঁক দিয়ে মাছ চাষের জগতে পুঁজিপতিরা ঢুকে পড়ছে। পছন্দের জমি, উন্নত প্রযুক্তি, ব্যাঙ্ক ঋণ ইত্যাদি সবই তাঁদের হাতের নাগালে। কাজেই বেঁচে থাকার লড়াইটা হচ্ছে অসম। আর মাছ চাষের সমবায়গুলি দলীয় রাজনীতির আখড়া। সেখানে কোন মৎস্যজীবী সদস্য হবেন, তা ঠিক করে স্থানীয় পার্টি অফিস। যাঁরা বংশপরম্পরায় মাছ ধরেন, তাঁদের হয়তো মৎস্যজীবী পরিচয়পত্র আছে। তা সত্ত্বেও বহু ক্ষেত্রে ছোটখাটো অনেক সুযোগসুবিধা, যেমন বরফের বাক্স, মাছ ধরার হাঁড়ি, মৎস্যজীবী পেনশন ইত্যাদি থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। তাঁদের বেশির ভাগের একটা মাছ ধরার নৌকা আর জাল কিনতেই বড় বেগ পেতে হচ্ছে।
আজ ফিরে তাকানো দরকার সেই সমস্ত নদী-খাল, বিল, জলাভূমির দিকে, যা সরকারি সম্পদ আর সর্বসাধারণের সম্বল। এগুলি কোনও ব্যক্তির মালিকানাধীন নয়, প্রাকৃতিক সম্পদ। সেগুলিকেই আজ মাছ চাষ কিংবা মাছের সংরক্ষণের জন্য কাজে লাগানো যেতে পারে। সব মৎস্যজীবী যে মোটা অর্থ লগ্নি করে মাছ চাষ করতে পারবেন, এমনটা নয়। সেই সব প্রান্তিক মৎস্যজীবী যাতে প্রাকৃতিক জলাভূমিগুলোতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতে পারেন, সে দিকে লক্ষ রাখা প্রয়োজন। খেয়াল রাখা দরকার, প্রান্তিক মৎস্যজীবীরা যেন বেঁচে থাকার ন্যায্য অধিকার থেকে কোনও ভাবেই বঞ্চিত না হন। আর নদী, খাল, বিলের মৎস্যসম্পদও যেন নিঃশেষ হয়ে না যায়। স্নানের পর আঁচলে ছেঁকে ছোট মাছ যেন ধরা যায় এই সুজলা বাংলায়।