ধরুন, পর পর অনেকগুলো ব্যাঙ্কে চুরি হয়েছে। পুলিশ তলব করল সিসিটিভির ছবি। দেখা গেল, প্রথম ব্যাঙ্কের ক্যামেরা অচল। পরেরটায় ছবি মুছে গিয়েছে। তিন নম্বরে ক্যামেরা বসানোই হয়নি। তখন সন্দেহ হয়, এ কি কেবল চুরি? কাটমানি নিয়ে গ্রামে গ্রামে যে শোরগোল বেধেছে, তাতেও খটকা এখানেই। কিছু লোককে চেপে ধরে কিছু টাকা না হয় আদায় হল। কিন্তু চুরি ধরার যে ব্যবস্থা, তার কী হল?
চুরি ধরার চিরকেলে উপায় হিসেব পরীক্ষা। গ্রাম পঞ্চায়েতের হিসেব দেখেন ব্লকের ‘পঞ্চায়েত অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অফিসার’। খবর নিয়ে জানা গেল, ৩৪২টি ব্লকের দেড়শোটিতে অডিটর নেই। যাঁরা আছেন, তাঁরাও অন্য কাজে ব্যস্ত। পঞ্চায়েত দফতরের অফিসার থেকে জেলাশাসক, কারও মনে পড়ে না শেষ কবে অভ্যন্তরীণ অডিট রিপোর্ট দেখেছেন। ‘‘বরং গণস্বাক্ষর-করা দু’একটা অভিযোগ আসে’’, বললেন পঞ্চায়েত কমিশনারেট-এর এক আধিকারিক। একান্তে জেলার কর্তা থেকে কলকাতার কর্তা, সকলেই স্বীকার
করেন যে পঞ্চায়েতের অভ্যন্তরীণ অডিট ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে।
তবে তাঁদের যুক্তি, বাইরের অডিট তো হচ্ছেই। কেন্দ্রীয় অডিট সংস্থা ‘ক্যাগ’-এর অধীন ‘এগ্জ়ামিনার অব লোকাল অ্যাকাউন্টস’ (ইএলএ) অডিট করে পঞ্চায়েতের। এ বছর জুলাইতে তারা যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা ২০১৫-১৬ সালের। তার হিসেব ২০১৩-১৪’র। অথচ পঞ্চায়েত আইন বলছে, ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আগের আর্থিক বছরের অডিট হওয়া চাই। দফতর সূত্রে খবর, ২০০৬ সালে ইএলএ অডিট শুরু করে। প্রথম দু’তিন বছর সময়মতো অডিট হয়েছিল। এখন রিপোর্ট মিলছে পাঁচ বছর পরে। তত দিনে পঞ্চায়েতের সদস্যরা বদলে গিয়েছেন।
আর হয় কেন্দ্রের ‘পারফর্ম্যান্স অডিট’। এ বছর দু’টি জেলায় একশো দিনের কাজের পরিদর্শন করেছিল কেন্দ্রীয় দল। বেশ কিছু প্রকল্পে ‘খরচ করা’ টাকা পুনরুদ্ধার করতে বলেছে রাজ্যকে। যেমন, হুগলির ধনেখালিতে ঘিয়া নদীর পলি তুলতে তিন দফায় তিন কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। সবটাই ভুয়ো। কেন্দ্রের অডিট-কর্মীরা এ বছরের গোড়াতেই রাজ্যকে সতর্ক করেছিল, আবাস যোজনায় কাটমানি নেওয়া হচ্ছে। তবে এ হল নমুনা সমীক্ষা, তা-ও চার বছরে এক বার হয়। প্রতি বছর যে সার্বিক অডিটের ভিত্তিতে এ রাজ্যে একশো দিনের কাজের প্রকল্পের পরবর্তী অনুদান আসে, তা করে এক বেসরকারি অডিট সংস্থা। কিন্তু তারা কেবল খাতাপত্র পরীক্ষা করে। গ্রামে গিয়ে মিলিয়ে দেখে না, কী হয়েছে, কী হয়নি। সেটা তাদের কাজ নয়।
এতগুলো ক্যামেরা অচল করছে কে? স্রেফ ক’টা গ্রামের নেতা? কী ঘটছে, বোঝা যায় একশো দিনের কাজের ‘সোশ্যাল অডিট’-এর দিকে চাইলে। আইন বলছে, তার জন্য গ্রামসম্পদ কর্মী (ভিলেজ রিসোর্স পার্সনস, বা ভিআরপি) নিয়োগ হবে, প্রশিক্ষণ হবে। তাঁরা গ্রামবাসীকে প্রশ্ন করবেন, কী কী কাজ হয়েছে, তা থেকে লাভ হল কি না। তা পড়া হবে গ্রাম সংসদ সভায়। গ্রামবাসীও মত জানাবেন। সেই রিপোর্ট নিয়ে জনশুনানি করবেন বিডিও, ডিএম, বৈঠক হবে রাজ্য স্তরে। রিপোর্ট যাবে রাজ্যে, কেন্দ্রে। দুধ কা দুধ, পানি কা পানি হয়ে যাবে।
নিয়ম মেনে কাজ হত না বলে ২০১৫ সালে কেন্দ্র নির্দেশ দেয়, সোশ্যাল অডিট করবে এক স্বতন্ত্র সমিতি, তাকে পৃথক অ্যাকাউন্টে বরাদ্দ (প্রকল্পের বরাদ্দের ০.৫ শতাংশ) দিতে হবে।
রাজ্য সরকার স্বতন্ত্র সমিতি তৈরি করতে দেয়নি দীর্ঘ দিন। যৎসামান্য অনুদান দিত, এখন কেন্দ্র সরাসরি টাকা দেয়। বিধি নস্যাৎ করে কর্মরত সরকারি আধিকারিককে সোশ্যাল অডিট
শাখার দায়িত্ব দিচ্ছে রাজ্য। উঁচু স্তরে এ ভাবে অকেজো করা হচ্ছে ক্যামেরা।
আর গ্রামে? দুটো গল্পই যথেষ্ট। একটি দক্ষিণ ২৪ পরগনার। এক প্রধানের কাছে গ্রামবাসীর অভিযোগের তালিকা নিয়ে গিয়েছেন দশ-বারো জন ভিআরপি। প্রধান বললেন, ও সব ছাড়ো, আমি যা বলছি, তাই লেখো। আপত্তি করতে টেবিলে রাখলেন দু’টি প্যাকেট। একটিতে টাকার তাড়া। অন্যটিতে কাগজে মোড়া একটি ছুরি। ‘‘বেছে নাও।’’
অন্য গল্পটা বাঁকুড়ার। সেখানে এক গ্রামসভায় এক ভিআরপি রিপোর্ট পড়লেন, অমুক জায়গায় বনসৃজন প্রকল্পে এতগুলো গাছ লাগানো হয়েছে। কিন্তু গ্রামবাসী বলেছেন, কোনও গাছ নেই। গ্রামবাসীদের নামও তিনি পড়ে শোনান। প্রধান উঠে বলেন, ‘‘আপনি বিরোধী দলের লোক, শান্তিভঙ্গ করতে এসেছেন।’’ তাঁর চেলাদের হাতে যথাবিধি হেনস্থার পর সারা রাত ঘরে আটকে রাখা হয় ওই কর্মীকে। স্বয়ং জেলাশাসক তাঁকে বরখাস্ত করার সুপারিশ করেন। গাছগুলো সত্যি লাগানো হয়েছিল কি না, তা নিয়ে কিন্তু কোনও তদন্ত হয়নি। তবু মরচে-পড়া বন্দুক দেখেও প্রাণ কাঁপে কারও কারও। তাই এ বার নির্বাচনের পর সোশ্যাল অডিট শোনানোর গ্রামসভা ‘সাময়িক ভাবে’ বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য।
এ ছাড়াও, বছরে দু’বার গ্রামবাসীদের নিয়ে পঞ্চায়েতের সভা করার কথা প্রতি সংসদে। সেখানে সব আয়-ব্যয়ের হিসেব এবং অডিট রিপোর্ট পেশ করতে হবে, বলছে আইন। ‘প্রশাসনিক জনসভা’ বলে যদি কিছু থাকে, তবে তা গ্রাম সংসদের সভা, সংবিধান যাকে মান্যতা দিয়েছে। বীরভূমের এক পঞ্চায়েত কর্মী বললেন, ‘‘২০১১ সালের পর থেকে ৯৮ শতাংশ গ্রাম সংসদ সভা হয় না।’’ সব জেলায় এই ছবি। গ্রামসভা বন্ধ করে ‘দিদিকে বলো’ চালু, নাকের বদলে নরুন।
আর আছে তৃণমূলের বিরোধী-বর্জনের বাতিক। বাম পঞ্চায়েতও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে উঠেছিল, কিন্তু পঞ্চায়েতকে ‘গণতান্ত্রিক’ করতে বিরোধীদের জায়গা তৈরি করেছিল সরকার। যেমন বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির আদলে তৈরি হয়েছিল জেলা কাউন্সিল, যার শীর্ষে থাকতেন জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা। তিনি পঞ্চায়েত পরিদর্শনের গাড়ি পেতেন, শাস্তির সুপারিশ করতে পারতেন। ২০১৩ সালের পর জেলা কাউন্সিল আর তৈরি হয়নি।
সিপিএমের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল ‘ক্লায়েন্টেলিজ়ম’— সরকারি টাকায় সমর্থন কেনা। সেই দলতন্ত্র গিয়ে এখন ঠিকাদার-তন্ত্র। লক্ষ্য বাঁধা ভোটার নয়, বাঁধা বখরা। ভোট পাওয়ার নির্যাস, টেন্ডার পাওয়া। গোসাবার এক প্রবীণ পঞ্চায়েত কর্মীর আন্দাজ, ‘‘মাল-মজুরি মিলিয়ে একশো দিনের কাজের প্রকল্পে ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ শতাংশ মার যায়। কোথাও সেটাই আশি-একশো শতাংশ হয়ে যায়।’’ এক পঞ্চায়েত সচিব বললেন, ডিজিটাল স্বাক্ষরের যন্ত্রটা অবধি তাঁর কাছে থাকে না, থাকে নেতার কাছে। ‘‘আগে সই করতে না চাইলে সিনিয়র অফিসাররা সাপোর্ট করতেন। এখন বলেন, মানিয়ে নাও।’’ সমান্তরাল ভাবে চলছে আড়তদার-তন্ত্র। সরকারি মূল্যে ধান কেনায় বিপুল দুর্নীতি।
এ কি শুধু ক’জন নেতার কীর্তি? এক জন লোক যে কয়েকশো লোকের সই-করা ‘উইথড্রয়াল স্লিপ’ দিয়ে নিয়মিত টাকা তুলছে, ব্যাঙ্ককর্মীরা বোঝেন না? বিডিও-ডিএম বোঝেন না, প্রতি পঞ্চায়েতে মাসে পঞ্চাশটা কর্মদিবস তৈরি অসম্ভব? কিংবা, যত ধান কেনা দেখানো হচ্ছে, গুদাম অডিট করলে অত মিলবে না?
ভয় এখানেই। চোর-নেতা যদি সরেও যায়, চুরির এমন রেডিমেড ব্যবস্থাটি সরবে না। স্রেফ হস্তান্তর হবে পরবর্তী নেতার হাতে। কখনও জানা যাবে না, কত টাকা নষ্ট হয়েছে, কত মুখ বন্ধ রয়েছে। তাই সাত হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে একশো দিনের কাজে, কিংবা ছ’হাজার কোটি টাকার ধান কেনা হয়েছে শুনলে ভরসা হয় না, ভয় হয়।
চুরি গিয়েও অত টাকা যদি গ্রামে থাকত, তা হলে আজ গ্রামীণ অর্থনীতি অন্য রকম হত। ও টাকা গ্রাম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে। কী রূপ ধরে আবার ফিরবে গ্রামে? কোন বস্তুর জোগান হয়ে, কোন কাজের মজুরি হয়ে? গত পঞ্চায়েত নির্বাচন তা দেখিয়ে দিয়েছে।
গণতন্ত্রে উন্নয়নের জন্য নির্বাচন হওয়ার কথা। হয়ে দাঁড়িয়েছে, উন্নয়ন বনাম নির্বাচন। নির্বাচন করতে হয় বলেই উন্নয়ন করা যায় না। এই রাজনীতির অডিট দরকার।