যে চার জনের ফাঁসি হল, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া চলেছিল সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে। এই সময়কালে কয়েদখানায় নানান নাটক হয়েছে। আইনের ফাঁক দিয়ে ওদের বাঁচানোর হরেক প্রক্রিয়া দেখেছি আমরা। অবশেষে নির্ভয়ার খুনি-ধর্ষকদের সাজা হল। সবাই তৃপ্ত। দেশ তৃপ্ত।
মৃত্যুও কখনও তৃপ্তি আনে তা হলে! এই ‘তৃপ্তি’টাই যদি সভ্য দেশের ‘থিম সং’ হয়, তা হলে মেয়েরা এ বার নির্ভয়ে রাতবিরেতে বাড়ি ফিরবে। নির্ভয়ে ট্রেনে-বাসে উঠবে। নির্ভয়ে বাড়ি ফিরে পরম তৃপ্তিতে নিজের স্বামীর পাশে শোবে। পরিবারে মর্যাদা পাবে।
এ দেশের বেশির ভাগ বিবাহিত মেয়েরা সবচেয়ে বেশি ধর্ষিত, লাঞ্ছিত হয় নিজের স্বামীর কাছেই। এই দেশের বেশির ভাগ পুরুষ আজও ‘দাম্পত্য ধর্ষণ’ কী, জানে না, মানেও না। আরে বাবা, ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করেছি, আমার স্ত্রীর শরীরটা নিয়ে যা খুশি করার হক আমার আছে। বিয়ে করা বউ তো আমার সন্তান উৎপাদন আর বিনোদনের যন্ত্র! অতএব, মেয়েদের কাছ থেকে ‘না’ শুনতে প্রস্তুত নয় পুরুষ।
আজ যাঁরা নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসিতে লটকাতে দেখে তৃপ্ত, ধরে নেব, তাঁরা নিজের স্ত্রীর ‘না’টুকুকে নিশ্চয়ই সম্মান জানান। হয়তো জানান... না হলে এই ‘তৃপ্তি’র তো কোনও মানে হয় না। কী আশ্চর্য! যে পুরুষ মহিলাদের ‘মেয়েছেলে’ বলে ও সারা ক্ষণ অবজ্ঞা করে, তারাও কিনা আজ বলছে: বেশ হয়েছে ফাঁসি হয়েছে!
ঘটনা হল, সমাজে ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়ে যাওয়ার পেছনে একটা বড় কারণ: মেয়েরা পুরুষদের হাতের বাইরে বেরিয়ে গিয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী পুরুষ মেয়েদেরকে হাতের পুতুল করে রেখেছিল, কিন্তু নারী আর পুতুলখেলায় অংশ নিতে চায় না।
যে ক্ষেত্রগুলোয় যুগে যুগে পুরুষেরাই একা, একক ভাবে রাজত্ব করত, এখন মেয়েরা সে সব জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
মেয়েদের যোগ্যতার কাছে ক্রমাগত কোণঠাসা পুরুষ তার শরীর নিয়ে, পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করছে। যখন কোনও পুরুষ মহিলার পোশাক নিয়ে টিটকিরি দেয়, কোনও কর্মরত মহিলার শরীর নিয়ে যৌন ইঙ্গিত করে, বুঝতে হবে সেটা সেই পুরুষটির ক্রমাগত মেয়েদের দুনিয়ায় হেরে যাওয়ার হতাশা।
বিবাহিত পুরুষেরাই যখন স্ত্রীর সাফল্য উপভোগ করতে শেখেনি, শুধু মেয়েদের দাবিয়ে রাখার মন্ত্র শিখেছে, সেই দুনিয়ায় নির্ভয়ারা কী করে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরবে?
নির্ভয়া বিজয়িনী। যাদের ফাঁসি হল, তারা পরাজিত পুরুষের প্রতিনিধি। আশা করা যায়, এদের ফাঁসিকাঠে ঝুলতে দেখে তৃপ্ত সমাজ এ বার সসম্মানে জয়ী হওয়ার কথা ভাববে।
সুদীপ বসু
কলকাতা-১১৮
সমাজের ভূমিকা
‘‘মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আপনাদের মতামত কী? জন্মগত অপরাধী বলে কি কিছু হয়?’’ ‘ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব মেন্টাল হেলথ অ্যান্ড নিউরোসায়েন্স’ (‘নিমহানস’)-এর বরিষ্ঠ অধ্যাপক, শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডক্টর শেখর শেষাদ্রি এই প্রশ্ন উত্থাপন করে, ‘চিলড্রেনস ইন কনফ্লিক্ট উইথ ল’ শীর্ষক তিন দিনের কর্মশালার মূল সুরটা বেঁধে দিয়েছিলেন।
হঠাৎ আসা প্রশ্নে হতচকিত না হয়ে প্রথম সারিতে বসা এক জন অংশগ্রাহক উত্তরে বলেন, ‘‘আমি মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। কারণ মৃত্যুদণ্ডে অপরাধীকে মেরে ফেলা যায়, অপরাধকে নয়। তাকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া উচিত।’’
কমবয়সি আর এক জন স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যোগ করেন, ‘‘কোনও মানুষ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। সমাজই অপরাধী তৈরি করে। এক জন মানুষের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে আর্থ-সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’
ডাক্তার শেষাদ্রি জানতে চান, ‘জেনেটিক মেকআপ’-ই ক্রিমিনাল হওয়ার জন্য দায়ী, এ রকম ভাবনা কারা কারা পোষণ করেন? কর্মশালায় উপস্থিত ৫০ জনের মধ্যে প্রায় সবাই জোরের সঙ্গে বলেন, কেউ না।
শেষাদ্রি বললেন, ‘‘ঠিক এই কারণেই আমি মনে করি মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার কোনও অধিকার রাষ্ট্রের নেই। কারণ এক জন মানুষের অপরাধী হয়ে ওঠার পেছনে সামাজিক, পারিপার্শ্বিক প্রেক্ষিতটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।’’
এ প্রসঙ্গে তিনি নির্ভয়া কাণ্ডে এক অভিযুক্তের প্রসঙ্গ তোলেন। বাড়ি থেকে সে অনেক দূরে দিল্লিতে থাকতে বাধ্য হয়েছিল। মাত্র ১০-১১ বছর বয়সে সে কাজের সন্ধানে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসে। সাত জনের পরিবার, বাবা মানসিক রোগী। বোন দৈনিক পঞ্চাশ টাকা রোজে দিনমজুরের কাজ করত। শহরে আসার পর শেষ ছ’সাত বছর মায়ের সঙ্গে তার দু-তিন বারের বেশি দেখা হয়নি। সে আর পাঁচটা লেখাপড়া না জানা গরিব ছেলের মতোই গাড়ি ধোওয়া, বাসন মাজা, ধাবা-সহকারীর কাজ করত।
এই সমস্ত কঠিন এবং অমানবিক পরিস্থিতি তাকে জঘন্যতম অপরাধী হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেনি, এ কথা কি আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি?
ডক্টর শিলা রামস্বামী, ‘চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস মেন্টাল হেলথ সার্ভিস প্রজেক্ট’-এর সমন্বয়কারী, বলেন বাচ্চা বা কিশোরদের আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার পেছনে একটা নির্দিষ্ট সরণি থাকে। অপরাধ একটা আচরণ। আচরণটা আমরা দেখতে পাই। তা নিয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু আচরণের প্রেক্ষিতটা, আঁধার গলিপথটা আলোচনায় আসা জরুরি।
আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া, ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পর্যবেক্ষণ হোমে থাকা একাধিক বাচ্চার গভীর সান্নিধ্যে এসে এবং পারিবারিক ও সামাজিক তথ্য অনুসন্ধান করে ‘নিমহানস’-এর গবেষকরা এই সত্যে উপনীত হয়েছেন বলে রামস্বামী জানান।
তাঁরা এটাও পর্যবেক্ষণ করেছেন, সবাই যে আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছে না, তার অন্যতম কারণ হল আর্থ-সামাজিক শ্রেণিবৈষম্য।
উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের অভিভাবক পুলিশকে উপঢৌকন দিয়ে, কখনও বা স্কুলের উপর প্রভাব খাটিয়ে, আইনের হাত থেকে সন্তানকে বাঁচিয়ে আনছেন। সেই ক্ষমতা যাঁদের নেই, তাঁদের ঘরের বাচ্চারা আইনের চোখে অপরাধী হয়ে পর্যবেক্ষণ হোমে দিন কাটাচ্ছে। সমাজও তাদের গায়ে সমাজবিরোধীর তকমা সেঁটে তির্যক চোখে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে।
বোধ হয় এই কারণেই আগের শতকের পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে ভারতে বিশেষ করে বাচ্চা এবং কিশোর অপরাধীদের জন্য যে আইন প্রণীত হয়েছিল, তা চরিত্রগত ভাবে অনেকটাই ছিল সংস্কারসাধক (Reformative) এবং রূপান্তরধর্মী (Transformative)। আইন প্রণেতারা কিশোর অপরাধীদের সামাজিক পুর্নবাসনের দিকটি সহৃদয়তার সঙ্গে বিবেচনা করেছিলেন।
এখন আইন পুরোপুরি শাস্তিমূলক। বর্তমান ভারতরাষ্ট্র বিশ্বাস করে, অপরাধের একমাত্র প্রতিবিধান শাস্তি। কঠিনতম শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারলেই অপরাধ নির্মূল হবে। হয়তো এই কারণেই নির্ভয়া কাণ্ডের পর, কিছুটা মিডিয়ার চাপে, কঠোর শাস্তিযোগ্য তরুণদের ন্যূনতম বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৪ করা হয়েছে।
তবে আইনের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া বাচ্চা বা তরুণদের জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার অনেক বিকল্প রয়েছে। তাদের সেই জীবনীশক্তিও আছে। জীবনসংগ্রামে দক্ষ করে তোলার উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, যত্ন ও নিরাপত্তা; যা জুভেনাইল জাস্টিস আ্যক্টে বলা আছে— তা যদি দেওয়া হয়, একটা বাচ্চা বা কিশোরের জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসার সম্ভাবনা খুব বেশি।
কিন্তু পরিতাপের বিযয়, পরিকাঠামোহীন দেশের পর্যবেক্ষণ হোমগুলো ডিটেনশন ক্যাম্প ছাড়া আর কিছুই নয়। ফলে সেই একই দুঃখজনক ব্যাপার দাঁড়ায়। অপরাধের রূপান্তর হয়, অপরাধীর নয়। প্রকৃত বিচারের বাণী নীরবে কাঁদতে থাকে।
কমল কুমার দাস
কলকাতা-৭৮
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।