দেশের সাধারণ নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশিত সম্পাদকীয় প্রতিবেদন ‘স্থিতাবস্থার রাজ্য’ (৬-৬) সঠিক মূল্যায়ন। বিভাজন ও ধর্মীয় মেরুকরণের পরাজয় ঘটেছে, জিত হয়েছে রাজ্যের অসংখ্য জনবাদী প্রকল্প ও কর্মসূচির। এতে সর্বস্তরের মানুষের কাছে সরাসরি কিছু সরকারি অর্থ ও সুযোগসুবিধা পৌঁছেছে। ফলে বিজেপি-বিরোধী রাজনৈতিক পরিসরটি নিজেদের দখলে রাখতে সফল হয়েছে রাজ্যের শাসক দল। রাজ্য প্রকল্পগুলোর সুযোগ যেমন মানুষ পেয়েছে হাতেনাতে, তেমনই এই প্রকল্পের আড়ালে শাসক দলকে তারা সমর্থন জুগিয়েছে অনুগত থেকে। রাজ্যে যেমন বিজেপির গ্রহণযোগ্যতা ইতিবাচক ছিল না, তেমনই তারা ধাক্কা খেয়েছে সর্বভারতীয় স্তরেও। গত লোকসভা নির্বাচনের মতো কিন্তু এ বার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। নিশীথ প্রামাণিক, সুভাষ সরকার, লকেট চট্টোপাধ্যায়, তাপস রায়, অর্জুন সিংহের মতো প্রার্থীরা সুবিধা করতে পারেননি এ বারের ভোটে। না হলে গত লোকসভার ১৮টি আসন কমে ১২-তে দাঁড়ায় না। শতকরা হিসাবে প্রাপ্ত ভোটের অঙ্ক বিজেপির কমলেও (৩৮.৭৩ শতাংশ) রাজ্যের শাসক দলের অঙ্ক গত বারের তুলনায় দুই শতাংশের বেশি বেড়ে ৪৫.৭৬ শতাংশ হয়েছে। রাজনৈতিক মহলের ব্যাখ্যা, অনুদানের রাজনীতি দুর্নীতির অভিযোগকে ঢেকে দিয়েছে। তবে, রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ কোনও স্তরেই কাম্য নয় আর কেন্দ্র সেই প্রবণতা হারিয়েছে ইন্ডিয়া জোটের অভাবনীয় সাফল্যে। রাজ্যে জনমুখী প্রকল্পের লাভ ঘরে তুললেও আগামী দিনে আধিপত্যবাদ যাতে এখানেও প্রকট না হয়ে ওঠে, তা দেখার দায়িত্ব শাসক দলেরই। গণতন্ত্রের রক্ষক হতে গেলে সে পথ থেকে সরলে চলবে না।
সৌম্যেন্দ্র নাথ জানা, কলকাতা-১৫৪
বিস্মৃত বাম দল
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে যে বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলার জনগণ, এ-বারের লোকসভা ভোটেও সেই একই বুদ্ধিমত্তার ছাপ রাখল তারা। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপির ধর্মের রাজনীতি আগেই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। এ ছাড়াও, অপর দুই বিরোধী দল সিপিএম এবং কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। অথচ, বাংলার রাজনীতি-সচেতন মানুষের একাংশ কিন্তু সেই পুরনো লড়াকু বামেদের উপর আস্থা রাখতে চায় আজও, যারা এক সময় নিম্নবিত্ত ও গরিব জনগণের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল। এমনকি তারা শহুরে মধ্যবিত্তদেরও শ্রদ্ধা অর্জনে সমর্থ হয়েছিল সহজে। বর্তমানে সেই বামেদেরই একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল ভাল-মন্দ সব ক্ষেত্রে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্ধ বিরোধিতা। বামেদের বড়-মেজে-ছোট কমরেডরা কেউই ভাবতে রাজি নন যে, রাজ্যের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক দলটি কিছু মৌলিক কর্মসূচি গ্রহণ করতেও সচেষ্ট এবং সেগুলির ধারাবাহিক সাফল্যও তারা বজায় রেখে চলেছে। ফলে শত দুর্নীতির মাঝেও রাজ্যবাসীর সমর্থন আজও তাদের পক্ষে।
সবচেয়ে আশ্চর্য যে, ৩৪ বছর ক্ষমতায় টিকে থাকা বামেরা রাজ্যের মানুষের মনের পাঠটাই যেখানে বুঝে উঠতে অপারগ, সেখানে তারা কেমন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন নীতি-আদর্শবাদী দল? কোথায় গেল তাদের শ্রেণিসংগ্রাম? রাজ্যের শাসকের অজস্র অসঙ্গতি তথা অপকর্ম সত্ত্বেও বামেদের সেই প্রতিবাদ আন্দোলনের কর্মসূচিগুলো কি আজ বানপ্রস্থে গিয়েছে? কয়েক বছর আগের মহারাষ্ট্রে কৃষক আন্দোলনের সেই ছবিটাও বঙ্গীয় বামেদের কি উজ্জীবিত করে না একটুও? এ ছাড়া কেন্দ্রের কর্পোরেট সরকারের হাজার বৈষম্য চলতে দেখেও ‘সিপিএম’-এর কমরেডরা আলিমুদ্দিনের কক্ষের ভিতরে বসে বাইরের জগৎটাকে চিনছেন কী ভাবে?
আগামী দিনগুলো স্বস্তিকর হয়ে উঠবে, এমনটা ভেবে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। এই জয়ে রাজ্যের শাসকের অহমিকা বাড়বে বই কমবে না। অন্য দিকে, আমাদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে দাঁড়াতে হতে পারে কেন্দ্রের আগ্রাসী রূপের কারণে। সেই সময়ে বামেরাই পুনরায় এগিয়ে আসতে পারে জনগণের বন্ধু হয়ে। অবশ্য এ জন্য বামেদের শুদ্ধিকরণ প্রয়োজন। কী ভাবে? এক, পরিষদীয় রাজনীতি থেকে আপাতত দূরে থেকে মানুষের আস্থা অর্জনের দিকে মন দিক বামেরা। দুই, যে কোনও দক্ষিণপন্থী দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য কোনও বামদলেরই সুস্থ রাজনীতি হতে পারে না। তিন, জনগণের দুয়ারে পৌঁছে তাদেরই চাহিদা অনুযায়ী কাজের অধিকার, ক্ষুধা-দারিদ্রমুক্তি এবং শিক্ষার দাবিকে অগ্রাধিকার দিক বামেরা। চার, শুধুমাত্র তৃণমূল নেত্রীর বিরোধিতা ছেড়ে কোন সর্বগ্রাসী গণতন্ত্র হরণকারী ফ্যাসিস্ট শক্তি সর্বাপেক্ষা বিপজ্জনক, সেই বিচার জরুরি হয়ে উঠুক। পাঁচ, সিপিএম সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন তোলা বা পরামর্শ প্রদান মানেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাওবাদী বা তৃণমূলপন্থী, এই ধারণা অবশ্যই বর্জনীয়। পরিশেষে, বাম কর্মী-সমর্থকদের প্রশ্নহীন আনুগত্যনির্ভর না করে তুলে, তাঁদের স্বাধীন ভাবে ভাবতে দেওয়া হোক।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া
জনগণের রায়
অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন শেষে ভারতীয় জনতা পার্টি এ বার আর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। এমনকি, ৩০০ আসনের গণ্ডিও তারা পারেনি টপকাতে। কার্যত এনডিএ-র ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলেছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। এ বারের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা স্পষ্ট যে, জনগণ জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়, বিনামূল্যের স্কিম ইত্যাদির দ্বারা বিভ্রান্ত হয়নি এবং এমন একটি সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছে, যারা তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং দেশের প্রকৃত সমস্যাগুলির সমাধানের দিকে মনোনিবেশ করবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, ক্ষমতাসীন দলের বিরোধিতার কোনও সুস্পষ্ট ঢেউ ছিল না, কিন্তু জনগণ যে পরিবর্তন চায় এমন ইঙ্গিত তলে তলে ছিল। মূল্যস্ফীতি, বেকারত্বের মতো বিষয়ে মানুষ নীরব থাকলেও ভোটে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতিই আনুগত্য প্রকাশ করেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ উত্তরপ্রদেশের ফলাফল। শাসক দল অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণকে তাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হিসেবে উপস্থাপন করে থাকলেও সেখানকার মানুষ কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
যে কোনও নির্বাচনেই জাত-ধর্মের সমীকরণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসক দলের পক্ষে এ বার তা খুব একটা কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। ভুললে চলবে না, বিজেপি এই নির্বাচনে সবচেয়ে সম্পদশালী দল ছিল। তারা এই নির্বাচনে যতটা খরচ করেছে, সব দল এক সঙ্গে মিলেও হয়তো অত খরচ করতে পারেনি। প্রচারের ক্ষেত্রেও তাদের তুলনায় অন্যদের প্রচার ছিল ম্লান। তার পরও, জোট পর্যায়ে চার শতাধিক আসন জয়ের লক্ষ্যমাত্রার কাছাকাছি আসাও বিজেপি দলের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। বরং, এ বারের নির্বাচনে আবারও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে আঞ্চলিক দলগুলো।
বিজেপিকে বুঝতে হবে, ভোটের ফলে তাদের প্রতি জনগণের হতাশাই প্রতিফলিত হয়েছে। যিনি ক্ষমতার লাগাম হাতে নেবেন, তিনি তা বুঝেই নীতি, পরিকল্পনা নির্ধারণ করবেন বলে আশা করা যায়।
অভিজিৎ রায়, জামশেদপুর