ব্লক থেকে জেলা হাসপাতাল, জেলা থেকে কলকাতা— নিশ্চয়ই যথাযথ বিবেচনা করেই প্রসূতিকে চিকিৎসকগণ রেফার করে থাকেন। হয়তো স্ত্রীরোগ বা অ্যানাস্থেশিয়া বিশেষজ্ঞ নেই, অন্যান্য পরিকাঠামো ঠিকঠাক নেই, তবু যত দোষ ‘নন্দ ঘোষ’ সেই ডাক্তারবাবুরাই— সম্পাদকীয়তে যথার্থ ভাবেই উত্থাপন করা হয়েছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি (‘নন্দ ঘোষ’, ৩-১২)। আমাদের মতো অনটনের দেশে ব্লক স্তরেও স্পেশালিটি হাসপাতালের সুব্যবস্থা থাকবে, সেটা প্রত্যাশা করা বাড়াবাড়ি। এ কথা ঠিক যে, রেফার করার ফলে অনেক সঙ্কটাপন্ন রোগী সঠিক সময়ে উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তবু এটা মানতে হবে যে, রোগীর স্বার্থেই মূলত রেফার করা জরুরি হয়ে পড়ে। কিন্তু কথা হচ্ছে, রেফার করা রোগী সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে পারবে, সেখানে যথাযথ চিকিৎসা পাবে, তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
বাস্তবে দেখা যায় ব্লক, মহকুমা বা জেলা হাসপাতাল থেকে রেফার করা স্লিপ রোগীর পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে সেই হাসপাতাল দায়মুক্ত হয়ে যায়। রোগীর নিকটজনেরা (যদি থাকে) অসহায় ভাবে, টেনশনের বোঝা নিয়ে রেফার-করা হাসপাতালে পৌঁছলে বহু ক্ষেত্রে দেখেন, সেখানে বেড খালি নেই, কিংবা সেখানেও চিকিৎসার উপযুক্ত পরিকাঠামো নেই। আবার অন্যত্র রেফার, কিংবা কিছু না বলে বিদায় করে দেওয়া। রেফার করার আগে এক বার দেখা হয় না, রোগীকে দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মতো লোকবল, অর্থবল আদৌ আছে কি না পরিবারের। সর্বোপরি, রেফার করা হচ্ছে যে হাসপাতালে, সেখানে সেই সময় বেড খালি আছে কি না, এবং চিকিৎসা পরিকাঠামো আছে কি না। রেফার কেন করলেন, কিংবা রেফার হয়ে আসা রোগীকে কেন ভর্তি নিলেন না, এ সব বলে ডাক্তারবাবুদের ধমকে দেওয়া যায়, কারণ ডাক্তাররা সর্বদাই সফট টার্গেট। কিন্তু সমস্যার কোনও সুরাহা হয় না। সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারদের ফাঁকি দেওয়া, গাফিলতি ইত্যাদির হাজারও নজির নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু ডাক্তাররা আন্তরিক ভাবে চেষ্টা করলেও মুখ্য সমন্বয়ের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে।
অথচ, এই ডিজিটাল টেকনোলজির যুগে সমন্বয় সাধন এমন কিছু জটিল ব্যাপার হওয়ার কথা নয়। ডাক্তারদের ধমক-চমক এবং দোষারোপ বাদ দিয়ে এখনই যেটা ঘোষণা করা উচিত তা হল, সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় রোগী হাসপাতালে এলে তাঁর দায়িত্ব সেই হাসপাতালকেই নিতে হবে। রেফারের প্রয়োজন হলে অবশ্যই রেফার হবে, কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্বও সরকারি ভাবে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালকে নিতে হবে। বাঁকুড়া বা বহরমপুরে প্রসূতির জন্য উপযুক্ত চিকিৎসার পরিকাঠামো না থাকলে তার দায় রোগীকে নিতে হবে কেন? নাগরিক হিসেবে তাঁকে চিকিৎসা প্রদান করা, এবং দরকারে অন্যত্র পৌঁছে দিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে।
ইনাস উদ্দীন, কলকাতা-৩৭
রোগের পরিচয়
পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের রাজ্যে প্রসূতি মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। বতর্মানে প্রতি এক লক্ষ প্রসবে মায়ের মৃত্যু ৯৬ থেকে বেড়ে ১০৯-এ দাঁড়িয়েছে। যা ভারতের গড় প্রসূতি মৃত্যু হারের চাইতে অনেক বেশি। সরকারের বক্তব্য, ডাক্তাররা অধিক সংখ্যায় প্রসূতি মা-কে রেফার করে দিচ্ছে, সেই কারণেই নাকি প্রসূতি মৃত্যুর হার বেড়ে গেছে। যদিও এত দিন আমরা জানতাম, প্রসবের সময়ে বা পরে অত্যধিক রক্তক্ষরণ, রক্তাল্পতা, প্রসবকালীন উচ্চ রক্তচাপ, খিঁচুনি, ইত্যাদি কারণেই প্রসূতি মৃত্যু ঘটে থাকে। এখন কী করে এ সব কারণ গৌণ করে ‘রেফার রোগ’ই প্রধান হয়ে উঠল, তা গবেষণার বিষয়।
এত দিন এ-ও জানতাম যে, চিকিৎসা শুরুর ক্ষেত্রে তিন রকমের দেরির জন্যই মায়ের মৃত্যু ঘটে থাকে। এক, প্রসূতি মা এবং বাড়ির লোকজনের চিকিৎসা করানোর সিদ্ধান্ত নিতে দেরি। দুই, যানবাহন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে হাসপাতালে পৌঁছতে দেরি। তিন, হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে চিকিৎসকের চিকিৎসা শুরু করতে দেরি। এর মধ্যেও তো ‘রেফার রোগ’-এর নাম এল না!
আসলে আরও অনেক কারণ রয়েছে, যার উল্লেখ সরকার করে না। তা হল বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অভাব, বা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত ডাক্তারের অভাব। অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবেও প্রসূতি মা’কে হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেরি হয়। রাস্তায় যেতে যেতেই অনেকের প্রসব হয়ে যায়, এবং বহু ক্ষেত্রে রাস্তাতেই মায়ের মৃত্যু হয়। সেই দোষটা কার? বহু কষ্টে মানুষ প্রসূতিকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে দেখে, সেখানে হয়তো প্রশিক্ষিত ডাক্তার নেই, কিংবা পরিকাঠামো নেই। অথচ, ডাক্তারদের উপর ফরমান রয়েছে, প্রসূতিকে রেফার করা যাবে না। তখন যদি সময়ে রেফার না করার জন্য মায়ের মৃত্যু ঘটে, তার দায়টা কার? প্রায়ই দেখা যায়, উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিকাঠামো না থাকার জন্য গর্ভবতীর জটিল রোগগুলো নির্ধারণ করা গেল না। সেই মা শেষ মুহূর্তে মেডিক্যাল কলেজে পৌঁছনোর পরেও যদি মারা যায়, তার দায় কে নেবে?
কিশোরী বিবাহের হার এবং গর্ভবতী কিশোরীর সংখ্যা অত্যন্ত বেড়েছে। মোট গর্ভবতী মায়ের প্রায় চল্লিশ শতাংশই এখন কিশোরী। কিশোরী গর্ভবতীর নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের দ্বিতীয় স্থানে, ত্রিপুরার পরে। এবং মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, মৃত প্রসূতি মায়ের একটা বড় অংশই হল কিশোরী মা। অল্প বয়সে কন্যাসন্তানের বিয়ে দিয়ে দেওয়া এই তীব্র অভাব ও নৈতিক অবনমনের দিনে আর অস্বাভাবিক নয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কি সেটা জানেন না? তা হলে প্রসূতি মৃত্যুর এত বড় কারণ ধামাচাপা দেওয়া হচ্ছে কার স্বার্থে?
পরিকাঠামোর দুর্বলতা, প্রশিক্ষিত ডাক্তারের অভাব, সহকারী লোকবলের বিপুল ঘাটতি, এমন নানা কারণে প্রসূতি মা’কে রেফার করতে হয়। বড় হাসপাতালেও যথেষ্ট সিনিয়র চিকিৎসকের ঘাটতির জন্য শিক্ষানবীশ এবং অপেক্ষাকৃত স্বল্প অভিজ্ঞ চিকিৎসকের হাতে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মাতৃমৃত্যুর মতো সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে গোটা সমাজের নতুন করে ভাবা দরকার।
সজল বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক, সার্ভিস ডক্টরস ফোরাম
হতাশাব্যঞ্জক
প্রসূতি মৃত্যুর হার আমাদের দেশে খুব স্বস্তিদায়ক নয়। প্রথম কথা, নাবালিকা বিবাহের প্রবণতা বিশেষত প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে, করোনা কালে অনেকাংশেই বৃদ্ধি পেয়েছিল। দ্বিতীয়ত, যতই আমরা প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের উপর গুরুত্ব দিই, দূর-দূরান্তের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে পরিকাঠামো হতাশাব্যঞ্জক! সুতরাং, প্রসূতিদের রেফার করা ছাড়া উপায় থাকে না। বহু দিন আগে একটি ভিন্ন ধরনের সমস্যাসঙ্কুল জেলার দায়িত্বে ছিলাম। প্রশাসন, পঞ্চায়েত, সর্বোপরি স্বাস্থ্য প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে কিছু স্বাস্থ্য শিবির করেছিলাম ব্লকস্তরে। লক্ষ করি, মায়েদের গড় বয়স ১২-১৫, সন্তানের সংখ্যা ২-৩। মা এবং শিশু ভয়ঙ্কর অপুষ্টির শিকার। প্রসূতি এবং শিশুদের পুষ্টিকরণ কর্মসূচির অভাব নেই, যেমন— আইসিডিএস। কিন্তু নাবালিকা, যারা শারীরিক এবং মানসিক ভাবে প্রস্তুত নয়, মাতৃত্বের ধকল নিতে তারা অপারগ। ফলে, প্রসূতি এবং শিশুমৃত্যুর হার কমানো বেশ কঠিন। আর একটি প্রস্তাব— গ্রামাঞ্চলে অনেক ধাই আছেন, যাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রত্যন্ত স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রাখা যেতে পারে কোনও ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে, যাতে সাধারণ উপায়ে প্রসব ত্বরান্বিত করা যায়। অবশ্যই জটিলতার ক্ষেত্রে বড় হাসপাতালে পাঠাতেই হবে। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে সাধারণ প্রসব তো প্রায় বিলুপ্ত। শুধুই সিজ়ার! এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক কমিটি কোন অ্যাডভাইসারি দিতে পারে কি না, সেটি নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটির ভাবনাচিন্তার অবকাশ আছে বলে মনে করি।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি