‘আমব্রেলা বানানে ভুল, দায়িত্ব কি শুধু পড়ুয়ার’ (১৫-৬) প্রতিবেদনে নিহিত প্রশ্ন অসঙ্গত নয়। দায়িত্ব নিশ্চয়ই অন্য পক্ষেরও আছে। পরিবর্তিত সময়ে পরীক্ষার্থী যেমন পাশ করে, তেমনই ক্ষেত্রবিশেষে পাশ ‘করানো’ও হয়ে থাকে। এক কালে বলা হত ‘প্রিচ অ্যান্ড প্রোমোট’। যখন প্রাথমিক থেকে ইংরেজি পড়ানো হত, তখনও কি প্রত্যেকে একই রকম ভাবে নির্ভুল শিখতে পেরেছিলাম? ইংরেজির শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ‘মেড ইজ়ি’ নিয়ে গেলে কৌতূহলী ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন করার ইচ্ছাকে ধমকে চুপ করানো ছাড়া আর কী উপায় আছে।
আসলে কোনও বিষয়কে আকর্ষণীয় করে ছোটদের কাছে হাজির করতে হবে। ওদের নীরবতা ভাঙিয়ে আড়ষ্টতা দূর করা দরকার। এটাই হবে প্রথম কাজ— এই কথা শুনেছিলাম এক প্রবীণ শিক্ষিকার মুখে। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে অনেক কাল আগে থেকেই ‘মাস এডুকেশন’ আর ‘ক্লাস এডুকেশন’-এর ছাঁচে পড়ে পাঠ্যক্রম আর শিক্ষণ পদ্ধতি নিয়ে অনেক রকম পরীক্ষানিরীক্ষা চলে আসছে। এক শ্রেণির মানুষ নীতি নির্ধারণ করে চলছেন। আর যাঁদের উপর সেই নীতি রূপায়ণের ভার, তাঁরা তদনুযায়ী বাস্তবায়ন করছেন কি না, সেটা নিয়ে খোঁজখবর নেওয়ার অভাব অনেক। দুয়ের মধ্যে ফাঁক রয়ে যাচ্ছে কি না, সেটা দেখা দরকার। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা নিছক পাশ করার জন্য বিদ্যালয়ে আসে না। তারা চায় অনেক বেশি শিখতে আর পরীক্ষায় খুব ভাল ফল করতে। সর্বাঙ্গীণ শিক্ষার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যখন পাশ-ফেল প্রথা উঠে গেল, এক শ্রেণির মানুষের মনে হল শিক্ষাটাই বুঝি গেল উঠে। আনুষঙ্গিক আর পারিপার্শ্বিক কাজের অজুহাতে একটা গড়পড়তা দায়সারা কর্তব্য পালনের মধ্যে আটকে গেল সব কিছু। মিড-ডে মিল হয়ে গেল আর একটা অজুহাত। পড়ানো আর শেখানোর মধ্যে যে ব্যবধান, তা আর ঘোচানো গেল না। ‘উৎকর্ষ’ অভিযান বিফলে গেল। সার্বিক ঢিলেঢালা ব্যবস্থার দরুন শিক্ষাকে সহজ করার চেষ্টা হয়ে দাঁড়াল সস্তার শিক্ষা। সস্তার দুরবস্থা তো হবেই। তার পর হানা দিল অতিমারি। এর ধকল কাটিয়ে উঠতে কত কাল যে লাগবে, কে জানে!
রঘুনাথ প্রামাণিক, কালীনগর, হাওড়া
এ কেমন নজির?
দক্ষিণ আফ্রিকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে জ্বলজ্বল করত একটি অসাধারণ উক্তি— কোনও রাষ্ট্রকে ধ্বংস করতে হলে পারমাণবিক বোমা বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু শিক্ষার মান নামিয়ে দেওয়া আর পরীক্ষায় ছাত্রদের নকল করতে দেওয়া। ঠিক একই ধারায় আজ এ রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়ারও নানা পরিকল্পনা দৃশ্যমান। সমস্ত স্তরের শিক্ষক নিয়োগে চরম দুর্নীতি, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বাধিকার, স্বতন্ত্র মর্যাদা কেড়ে নেওয়ার চক্রান্তের পাশাপাশি নানা অজুহাতে শিক্ষাঙ্গনের দরজা বন্ধ রাখা-সহ বিভিন্ন কৌশলে এ রাজ্যের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে খাদের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়ার পাকাপাকি বন্দোবস্ত চলেছে। কিন্তু অবাক করার মতো ঘটনা, শিক্ষাব্যবস্থার এমন এক নৈরাজ্যের আবহের মধ্যেও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলের ক্ষেত্রে এক অতিকায় সাফল্যের নজির দৃশ্যমান, যা কোনও ভাবেই শিক্ষাক্ষেত্রের সামগ্রিক চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এমনকি কোভিডকালীন বা তার পরবর্তী টালমাটাল সময়েও তা শুধুমাত্র অক্ষুণ্ণই নয়, বরং নয়া নজির তৈরির ধারা-সহ অব্যাহত।
গত বছর কোভিডের কারণে বিকল্প কোনও পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে বিন্দুমাত্র ভাবনাচিন্তা না করে, পরীক্ষা না নিয়েই মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফল ঘোষিত হয়েছিল। সর্বকালীন রেকর্ড গড়ে ২০২১ সালের মাধ্যমিকে পাশ করে ১০০% আর ৬৯৭ নম্বর পেয়ে প্রথম হয় ৭৯ জন। পাশাপাশি একই পদ্ধতিতে উচ্চমাধ্যমিকেও পাশ করে যায় প্রায় ৯৮% আর ৬০%-এর বেশি উত্তীর্ণ হয় প্রথম ডিভিশনে। এই বছরে পরীক্ষা গ্রহণ করার পরেও এমন নানাবিধ রেকর্ড পরিলক্ষিত হচ্ছে, যা যুক্তি, বুদ্ধি দিয়ে বিচার করলে কোনও ভাবেই স্বাভাবিক নয়। উদাহরণস্বরূপ এ বছরের উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে যদি আমরা চোখ বোলাই, তা হলে দেখতে পাই— এ বার প্রথম দশেই স্থান পেয়েছে নয় নয় করে ২৭২ জন। কোথাও একই স্কুলের ২২ জন, কোথাও বা ৮ জনের নামে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে প্রথম দশের মেধাতালিকা।
কৃতী ছাত্রছাত্রীদের সাফল্যের প্রতি এতটুকু কটাক্ষ বা তাদের প্রকৃত কৃতিত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করা এ লেখার লক্ষ্য নয়। কিন্তু যে ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আজ এমন ফলাফল প্রচারমাধ্যমের ঝলসানিতে উজ্জ্বল— তা অনেকাংশেই কার্যত প্রহসনমাত্র। শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংসের যে আয়োজনে গত দু’-বছরে প্রশাসন নিয়োজিত থাকল, এমন ফলাফলের মাধ্যমে সে আপন চূড়ান্ত ব্যর্থতা আর নৈতিক দায়কেও এক লহমায় যেন আড়ালের বন্দোবস্ত পাকা করে ফেলল। এমন মূল্যায়ন প্রকৃত মেধা, পরিশ্রমের স্বীকৃতিকেও যেমন সামাজিক পরিসরে অবমূল্যায়িত করে, একই ভাবে এক জন পড়ুয়ার নিজেকে মূল্যায়নের মাপকাঠিও চরম ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জীবনের বৃহত্তর ক্ষেত্রে তা তাকে দুর্বল করে গড়ে তোলে। এক দিকে সার্বিক অসততা, অন্য দিকে নিয়মতান্ত্রিকতা ও শৃঙ্খলার যে স্খলন আজ এ রাজ্যের সমাজ জীবনে পরিব্যাপ্ত, তা যদি শিক্ষাব্যবস্থার হাত ধরেও এমন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি অর্জন করে, তা হলে এ রাজ্যের ভবিষ্যৎ আরও কঠিন আঁধারে ডুবে যেতে বাধ্য।
রাজা মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১৪৪
হাত ধরে চলা
বেশ কয়েক বছর আগে দৃষ্টিহীন ছাত্রদের জন্য তৈরি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছিল। একমাত্র সন্তান ক্লাস নাইনে ওঠার পর তার ভবিষ্যৎ, না কি বাংলার বিভিন্ন কোণ থেকে পরিজন ছেড়ে সংগঠনের হস্টেলে থাকা দৃষ্টিহীন ছেলেদের স্বার্থ— কোনটিকে অগ্রাধিকার দেব, সেই দোটানায় পড়ে নিজের সাধারণত্ব অতিক্রম করার মতো মানসিক জোর অর্জন করতে পারিনি। ছেলের পড়াশোনা নিয়ে ভালমতো জড়িয়ে পড়ায় পরবর্তী কালে ধীরে ধীরে সংগঠনটির সঙ্গে যোগাযোগ কমতে কমতে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।
ওই সংগঠনের এক সভায় এক উচ্চ প্রতিষ্ঠিত দৃষ্টিহীন ব্যক্তিকে নিজের জীবনের উদাহরণ দিয়ে ছাত্রদের এই বলে উপদেশ দিতে শুনেছিলাম, তারা যদি নিজের সমস্যাটা অন্যের ঘাড়ে পুরো চাপিয়ে দেয়, তবে সেই সমস্যা ঘাড়ে করা ব্যক্তি কয়েক পায়ের বেশি চলতে পারবেন না। ফলে দৃষ্টিহীন ব্যক্তিটিরও উন্নতি ওই কয়েক পায়ের বেশি হবে না। কিন্তু অন্য দিকে, যদি কারও হাত ধরে চলা যায়, তবে দৃষ্টিহীন ব্যক্তিটি ওই সামান্য সহায়তা নিয়েই গোটা পৃথিবী ঘুরে আসতে পারবেন। অর্থাৎ, তিনি এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন— জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে গেলে পরনির্ভরতা নয়, হাত ধরে চলা প্রয়োজন।
দেড় মাস গরমের ছুটি কাটানোর পর গরম না কমায় সরকার ছাত্রছাত্রীদের সম্ভাব্য কষ্টের সম্ভাবনায় অতি বিচলিত হয়ে সরকার ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে গ্রীষ্মাবকাশ আরও বেশ কিছু দিন বাড়িয়ে দেয়। এই ছুটির বৃদ্ধিতে শিক্ষক, অভিভাবক থেকে শিক্ষাবিদ— কেউই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। সরকার শিশু, কিশোর-কিশোরীদের কথা চিন্তা করছে, তাদের ভাল চাইছে— এটা তো খুবই ভাল কথা। কিন্তু শিশুদের ভাল চেয়ে তাদের নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিজের ঘাড়ে না তুলে যদি সরকার হাত ধরে তাদের সঙ্গে নিয়েই এগোতে চায়, তা হলেই ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে অনায়াসে পৌঁছতে পারবে। অন্যথায় তাদের যাত্রা শেষ হওয়া তো দূরের কথা, শুরুই হতে পারবে না। তাই অকারণ ছুটি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হোক, পড়াশোনা নির্বিঘ্নে চলুক।
পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।