Manipur Violence

সম্পাদক সমীপেষু: লাগাতার হিংসা

কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ডবল এঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও মণিপুরের এই পরিস্থিতির দায় ভারতীয় জনতা পার্টিকেই নিতে হবে। যেখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ঘুরিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জুলাই ২০২৩ ০৭:২১
Share:

মণিপুরে মানবিক বিপর্যয়ের মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ কি না, এই প্রশ্ন উঠছে আজ। এত দিন ধরে মণিপুরে লাগাতার হিংসা সত্যিই উদ্বেগজনক। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সাধারণ সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবলে বিবৃতি জারি করে বলেছেন, কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ, সেনাকে অবিলম্বে হিংসা বন্ধ করার পদক্ষেপ করতে হবে। এই দাবির মধ্য দিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন সরকারের ব্যর্থতার দিকেই আঙুল উঠল।

Advertisement

মণিপুরের মাটিতে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে সংঘর্ষ চলছে, তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া প্রয়োজন। সংবাদে প্রকাশ, এই সংঘর্ষে প্রায় দু’শো মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। পঞ্চাশ হাজার মানুষ ঘরছাড়া। কেন্দ্রে এবং রাজ্যে ডবল এঞ্জিন সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়া সত্ত্বেও মণিপুরের এই পরিস্থিতির দায় ভারতীয় জনতা পার্টিকেই নিতে হবে। যেখানে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ঘুরিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যর্থতার দিকে আঙুল তুলেছে। মন কি বাত-এ বহু মানুষ রেডিয়ো রাস্তার উপরে আছড়ে ভেঙেছেন। কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে নরেন্দ্র মোদীকে রাজধর্ম পালনের কথা বললেও রাজধর্ম পালনে ঘাটতি কোথায়, তা কেন্দ্রীয় সরকারকেই খুঁজে বার করতে হবে। অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন অক্সিজেনের আকাল, লাদাখে চিনের ভারতীয় জমি দখল, যৌন নির্যাতনের অভিযোগে মহিলা কুস্তিগিরদের বিক্ষোভের ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার, বিশেষত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরবতা বিস্মিত করে। এত দিন উত্তর-পূর্বে ভারতীয় জনতা পার্টির সাফল্য ঢাক পিটিয়ে প্রচার করা হলেও দেড় মাস ধরে চলা মণিপুরের অশান্তিতে প্রধানমন্ত্রী শান্তির আহ্বান জানাতেই পারতেন। এই মানবিক বিপর্যয় আটকানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার এবং মণিপুর সরকারের যৌথ উদ্যোগ জরুরি। যেখানে ডবল এঞ্জিন-এর সরকার প্রতিষ্ঠিত, সেখানে এই সমস্যার সমাধান সূত্র খুঁজে বার করতে এত সময় কেন লাগছে?

তবে কি ধরে নিতে হবে, মণিপুরের শান্তির আহ্বান জানানোর দায়িত্ব রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের উপরে ছেড়ে দিয়েই প্রধানমন্ত্রী নিশ্চিন্ত থাকতে চাইছেন। অবিলম্বে মণিপুরে শান্তি ফেরানোর সকল দায় এবং দায়িত্ব ভারতীয় জনতা পার্টিকেই নিতে হবে। বৈচিত্রে ভরা উত্তর-পূর্বাঞ্চলে শান্তি ফেরানোর লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হলে আগামী দিনে সারা দেশের মানবতার ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসতে পারে।

Advertisement

কুন্তল চক্রবর্তী

বনগাঁ, উত্তর ২৪ পরগনা

ঘনীভূত সঙ্কট

‘বিপুল ব্যর্থতা’ (১২-৭) সম্পাদকীয়তে মণিপুর-হিংসা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংহের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের দিকে আঙুল তোলা যথার্থ হয়েছে। ডবল এঞ্জিন তত্ত্বে চলা মণিপুরে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পুরো গাড়িটিই যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। যেখানে দু’মাস ধরে প্রায় দু’শো মানুষের মৃত্যু হয়েছে ও হাজার হাজার মানুষ ঘটিবাটি হারিয়ে আশ্রয় শিবিরে জায়গা নিতে বাধ্য হয়েছেন, সেখানে আমাদের ভাষণপ্রেমী প্রধানমন্ত্রী এখনও মৌন বজায় রেখেছেন। অথচ, এক দিনে ৫০০ ফিতে কাটাকে কেন্দ্র করে বা সরকারি ক্ষেত্রে স্বাভাবিক যোগ্যতায় চাকরি পাওয়া যুবক-যুবতীদের কাছে দয়ার সাগর হয়ে চাকরি বিলোনোর ভাব করে ভক্তদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরিতে তাঁর জুড়ি নেই। প্রতিশ্রুতিমতো বছরে দু’কোটি চাকরি দেওয়ার কথা তখন তিনি বেমালুম ভুলে থাকেন। এমন ভাষণপটু প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর নিয়ে নীরবতা পালন অকারণে নয়। এই বিষয়ে তিনি যা-ই বলবেন, তা-ই তাঁর বিপক্ষে যাবে, এই সারকথা হয়তো তিনি বুঝেছেন।

মণিপুরের সমস্যা কুকি ও মেইতেই গোষ্ঠী দু’টির সমস্যা, কেবলমাত্র তাদের বিরোধ বলে মনে হলেও প্রকৃত অর্থে তা নয়। ছোট ছোট জাতিগুলির পূর্ণ জাতি-অধিকার ও মর্যাদা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে লুকিয়ে আছে এই সমস্যা। কিন্তু আমাদের দেশে সেই আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠা হওয়া এই প্রচলিত ব্যবস্থায় প্রায় অসম্ভব হয়ে রয়েছে। তাই তাদের মধ্যে তফসিলি জনজাতি অধিকারের মাধ্যমে সুযোগসুবিধা পাওয়ার চাহিদা তৈরি হয়েছে। তারা ভাবছে, এই পথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগসুবিধা পাওয়া যাবে। অন্য পক্ষ ভাবছে, এতে তাদের অধিকার ও সুযোগ সঙ্কুচিত হবে।

আমাদের রাজ্যে কুড়মি গোষ্ঠীর মানুষেরাও এমন কথা ভাবছেন। এর কিছু প্রতিফলন ইতিপূর্বে রাজবংশী বা গোর্খা সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা গিয়েছে। ফলে তাঁরা নিজস্ব বিকাশের স্বার্থে সংগঠিত হয়ে লড়াইয়ে শামিল হয়ে যান। আমাদের দেশের নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চালু জাত-ধর্ম-বর্ণের প্রভাবের সঙ্গে এই জাতিগোষ্ঠী মানসিকতার প্রতিফলন আরও বেড়ে চলেছে। যার ফলে গণতান্ত্রিক চেতনা প্রকৃত অর্থে পিছন পানে হাঁটছে।

স্বাধীনতার পর বিগত ৭৬ বছরে, বিশেষত গত ৯ বছরে মনুবাদী ভাবধারায় চালিত আরএসএস-বিজেপি সরকার এই সমস্যা সমাধানে শুধু ব্যর্থ নয়, বরং তা আরও বাড়িয়ে চলেছে। কোনও দিশা দেখানোর পরিবর্তে সুযোগমতো ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেও একই কথা কম-বেশি প্রযোজ্য। তাই এই দীর্ঘ সময়ে সঙ্কট আরও ঘনীভূত হয়েছে, বেড়ে চলেছে এবং আগামী দিনে আরও বেড়ে চলবে বলেই মনে হচ্ছে।

এই সঙ্কট মোকাবিলায় শাসকশক্তিকে বার বার অস্ত্রের ঝনঝনানি শোনাতে হবে। ফলে সহমর্মিতা, মানবিকতার প্রশ্ন অবান্তর বিষয় হয়েই থেকে যাবে।

শ্যামল ঘোষ

কলকাতা-১৩১

বন্ধ হোক খেলা

প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, আগুন’ (৬-৭) শীর্ষক প্রবন্ধে মণিপুরের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির যে তথ্য উঠে এসেছে, তা হাড়হিম করা এক ট্র্যাজিক চিত্রনাট্য। সাম্প্রদায়িক ঘৃণা-বিদ্বেষ রক্তের অণু-পরমাণুতে মিশে গিয়ে তা যে কোন মাত্রায় পৌঁছতে পারে, তার জ্বলন্ত উদাহরণ মণিপুর। মেইতেই আর কুকি সম্প্রদায়ের গুলির লড়াইয়ের সামনে পড়ে সাত বছরের তনসিং হ্যাসিং, যার শরীরে বইছে উভয় সম্প্রদায়ের রক্ত। রক্তাক্ত তনসিংকে পুলিশি পাহারায় অ্যাম্বুল্যান্সে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে চড়াও হয় মেইতেইরা। তাদের বিশ্বাস, কুকিদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাই অ্যাম্বুল্যান্সে আগুন ধরানো হল। ঝলসে মারা হল সাত বছরের ছেলেটিকে, তার মা এবং প্রতিবেশী মহিলাকে। এমন নারকীয় ঘটনা সেখানে প্রায়ই ঘটে চলেছে। হাজার হাজার মানুষ ছিন্নমূল হয়ে পথে বসেছেন, রাজ্য ছেড়েছেন। বিশেষ করে মেইতেই অঞ্চলে বসবাসকারী জনজাতি কুকি সম্প্রদায় যেমন গৃহছাড়া, তেমনই পাহাড় অধ্যুষিত কুকি এলাকায় বসবাসকারী মেইতেইরা প্রাণ হাতে নিয়ে অঞ্চল ছাড়া। সারা ভারত জুড়ে চলছে এই মারণযজ্ঞ। মণিপুর তাই গোটা ভারতের কাছে সতর্কবার্তা। মণিপুরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যেমন কোণঠাসা, শঙ্কিত, দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের তকমা পাচ্ছে, তেমনই সমগ্র ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ও একই তকমায় বিশেষিত। মুসলমান মানেই অনুপ্রবেশকারী, একাধিক বিবাহ, চোরাকারবারি— এমনই নানাবিধ বিদ্বেষের বীজ সমাজে বপন করছে বিজেপি ও তার দোসর আরএসএস। সব দলের সরকারই ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে সাম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে, কিন্তু বর্তমানের মতো তা এমন নগ্ন থাবা বিস্তার করে না।

জন্ম মুহূর্তেই এই সাম্প্রদায়িক বীজ আমাদের রক্তে খেলা করে। মৌলবাদীদের হাতে পড়ে ধর্ম আজ ভূলুণ্ঠিত। আর যখন সরকার মৌলবাদী হয়ে ওঠে, তখন তা নখদন্ত বিস্তার করে অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। প্রবন্ধকার এখানে যথার্থই বলেছেন, গোটা দেশের এই কাহিনি যদি উপন্যাস হয়, তা হলে মণিপুর এরই ছোট গল্প। ইতিহাস তার বার বার প্রমাণ রেখেছে। তাই শেষের সে দিনের কথা ভেবে নিরন্তর এ খেলা বন্ধ হোক।

সূর্যকান্ত মণ্ডল

কলকাতা-৮৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement