‘বিজয়ীর দায়িত্ব’ (১৯-৫) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে লেখা হল: ‘‘স্পষ্টতই, এই নির্বাচনে বৃহত্তম বিরোধী শক্তি হিসাবে যে দলটির উত্থান হইয়াছে, তাহা পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্যের পক্ষে ইতিবাচক নহে।’’ বলাই বাহুল্য এই বৃহত্তম দলটি বিজেপি। নির্বাচনের মাধ্যমে বিরোধী দল হিসাবে উঠে আসা সর্বভারতীয় দলটি সম্পর্কে এ জাতীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়ার অধিকার সংবাদপত্রের নেই। স্বাধীন সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সংবাদমাধ্যম অবশ্যই সরকারের সমালোচনা করবে, তার কর্মপদ্ধতির ভুল ধরিয়ে দেবে। কিন্তু সংবাদমাধ্যমকে মনে রাখতে হবে, সে বিচারক নয়। গণতান্ত্রিক ভাবে জিতে আসা বা বিরোধী দলের মর্যাদায় উঠে আসা কোনও দলকে দেশের বা রাজ্যের পক্ষে ‘স্বাস্থ্যহানিকর’— বিচারকসুলভ এ জাতীয় রায়দানের তার কোনও অধিকার নেই। তা হলে যেমন গণতন্ত্রকে অমর্যাদা করা হয়, তেমনই যে বিপুল জনগণ সেই দলকে ভোট দিলেন তাঁরাও ভুল করেছেন বলে ঘোষণা করা হয়।
গৌতম কুমার মণ্ডল
কুমিরদোহা, ছাতনা, বাঁকুড়া
বীভৎস ছবি
গত রবিবারের (৩-৬) সুন্দর সকালটা বিষণ্ণ ও ভয়ঙ্কর করে দেওয়ার জন্য আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতা যথেষ্ট। এক গলায় দড়ি দেওয়া ঝুলন্ত মৃতদেহের পূর্ণাঙ্গ ছবি! দীর্ঘ দিনের পাঠক হিসেবে এই ধরনের ছবি প্রকাশের বিরুদ্ধে তীব্র আপত্তি জানাচ্ছি। আগে আপনাদের কাগজে এ রকম ছবি কখনও ছাপা হত না। ঘটনার তীব্রতা যতই হোক, অনুরোধ করছি, এ ভাবে ছবি ছাপবেন না। শিশুরাও সকালে কাগজের পাতা দেখে। এ রকম ছবি ওদের মনে ভীষণ ভীতি তৈরি করে।
বিভাস চন্দ
মেদিনীপুর শহর
কী মানসিকতা
আনন্দবাজারের প্রথম পাতায় এক জন মানুষের গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলার ছবি দেখে তাজ্জব হয়ে গেলাম। এ কোন আনন্দবাজার দেখছি! এই ছবি ছাপিয়ে আপনারা কী ধরনের মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন! বাড়িতে আমরা সপরিবারে আনন্দবাজার পড়ি। বাচ্চারা এই ছবি দেখে কেবলই প্রশ্ন করছে। উত্তর দিতে পারছি না। দীর্ঘ কাল ধরে আমরা এই কাগজের পাঠক। বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দিয়ে এই ধরনের ছবি ছাপলে আনন্দবাজার পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করা ছাড়া আর কোনও উপায় দেখছি না।
সুরজিৎ বিশ্বাস
কল্যাণী, নদিয়া
দায়বদ্ধতা
সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার দিকটি কোনও না কোনও ভাবে লঙ্ঘিত হয়ে চলেছে আনন্দবাজার পত্রিকার মতো ঐতিহ্যশালী কাগজেও। খুব অল্প কয়েক দিনের ব্যবধানে দুই বিজেপি কর্মীর গলায় ফাঁস দেওয়া যে ছবি দু’টি আপনারা কাগজের প্রথম পাতায় ছাপলেন, তা কোনও ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। অতীতেও বিভিন্ন সময় এই ধরনের নানা বিতর্কিত ছবি কাগজের বিভিন্ন পাতায় নানা ভাবে আমরা দেখেছি। বার বার প্রশ্ন উঠেছে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু আপনারা উপেক্ষাই করে গিয়েছেন পাঠকদের অধিকাংশ পরামর্শ এবং প্রতিবাদ। এই ধরনের ছবি শিশুমনে কী মারাত্মক প্রভাব ফেলে, তা একমাত্র ভুক্তভোগীরাই হাড়ে হাড়ে টের পান।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত
ধাড়সা, হাওড়া
মিথ্যা বলতে হয়
রোজ যাতায়াতের পথে আমি আনন্দবাজার পত্রিকা কিনি। গাড়িতে বসে রোজকার খবরগুলো পড়ে নিই। আমি বাড়ি ফেরার পর, আমার বয়স্ক বাবা-মা সন্ধেবেলায় কাগজের প্রতিটি পাতায় চোখ বুলিয়ে জেনে নেন রোজকার খবর। এ মাসের ৩ তারিখেও আনন্দবাজার কিনেছিলাম। পড়েছিলাম সমস্ত খবর। কিন্তু তার পর চলন্ত বাসের জানলা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে ফুটপাতের ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলাম প্রথম পাতাটা।
রাতে মা যখন জিজ্ঞেস করলেন, আজকের প্রথম পাতাটা কই? মায়ের মুখের দিকে না তাকিয়ে জবাব দিলাম, ‘‘মনে হয় হারিয়ে গিয়েছে!’’ আড়চোখে খেয়াল করলাম, মা তখনও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। বললেন, ‘‘পেপারের প্রথম পাতা কেউ কখনও হারিয়ে ফেলে!’’ আমি আর কোনও উত্তর দিলাম না, দরজার পর্দা ঠেলে ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, আমি মায়ের কাছে মিথ্যে বলেছিলাম। খুব খারাপ লাগছিল সারা রাত।
ওই দিন যে খবরগুলো পরিবেশন করা হয়েছে, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু প্রথম পাতায় এক যুবকের যে ঝুলন্ত ছবি ছাপা হয়েছিল, তা অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং ভয়ঙ্কর। আমি চাই না আমাকে আবার মিথ্যে বলতে হোক!
উৎপল কুমার বিশ্বাস
কৃষ্ণপুর চক, রানাঘাট, নদিয়া
আনন্দবাজার পত্রিকার বক্তব্য:
আলোচিত ছবিটি দেখে অনেকে আঘাত পেয়েছেন। তাঁদের আপত্তি ও প্রতিবাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
কিন্তু আমাদের বিনীত নিবেদন, ওই ছবি ছাপাকে আমরা কর্তব্য বলেই মনে করেছি। সংবাদপত্র সমাজের দর্পণ। সমাজ যেমন হবে, তার চিত্র ঠিক সে ভাবেই তুলে ধরা সংবাদপত্রের দায়িত্ব। সমাজ যদি কদর্য হিংসা ও হানাহানিতে পূর্ণ হয়, সে বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজও কি সংবাদপত্রের উপর বর্তায় না? আমরা জানি, অনেক পাঠক সকালে উঠে দিনের কাগজটি হাতে তুলে নিয়ে ওই ভয়ানক সংবাদ-চিত্র দেখে শিউরে উঠেছেন। এই অস্বস্তি ও আতঙ্ক থেকে যে সঙ্গত ক্রোধ ও প্রশ্নের জন্ম হয়— এই পরিস্থিতি তৈরির জন্য কে বা কারা দায়ী, এর সমাধানই বা কী— তা উৎপন্ন করার জন্য ওই তীব্র অভিঘাতটি আবশ্যক ছিল বলে আমরা মনে করি।
অনেকেই শিশুমনের উপর এ ধরনের ছবির প্রভাবের কথা বলেছেন। খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। কিন্তু আমাদের মনে হয়, শিশুকে বাস্তব থেকে, সত্য থেকে পুরোপুরি আড়াল করে রাখা উচিত কাজ নয়। কারণ বড় হয়ে তাকে এই সমাজেই বাঁচতে হবে। এবং যতই অপ্রিয় হোক, সত্যের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কদর্য ঘটনাগুলি বাদ দিয়ে তাকে কেবল স্বস্তিকর ব্যাপারগুলি জানানোর যে অভ্যাস আমাদের সমাজে আছে, তা হয়তো তার পূর্ণ বিকাশের পক্ষে সহায়ক হবে না।
এ কথা আমরা অবশ্যই মানি যে, সব কিছুরই মাত্রা সম্পর্কে, সীমা সম্পর্কে সর্বদা সচেতন ও সতর্ক থাকা আবশ্যক। যদি কোনও ছবিতে সরাসরি বীভৎসতার প্রদর্শনী থাকে, যেমন ছিন্নভিন্ন মানবদেহ, সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় হয়তো সেই ছবি ব্যবহার করা বিধেয় নয়। তবে তা হল ছবির মধ্যে অস্বস্তিকর অনুপুঙ্খের প্রশ্ন। কিন্তু আলোচ্য ছবিটি নিয়ে যে আপত্তি উঠেছে, তা মৌলিক বিষয়গত— এমন ছবি আদৌ কেন ছাপা হবে, প্রতিবাদীরা সেই প্রশ্ন তুলেছেন। এর উত্তরে আমরা সবিনয়ে জানাই, যে সমাজে এই ধরনের ঘটনা ঘটে চলেছে, সেই সমাজের সংবাদপত্রে ওই ছবিটি ওই ভাবে ছাপার কাজটিকে আমরা আমাদের কর্তব্য তথা দায় বলে মনে করি, কারণ তা থেকেই হয়তো মানুষের মনে এমন পরিবর্তনের সূচনা হবে, যার ফলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা কমবে।
যে চিন্তাশীল পাঠকরা এমন একটি গুরুতর বিষয়ে অত্যন্ত মূল্যবান প্রশ্নগুলি উত্থাপন করেছেন এবং একটি সদর্থক মতবিনিময়ের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দিয়েছেন, আবারও তাঁদের আন্তরিক ও সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা জানাই।