Satyajit Ray

সম্পাদক সমীপেষু: উপেক্ষিত যে ছবি

আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, সত্যজিতের শতবর্ষেও টু ওঁর সবচেয়ে কম আলোচিত একটি ছবি, বোধ হয় উপেক্ষিত বললেও খুব ভুল হবে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২২ ০৫:০২
Share:

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চেনা খোপের বাইরে’ (৮-৫) প্রবন্ধটি পড়লাম। সত্যজিতের টু নামক স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবিটির কোনও উল্লেখ প্রবন্ধকার করেননি দেখে অবাক হলাম। আফসোসের সঙ্গেই বলতে হয়, সত্যজিতের শতবর্ষেও টু ওঁর সবচেয়ে কম আলোচিত একটি ছবি, বোধ হয় উপেক্ষিত বললেও খুব ভুল হবে না। হয়তো সেটা দৈর্ঘ্যের কারণেই। সত্যজিতের ছবির অন্তর্নিহিত রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলেও সাধারণত টু ছবিটির কথা কেউ উল্লেখ করেন না, অথচ মাত্র ১২ মিনিটের এই ছবির পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে পরিচালকের সুস্পষ্ট একটি রাজনৈতিক বক্তব্য। ১৯৬৪ সালে আমেরিকার পাবলিক ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের অনুরোধে নির্মিত এই ছবির মাধ্যমে ভিয়েতনামে যুদ্ধরত আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী সরকারের ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে এক নির্বাক প্রতিবাদ লিপিবদ্ধ করেছেন পরিচালক। টু ছবিটিতে ধনীগৃহের সন্তানটি আমেরিকার আগ্রাসী মনোভাবের প্রতিনিধি, অন্য দিকে দরিদ্র ছেলেটি যেন দুর্দশাগ্রস্ত ভিয়েতনামের সহিষ্ণুতা ও প্রতিবাদের ক্ষুদ্র সংস্করণ। শুধু তা-ই নয়, ছবিতে সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলেটির ব্যবহৃত দু’টি খেলনা বন্দুকের নাম ‘ফ্যাট’ এবং ‘লিটল’। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যে দু’টি পরমাণুবোমা নিক্ষিপ্ত হয়, তাদের নাম ছিল ‘লিটল বয়’ এবং ‘ফ্যাট ম্যান’! একটি বছর ছয়েকের ধনী সন্তানের প্রাচুর্য ও আস্ফালনের বিপ্রতীপে আর একটি সমবয়সি হতদরিদ্র শিশুকে রেখে সত্যজিৎ যে ভাবে অসাম্যকে তুলে ধরেছেন, তাতে ছবিটি যথেষ্ট আলোচনার দাবি রাখে।

Advertisement

সৌরনীল ঘোষ
দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

জীবনের দাম

Advertisement

জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখার পথ ধরে কিছু কথা মনে এল। বহু দিন আগে, বিএ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় অশনি সংকেত দেখে ঝোঁকের বশে সত্যজিৎ রায়কে একটা ফোন করে বসেছিলাম। সে দিন তিনি প্রথমেই বলেছিলেন, “দু’মিনিট, দরজাটা বন্ধ করে আসি।” তার পর বেশ খানিক ক্ষণ ছবিটা নিয়ে কথা বলেছিলেন, বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। সে দিন ছবির শেষ দৃশ্য, যেখানে ব্রাহ্মণ পরিবার নিয়ে গঙ্গাচরণের বাড়ি ফিরে আসেন, তার উল্লেখ করছিলেন যখন, আমি প্রশ্ন করেছিলাম, তা হলে কি আপনি বলবেন, মানুষের চরিত্রের এই উত্তরণে যুদ্ধের একটা ভূমিকা আছে? তিনি বলেছিলেন, “সে তো বটেই। সঙ্কট, বিশেষত এ রকম ব্যাপক সঙ্কট না এলে তো মানুষ বুঝতে পারে না, জীবন কত দামি এবং একা বাঁচার ধারণাটা কত মিথ্যে।”

সুতনুকা ভট্টাচার্য
কলকাতা-৪৭

ছবির সূত্র
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের সূত্রে বলা যায়, সত্যজিৎ রায়ের অনেক ছবিই “হিংস্র ভাবে রাজনীতি সচেতন” (মৃণাল সেন অবশ্য কথাটি কলকাতা নগরী সম্পর্কে বলেছিলেন)। তাঁর চলচ্চিত্রে রাজনীতি ও সমাজচেতনার ইঙ্গিত এক‌ মহোত্তর স্তরে উত্তীর্ণ করে তাঁর সৃষ্টিকে। প্রতিদ্বন্দ্বী ছবির ভিয়েতনাম সম্পর্কিত উক্তিটি তো বহুচর্চিত। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার সময়ে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তরে সিদ্ধার্থ যখন জানতে চায় “কার স্বাধীনতা”, তা চলচ্চিত্রকারের ক্ষুরধার রাজনৈতিক বোধের পরিচায়ক। ছবিটিতে স্বপ্নদৃশ্যগুলি চমকপ্রদ, সত্তরের দশকের অস্থির সময়ের এক অমূল্য দলিল। সিদ্ধার্থের উপহার দেওয়া চে গেভারার ডায়েরি তুলে ধরে তার নকশাল ছোট ভাই শুধু সিদ্ধার্থকে নয়, আমাদেরও অস্বস্তিতে ফেলে।
সমকাল সম্পর্কে তীব্র ভাবে সচেতন সত্যজিৎ বহুজাতিক কোম্পানির আধিকারিক শ্যামলেন্দুর বিবেকহীন, নৃশংস, ম্যাকবেথীয় উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রদর্শনের মাধ্যমে বুর্জোয়া সমাজব্যবস্থার অমানবিক চেহরাটা তুলে ধরেন সীমাবদ্ধ ছবিতে। আবার জনঅরণ্য-এ পুঁজিবাদী সমাজের অবক্ষয়, ক্লেদ ও মনুষ্যত্বহীনতার যে ভয়াল চিত্র উন্মোচিত হয়, তা রাজনৈতিক তাৎপর্যমণ্ডিত। এই রাজনৈতিক বোধ দর্শকচেতনাকে ঋদ্ধ করে। তাই সত্যজিৎকে উৎপল দত্ত চিঠিতে লিখেছিলেন, “মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে নিরুত্তাপ বিশ্লেষণে প্রতি মুহূর্তে ধরাশায়ী করে আপনি ছবিটিতে এক বৈপ্লবিক মাত্রা যোগ করেছেন।” যে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে ঘুষ, যৌনতা, নেশা, হিংসা ‘সবই ঐতিহ্যের ব্যাপার’। সদগতি ছবিতে অমানবিক শোষণের চিত্রায়ণ, গুপী বাঘার যুদ্ধবিরোধী জেহাদ, হীরক রাজার একনায়কত্বকে তীব্র স্যাটায়ারে ধূলিসাৎ করা— সবই একই সূত্রে গাঁথা, পরিচালকের গভীর রাজনৈতিক বোধসঞ্জাত। তবে অপুর সংসার-এ তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষের অনুল্লেখ আমাদের বিস্মিত করে। সেই জন্যই কি পরে তৈরি করেন অশনি সংকেত?

আমাদের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষে আমরা ততটাই ঋণী সত্যজিৎ রায়ের কাছে, যতটা মৃণাল সেন বা আইজ়েনস্টাইনের কাছে। অনেক সময়েই সত্যজিৎকে দেশ, কাল, শ্রেণির ঊর্ধ্বে এক সৃজনপ্রতিভা হিসেবে তুলে ধরা হয়। এর পিছনে শ্রেণিস্বার্থের ইশারা প্রকট।

শিবাজী ভাদুড়ি
হাওড়া

ঘোষণাবিমুখ
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই লিখেছেন, ‘কমিটমেন্ট’ জিনিসটাই বেশ গোলমেলে। আত্মপ্রচার এখনকার দিনে রাজনীতিক থেকে শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, সবারই প্রধান হাতিয়ার। সত্যজিতের রাজনীতি-সচেতন সিনেমা তার একেবারেই বিপরীত; ঘোষণাবিমুখ। কাউকে খুশি করার, কিংবা কোনও শিবিরকে কৈফিয়ত দেওয়ার তাগিদ তিনি অনুভব করেননি, যতই তিনি সেই মতবাদের সমর্থক হন না কেন! সুস্পষ্ট ভাষায় তাঁর মন্তব্য, “তথাকথিত প্রোগ্রেসিভ অ্যাটিচিউডের যে ফর্মুলাগুলো রয়েছে, এগুলো আমার কাছে খুব একটা ইন্টারেস্টিং, ভ্যালিড বা খুব একটা সঙ্গত বলে মনে হয়নি।” এই অবস্থানের জন্য তিনি যেমন সদগতি-র মতো বৈপ্লবিক ছবি তৈরি করেন, তেমনই সীমাবদ্ধ বা জনঅরণ্য-তে মুখোশ খুলে দেন তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের।
এটা মানতেই হবে, সত্যজিৎ এত বড় মহীরুহ ছিলেন যে, তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করার অনেক অসুবিধা ছিল। তুলনায় ছোট পরিচালকদের উপরে কোপটা পড়েছে বেশি। তবু সন্দেহ থেকেই যায়, আজকের দিন হলে হীরক রাজার দেশে-র মতো ছবি প্রেক্ষাগৃহের মুখ দেখত কি?

শিবপ্রসাদ রায় চৌধুরী
শিবপুর, হাওড়া

দায়বদ্ধ
আজ অধিকাংশ মানুষেরই নিজের প্রতি বিশ্বাস রাজনীতির আবহে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। যেখানে নিজের লাভ, সেটাই যেন প্রকাশ পাচ্ছে ব্যক্তিগত বিশ্বাস হিসেবে। জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচনায় বুঝিয়েছেন, শিল্পী হিসেবে সত্যজিৎ রায় সমাজের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ। তিনি ছবির বিষয়বস্তু এমন ভাবে বাছতেন, তাতে প্রতিফলিত হত সমাজের ঘাত-প্রতিঘাত। ঘরে-বাইরে ছবিতে যেমন বেআব্রু হয়ে ওঠে তখনকার স্বাধীনতা সংগ্রামী, বা আজকের রাজনীতিবিদদের চরিত্র। তেমনই দেখা যায় যে, জমিদার মানেই প্রজাবিদ্বেষী নন। আবার গণশত্রু ছবিতে দেখা যায় ধর্মের নামে কী ভাবে কলুষিত হচ্ছে মানুষের জীবন। আগন্তুক প্রকট করে দেয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব। আজকের শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের দায়বদ্ধতা কোথায় দাঁড়িয়েছে, তা প্রবন্ধকার সুন্দর ব্যাখ্যা করেছেন চারুলতা-র অমলের নিরাপদ ও সহজ উক্তি দিয়ে— “সিডিশন! আমি ওর মইধ্যে নাই।” বর্তমানের এই অবস্থাকে বলা যায় ‘সততার সঙ্কট’। এই খোপ থেকে বেরোনোর রাস্তা দেখানোর জন্য প্রয়োজন সততার প্রতি বিশ্বাস রাখা, স্বার্থসিদ্ধির জন্য অনৈতিকতার যূপকাষ্ঠে নিজেকে বলি না দেওয়া।

অশোক দাশ
রিষড়া, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement