কেন্দ্র-রাজ্য নির্বিশেষে প্রতিনিয়ত প্রশাসনিক স্বচ্ছতার যে বড়াই চলে, স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘সঞ্চয়ের অন্তর্ধান’ (১৭-৭) দেখাল তা কতটা শূন্যগর্ভ। কেতাব খুললেই দেখি, জাতীয় বা দেশের উন্নতির মূল কারিগর নাকি শ্রমিক শ্রেণি। অথচ, শ্রমিকের না পাওয়া সঞ্চয়ের পরিমাণ ২০০৪ সালের আট হাজার কোটি টাকা আজ ২০২৪-এ ৫৮ হাজার কোটি ছুঁয়ে ফেলেছে! লজ্জিত হওয়ার বিড়ম্বনাও নেই, কারণ এই সব ‘আবোল-তাবোল বিষয়’ নিয়ে চর্চার সুযোগ কোথায়। মাইনে থেকে কেটে নেওয়া পিএফের টাকা জমা না পড়া, বছরের পর বছর পিএফ, পেনশন ফাঁকির কোনও সাজা না হওয়া, পিএফ বাবদ কেটে নেওয়া টাকা মালিকের ব্যবসার কাজে বিনিয়োগ— এ সবই তো এক রকম নিয়মে পর্যবসিত। এই গোটা অব্যবস্থার জন্য শ্রমিক ইউনিয়নগুলিকেও তাদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য প্রবন্ধকারকে সাধুবাদ জানাই।
আমাদের শাসকরা মালিক গোষ্ঠীর সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে যতটা উদ্বেগে থাকেন, তার ছিটেফোঁটা উদ্বেগ যদি শ্রমিক শ্রেণির কপালে জুটত, তা হলেও অন্তত আশ্বস্ত হওয়ার উপায় থাকত। বলা যেত যে, সরকারকে যতটা উদাসীন বলে ভাবা হয়, ততটা হয়তো নয়। কিন্তু বিধি বাম, আমরা আজ নিজের গণ্ডি ছেড়ে অন্যের কথা ভাবার অভ্যাস করতে ভুলতে বসেছি। আর তার সুযোগ পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করে সরকার মশগুল উন্নয়নের ঢাক পেটাতে। পাশাপাশি, মালিক-ঘনিষ্ঠ শ্রমিক সংগঠনগুলি ব্যস্ত তাদের বখরার হিসাব বুঝে নিতে। বাম শ্রমিক সংগঠনকে তাই এগিয়ে এসে শ্রমিক-কল্যাণের এই জরুরি বিষয়ে তার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করতে হবে। তাতে শুধু নিজেদের দায়িত্ব পালন করা হবে তা-ই নয়, সমাজ বদলের সলতে পাকানোর কাজটাও শুরু করা যাবে। পর পর নির্বাচনে বামেদের ব্যর্থতার সমাধানসূত্র হিসাবে বিভিন্ন আলোচনায় উঠে আসছে প্রস্তাব— শুরু করতে হবে নতুন করে। তা হলে আর দেরি কেন?
বরুণ কর, ব্যান্ডেল, হুগলি
বামেদের দিশা
ফ্রান্সের নির্বাচনে বামপন্থীদের সাফল্য নিয়ে সমাজমাধ্যমে এ দেশের যে বামপন্থীরা আজ নানা ধরনের পোস্ট করছেন, তাঁদের কাছে ‘সঞ্চয়ের অন্তর্ধান’ প্রবন্ধটির পাঠ জরুরি। এটি বামপন্থী আন্দোলনের কর্তাব্যক্তিদের সাহায্য করবে বামপন্থীদের ক্রিয়াকর্মের কথা মনে করাতে, এবং আত্মসমীক্ষা করতে। শ্রমজীবীদের জীবনের ‘বকেয়া বেতন’ শোষণের একটি দিক পিএফ থেকে বঞ্চনা। প্রবন্ধে এই বিষয়ের আলোচনা থেকে তাঁরা আশু কর্তব্যের পথ খুঁজে পাবেন, এর চর্চা আমাদের দেশের রাজনৈতিক কর্মসূচির অভিমুখ পরিবর্তন করবে। বামপন্থীরা নয়া উদারবাদের প্রকৃত রূপ, পুঁজিসংগ্রহের উৎপত্তিস্থল সন্ধানের পাশাপাশি রাজ্য ও কেন্দ্রের শাসকের ভূমিকার মুখোশ উন্মোচন করতে পারবেন।
উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
হয়রানি পর্ব
স্বাতী ভট্টাচার্যের প্রবন্ধটি চাকরিজীবীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার উপর আলোকপাত করে। আমি দু’টি প্রাইভেট সংস্থায় চাকরি জীবন শেষ করেছি। দু’টি সংস্থাতেই কন্ট্রিবিউটরি পিএফ ছিল। প্রথম দিকে সিপিএফ সম্পর্কে কোনও জ্ঞান ছিল না। সংস্থা পরিবর্তনের সময় সিপিএফ ট্রান্সফার করতে গিয়ে কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কলকাতায় রিজনাল পিএফ কমিশনের দ্বারস্থ হতে হয়েছিল। সে সময়ে নামের বানানে ভুল ছিল। পেনশন ফান্ডে জমা টাকার হিসাব ছিল না। অফিসে ছোটাছুটি করার পর সমস্যাগুলো সমাধান করতে পেরেছিলাম। কিন্তু খেয়াল করিনি প্রথম সংস্থায় আমার পিএফ কাটা হয়েছিল পুরো বেতনের উপর, উচ্চতর পেনশনের জন্য। কিন্তু দ্বিতীয় সংস্থায় পিএফ কাটা হয়েছে পিএফের সাধারণ নিয়মে। জানতে পারলাম অবসরের পর, যখন সাধারণ নিয়মে অতি সামান্য পেনশন পেলাম। অন্তত ৩০ দিন কলকাতার রিজনাল অফিসে ছুটতে হয়েছে।
সেই সময় দেখেছি, কত সংস্থা তাদের কর্মচারীর পিএফের টাকা কেটেও সময়ে জমা করেনি। কত সংস্থায় নিয়মমাফিক পিএফ চালু হয়নি। সংস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কর্মীরা পিএফের টাকা তুলতে দিনের পর দিন ঘুরছেন। কর্মী মারা যাওয়ার পর নমিনি পেনশন চালু করার কাগজপত্র পাচ্ছেন না।
পিএফ অফিসে এক দিন ভুল করে ভিজিল্যান্স বিভাগে ঢুকে পড়েছিলাম। কর্তব্যরত অফিসার আমার সমস্যার কথা গুরুত্ব দিয়ে শুনে একখানা কাগজ দিয়ে বললেন, সংক্ষিপ্ত ভাবে সমস্যাটি লিখে জমা করতে। এর এক সপ্তাহের মধ্যে কমিশনের চিঠি পেলাম। যে সমস্যা নিয়ে এত দিন ঘুরেছি, বিভিন্ন জায়গায় কাগজপত্র-সহ অনেক আবেদন জমা করেছি, সেই সমস্যার সমাধান হল এক মাসের মধ্যে। পেনশন ফান্ডে যে অতিরিক্ত টাকা প্রথম চাকরিতে কাটা হয়েছিল তা সুদ-সহ ফেরত পেলাম। পেনশন অপরিবর্তিত রইল।
এক জন কর্মী প্রতিষ্ঠানকে সমৃদ্ধ করতে কর্মজীবনের যাবতীয় শ্রম দিয়ে থাকেন। বিনিময়ে অবসরের মুহূর্তে প্রভিডেন্ট ফান্ড তাঁকে এক সঙ্গে অনেক টাকা দিয়ে এবং একটি পেনশন দিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় বাঁচার রসদ জোগায়। সরকারি প্রতিষ্ঠানে কোথাও পেনশন আছে বা তার বদলে এনপিএস আছে। প্রাইভেট সংস্থায় তার সুব্যবস্থা নেই। সে ক্ষেত্রে পিএফ ও তার পেনশন বৃদ্ধের লাঠির কাজ করে। তাকে জটিল না করে সহজ, সরল করা এবং সকলের জন্য এক নিয়ম করা দরকার। প্রতিটি সংস্থার উচিত তার কর্মীদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য পিএফ চালু করা।
গৌতম পতি, কুলবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
রুগ্ণতার সঙ্কট
ইপিএফ প্রধানত শিল্প ক্ষেত্রের শ্রমিক/ কর্মচারীদের জন্য এক বাধ্যতামূলক সঞ্চয় ব্যবস্থা। প্রভিডেন্ট ফান্ড, যা সরকারি সংস্থার কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তার সঙ্গে ইপিএফের পার্থক্য হচ্ছে, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে নিয়োগকর্তাদেরও বেতনের শতকরা ১২% প্রত্যেক মাসে জমা করতে হয়। ইপিএফ সংস্থাটি নিয়ন্ত্রিত হয় ভারত সরকারের শ্রম মন্ত্রকের মাধ্যমে। সংস্থাটি শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু এমন একটি শ্রমিকবন্ধু প্রকল্প ক্রমশ পঙ্গুত্বের দিকে এগোচ্ছে। প্রধানত রুগ্ণ শিল্পসংস্থাগুলির পরিচালন কর্তারা শ্রমিকদের অংশ কেটে রাখতেন, কিন্তু তাঁদের অংশ-সহ ইপিএফ-এ জমা না করে তা খরচ করত শিল্প সংস্থার অন্যান্য কাজে। নিজেদের ভাগ দেওয়া তো দূর অস্ত্! মাঝেমধ্যেই নিয়োগ কর্তাদের বিধিভঙ্গের অপরাধে ইপিএফ আদালতে করজোড়ে মুচলেকা দিয়ে মুক্তি পেতে হত। প্রয়াত বামপন্থী নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত এ নিয়ে বহু বার রাজ্যসভায় সরব হয়েছেন। কিন্তু শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিবাদ এ বিষয়ে দানা বাঁধেনি।
রুগ্ণ অথবা সরকারি ভর্তুকি-নির্ভর শিল্প সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেতন দিতেই আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয়। তার পর সংস্থার দৈনন্দিন খরচ বহন করতে ইপিএফের না জমা করা তহবিলে হাত পড়া প্রায় অবধারিত। সুতরাং রুগ্ণ শিল্পগুলিকে ভর্তুকি-নির্ভর করে না রেখে বেসরকারি বিনিয়োগ করে অভিজ্ঞ শিল্পপতিদের পরিচালনভার দেওয়া শ্রেয়— অবশ্যই শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা করে।
সুবীর ভদ্র, কলকাতা-১৫১