ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান নীতি-বিবর্জিত রূপটির দিকে নির্দেশ করেছেন চিন্ময় গুহ (“আলো ‘কমে’ আসিতেছে”, ৩-৭)। অতীতে রাজনীতির পরিসরে বিবেকবান চিন্তকদের উল্লেখযোগ্য ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি, যা জরুরি ছিল এই সময়ে। গণতন্ত্রের পরিসর বিপজ্জনক ভাবে সঙ্কুচিত হয়ে আসছে, সরকারকে প্রশ্ন করলেই চিহ্নিত হতে হচ্ছে দেশদ্রোহী হিসেবে। ফাদার স্ট্যান স্বামীর মৃত্যু এই আলো ‘কমে’ আসার আর-এক নিদর্শন, লেখকের আশঙ্কার যথার্থতা প্রমাণ হয়ে গেল বড় দ্রুত। এই দুর্গতির সময়ে অতীতকে স্মরণ না করলে নিজেদের অধঃপতনকে কী ভাবে পরিমাপ করব আমরা? এক সময়ে ভারতের সংসদীয় রাজনীতিতে স্থান পেতেন বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, ভাষাতাত্ত্বিক, শিল্পী, অধ্যাপক-সহ নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্ট মানুষ। তাঁদের চিন্তা ও বিবেচনায় পুষ্ট হত আমাদের গণতন্ত্র। বর্তমানে নীতিবোধ ও জ্ঞানচর্চার পরিসর থেকে রাজনীতিকে সার্বিক ভাবে বিচ্ছিন্ন করার পরিণতি আমাদের চার পাশের অন্ধকারকে গাঢ় করছে। রাজ্যসভায় প্রকৃত জ্ঞানীর অভাব অনেক দিন ধরেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিদ্যাচর্চার মানুষেরা পরিণত হয়েছেন অপরিচিত ছায়ায়, ভাষার অবনতি যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। আমাদের উত্তরণের হদিস হয়তো এখনই মিলবে না, তবে বিবেকের সামনে দাঁড়াতে গেলে আমাদের অতীতকে স্মরণ করা প্রয়োজন। অতীতের প্রাসঙ্গিকতা মনে রাখলে তবেই বর্তমান সম্পর্কে আমাদের বোধ গভীর হয়। মুক্ত জ্ঞানচর্চার অন্যতম প্রতিনিধি চিন্ময় গুহ এই জরুরি কাজটিই করেছেন তাঁর প্রবন্ধে। এই সঙ্কটকালে তাঁর মতো চিন্তকের বলিষ্ঠ ও সময়োচিত সত্যভাষণ যদি রাজনীতিকেরা শোনেন, আখেরে অসীম উপকার হবে আমাদের।
সৌমিক বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা-১৫১
পণ্ডিতের ভয়ে
চিন্ময় গুহ যথার্থই বলেছেন, “আসলে চিন্তা ও চিন্তকদের মধ্যেই সর্বনাশ দেখে এই সাম্প্রতিক সমাজ-রাজনীতি।” আজ ভারতে পরিকল্পিত ভাবে স্বনামধন্য চিন্তাবিদদের তীব্র আক্রমণ করা হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদতে। তাঁদের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে কুরুচিকর মন্তব্য করা হচ্ছে। উদ্দেশ্য, তাঁদের সম্পর্কে মানুষের মনে যাতে একটা অশ্রদ্ধার ভাব গড়ে ওঠে, তাঁদের দর্শন, চিন্তাধারা, মতামত সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে না পারে। উদয়ন পণ্ডিতদের ছাত্ররা যত বেশি জানবে, তত কম মানবে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রত্যক্ষ মদতে বেড়ে উঠছে মধ্য ও নিম্ন মেধার প্রাধান্য। ছাত্রদের এক সভায় দেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং উন্নত জ্ঞানচর্চায় উৎসাহ না দিয়ে, কী ভাবে পরীক্ষায় বেশি নম্বর পাওয়া যাবে, সেই সম্পর্কে পরামর্শ দেন। বিশ্ববন্দিত ব্যক্তিত্বদের ব্যঙ্গ করে বলা হচ্ছে, ‘হার্ভার্ড নয়, চাই হার্ড ওয়ার্ক’। অর্থাৎ, চিন্তাশীল হওয়ার দরকার নেই, দরকার শুধু দক্ষতার। যথেচ্ছ অপব্যবহারে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি আজ সর্বসাধারণের ব্যঙ্গবিদ্রুপের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শাসকের লক্ষ্য এক প্রতিবাদহীন অনুগত সমাজ গড়ে তোলা। তাই যে কোনও প্রশ্নেই সে শঙ্কিত হয়ে পড়ছে, প্রশ্নকারীকে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’, ‘মাওবাদী’, ‘আরবান নকশাল’ তকমায়, নির্বিচারে গ্রেফতার করা হচ্ছে মিথ্যা অভিযোগে। উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের জিগিরে ঢাকতে হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে শাসকের ব্যর্থতা। গণতন্ত্রের আড়ালে প্রকাশ পাচ্ছে স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব। এই দুর্দিনে যাঁরা দিশা দেখাতে পারতেন, তাঁদের প্রতিনিয়ত অসম্মান করা হচ্ছে। তাই “আলো ‘কমে’ আসিতেছে”।
প্রসঙ্গত মনে পড়ছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটেনের যোগ দেওয়ার সময় সে দেশের বিদেশ দফতরের সচিব স্যর এডওয়ার্ড গ্রে তাঁর এক বন্ধুকে লিখেছিলেন, “দ্য ল্যাম্পস আর গোয়িং আউট অল ওভার ইউরোপ, উই উইল নট সি দেম লিট এগেন ইন আওয়ার লাইফটাইম।” আমরা যারা প্রবীণ মানুষ, আমরাও কি জীবদ্দশায় এক আলোকোজ্জ্বল ভারতকে দেখে যেতে পারব না?
আত্রেয়ী মিত্র
কলকাতা-১০৬
আঁধার
চিন্ময় গুহর প্রবন্ধটি চিন্তার দিক উন্মুক্ত করে দেয়। মনে হয়, ‘সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা’ প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে কিছুটা করা সম্ভব উচ্চশিক্ষার পথ বেছে নিলে, যা কিনা স্নাতকোত্তর পর্যায় থেকে শুরু। বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষার যা পরিবেশ (ইউজিসি নেট জেআরএফ ফেলোশিপ প্রদানের পরিমাণ এক ধাক্কায় ১৫% থেকে কমিয়ে ৬% করা, অনিয়মিত ফেলোশিপ, সর্বোপরি চাকরির অপ্রতুলতা এবং নিয়োগে দুর্নীতি), তা কেরিয়ারের উপযোগী উচ্চশিক্ষার পথও প্রশস্ত করে না। আবার, দেশের উচ্চমানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিবাদী গবেষকদের, যারা দেশের প্রকৃত সম্পদ, গুরুতর অপরাধী বলে তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কেউ যদি তাঁর নিজস্ব জ্ঞানচর্চার আগ্রহ এবং পরিসরটি বাঁচিয়ে রাখতে পারেন, তাঁর জুটবে শুধুই উপেক্ষা।
বার বার শিক্ষানীতির পরিবর্তন হলেও ভোটবাক্সে প্রিয় হয়ে থাকার তাগিদে কোনও রাজনৈতিক দলই শিক্ষার মান উন্নয়নের চেষ্টা করে না। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় অকৃতকার্য হওয়াই দুঃসাধ্য। তাই বহু ছাত্রছাত্রীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাদের শ্রেণি-উপযোগী জ্ঞানটুকুও নেই। যে দেশে শিক্ষার ভিত এত নড়বড়ে, এবং উচ্চশিক্ষার এমন শোচনীয় অবস্থা, সে দেশে প্রকৃত চিন্তকদের কণ্ঠস্বর যে ক্রমশ হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে, এ আর বেশি কথা কী!
ইমন মণ্ডল
হাওড়া
উত্তরে গ্রন্থাগার
উত্তরবঙ্গের জন্য একটি কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের প্রয়োজন উপলব্ধি করি। এখনও উত্তরবঙ্গের কোনও সন্তান সংসদে অথবা বিধানসভায় এ নিয়ে সদর্থক প্রস্তাব উপস্থাপন করেননি। ১৯৬২ সালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর বয়ে গিয়েছে কয়েক দশক। এখন উত্তরবঙ্গবাসী একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়-সহ সাতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামো নিয়ে শ্লাঘাবোধ করতেই পারেন। কিন্তু চিন্তার সার্বিক পরিসর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর বাইরে একটি জাতীয় গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিমেয়। এখনও এক জন গবেষক একটি সম্পূর্ণ গবেষণাপত্র রচনার জন্য কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র এবং কলেজ স্ট্রিট যাওয়াটা নিয়তি হিসেবেই মেনে নেন। ‘রিডিং মেকেথ আ ফুল ম্যান’, ফ্রান্সিস বেকনের এই কথাটি প্রবন্ধে উদ্ধৃত হয়েছে। সে দিক থেকে দেখলে জাতীয় গ্রন্থাগারের অভাবে উত্তরবঙ্গবাসী ঊনমানবই থেকে গেল।
দীপক বর্মন
বাংলা বিভাগ, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়
অপূরণীয় ক্ষতি
দীর্ঘ দিন বিজ্ঞানের প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস সম্পূর্ণ বন্ধ থাকার অপূরণীয় ক্ষতি এক জন বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। আমাদের কলেজের গ্রন্থাগারের কয়েক হাজার বই অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে ছাত্রছাত্রীদের অনেকের পক্ষে বিজ্ঞানের দামি পাঠ্যপুস্তক কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এই পরিস্থিতিতে তারা বাধ্য হয়ে ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক নোট সংগ্রহ করছে, যা কখনও পাঠ্যপুস্তকের বিকল্প হতে পারে না।
যে ছাত্রছাত্রীরা প্রথম সিমেস্টারে ভর্তি হয়েছে, তাদের সঙ্গে সরাসরি পরিচিত হওয়ার সুযোগ আমরা পাইনি। পরিচিতির পুরোটাই সীমাবদ্ধ অনলাইনে। তাই তাদের অভ্যন্তরীণ মূল্যায়ন করা খুবই সমস্যা হয়ে পড়েছে। অনলাইনে সবাই স্বচ্ছন্দ না হওয়ায় মেধা ঠিক ভাবে যাচাইয়ের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। অনলাইন ক্লাসে বিজ্ঞানের জটিল গণনা ছাত্রদের বোঝানোও অসুবিধাজনক।
সন্দীপ দে
কলকাতা-১২২