সম্পাদক সমীপেষু: বাংলা ছবি ও ধূমপান

শুধু নায়করা নন, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে চরিত্রাভিনেতারাও ধূম্র উদ্‌গিরণ করেছেন। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, বিকাশ রায় কারণে-অকারণে সিগারেট, চুরুট, পাইপ হাতে তুলে নিয়েছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০১৮ ০১:০০
Share:

নিরন্তর গবেষণা ও প্রচারের ফলে আজ আমরা জানি যে ধূমপানের চেয়ে পরিমিত মদ্যপান শ্রেয়। ট্রেনের কামরায় গুছিয়ে বসে একটা সিগারেট ধরানো— এ অতি সাধারণ দৃশ্য ছিল এই সে দিনও। আজ এ দৃশ্য বিরল। কিন্তু আমরা ‘নায়ক’ (ছবিতে একটি দৃশ্য) সিনেমায় দেখি, দরজা-জানলা-বন্ধ এসি কামরায় মহিলা, শিশু, বৃদ্ধদের সহযাত্রী নায়ক অরিন্দম ধূমপান করে চলেন। অন্যের অসুবিধার কথা তাঁর মনে হয় না। সহযাত্রীরাও কোনও অনুযোগ করেন না। এমনকি সুন্দরী সহযাত্রিণী সাংবাদিকের সঙ্গে বসেও তাঁর ধূমপান অব্যাহত। সহযাত্রিণী হাত দিয়ে ধোঁয়া সরিয়ে দিচ্ছেন বটে কিন্তু বিরক্ত হচ্ছেন না বা প্রতিবাদ করছেন না। এর কারণ সেই একই। ধূমপান এত ক্ষতিকর সে দিন এটা জানা ছিল না। সত্যজিৎও সে দিন এটা জানতেন না। তাই শুধু ‘ফেলুদা’ নয়, সত্যজিতের সব ছবিতেই চরিত্ররা ধূম্রবিলাসী।

Advertisement

শুধু নায়করা নন, পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে চরিত্রাভিনেতারাও ধূম্র উদ্‌গিরণ করেছেন। ছবি বিশ্বাস, পাহাড়ি সান্যাল, কমল মিত্র, বিকাশ রায় কারণে-অকারণে সিগারেট, চুরুট, পাইপ হাতে তুলে নিয়েছেন।

কিন্তু তখনকার হিন্দি ছবিতে ধূমপান অপেক্ষাকৃত কম। নায়করা পর্দায় কিছু ধূমপান করতেন বটে, কিন্তু সাধারণ ভাবে বিরহ বা হতাশা প্রকাশ করতেই তা করতেন এবং চূড়ান্ত অবস্থায় মদের গেলাসে চুমুক দিতেন। মোটামুটি ভাবে বলা চলে, বাংলা ছবিতে যেখানে স্মার্টনেস, স্টাইল, ব্যক্তিত্ব, আধুনিকতা, রোমান্টিকতা, আভিজাত্য বোঝাতে ধূমপান করানো হত, হিন্দি ছবিতে পর্দায় ধূমপান করতেন হতাশ বা নেগেটিভ চরিত্রেরা।

Advertisement

উপরোক্ত সিদ্ধান্তের সমর্থনে একটি ছবির কথা বলি, যেটি একই পরিচালক নির্মিত বাংলা ও হিন্দি ছবি। অসিত সেন নির্মিত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি অবলম্বনে, ‘দীপ জ্বেলে যাই’ ও ‘খামোশী’। ছবি দু’টিতে হাসপাতালের অধ্যক্ষ-চিকিৎসকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন যথাক্রমে পাহাড়ি সান্যাল ও নাজ়ির হুসেন। বাংলা ছবিতে পাহাড়ি সান্যাল নিজের চেম্বারে, ওয়ার্ডে, অন্য ডাক্তার নার্সদের সঙ্গে আলোচনারত অবস্থায় সর্ব ক্ষণ ধূমপান করছেন। অন্য দিকে হিন্দি ছবিটিতে, নাজ়ির হুসেনের হাতে একটি পাইপ দেখা গেলেও তাতে কখনও অগ্নিসংযোগ করা হয় না।

বর্তমানে এক ঝাঁক তরুণ পরিচালকের হাত ধরে বুদ্ধিদীপ্ত ও বাণিজ্যিক বাংলা ছবি তৈরি হচ্ছে। শিক্ষিত দর্শক আবার হলমুখো হচ্ছেন। কিন্তু এই ছবিগুলো দেখে মনে হয়, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সিনেমার পর্দায় ধূমপান নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা বোধ হয় বাংলা ছবির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। হিন্দি ছবিতে যখন ধূমপান কমছে, বাংলা ছবিতে বাড়ছে। শুধু তা-ই নয়, মহিলা চরিত্রেরা কোনও প্রয়োজন ছাড়াই ধূমপান করছেন। ‘শুভ মহরত’ ছবিতে নন্দিতা দাশ কেন প্রতিটি দৃশ্যে ধূমপান করেন তা বোধগম্য হয় না। চরিত্রটি শিক্ষিতা, আধুনিকা এবং স্বাধীনচেতা— তা বোঝানোর জন্যে আর কোনও ট্রিটমেন্ট কি পরিচালকের জানা ছিল না?

ঠাকুর রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘‘থেটার লোকশিক্ষে দেয়’’। উৎপল দত্ত ‘বাবা তারকনাথ’ সিনেমাকে অপসংস্কৃতি বলেছিলেন, কারণ সিনেমাটি সাপে-কাটা রোগীকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়ার শিক্ষা দেয় না। লোকশিক্ষার দায় যদি বাংলা সিনেমা না-ও নিতে চায়, কুশিক্ষা দেয় কেন?

ত্রিদিবেশ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীরামপুর, হুগলি

খইনির নেশা

‘খইনি বন্ধের ভাবনা বিহারে’ (১০-৬) শীর্ষক সংবাদের প্রেক্ষিতে জানাই, সম্প্রতি এ রাজ্যেও বাসেট্রামে বা বাজারে, এমনকি ভিড়ের মধ্যেও, খইনি খাওয়ার প্রবণতা বেশ বেড়ে গিয়েছে। গুটখা, পানপরাগ ইত্যাদি তামাকজাত সামগ্রী ব্যবহারের অপকারিতা সম্বন্ধে প্রচার মাঝে মাঝে শোনা যায়। গণপরিবহণে বা প্রকাশ্য জায়গায় ধূমপানও নিষিদ্ধ। খইনিও তামাকজাত নেশার সামগ্রী ব্যতীত কিছু নয়। বাসে বা ট্রামের মধ্যে হাতে ডলে বা দুই হাতের সশব্দ চাপড়ে খইনি তৈরির ঝাঁঝে অনেকেরই অসুবিধা হয়, শ্বাসকষ্টের রোগীদের তো বটেই। কিন্তু নেশায় মত্ত ব্যক্তিরা ভ্রুক্ষেপও করেন না, সহযাত্রী বা সহ-নাগরিকের আপত্তি সত্ত্বেও। বরং ওই খইনির ভাগ কখনও কখনও ড্রাইভার/কন্ডাক্টর বা সম-রুচিসম্পন্ন কোনও যাত্রীকে বিতরণ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।

ধূমপায়ীরা বাসে বা ট্রামে ওঠার সময় হয়তো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসমাপ্ত জ্বলন্ত সিগারেট ফেলে দিয়ে গাড়িতে ওঠেন, কিন্তু খইনি-নেশাগ্রস্তরা নৈব নৈব চ।

এই সব নেশা দূর করার ব্যাপারে বিহার সরকার সক্রিয় হলেও, আমাদের রাজ্য সরকার এ ব্যাপারে এখনও উদাসীন। বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবস পালন করলেও, পরিবেশবিদ-স্বাস্থ্যবিদ বা সমাজসেবী সংস্থারাও খইনির নেশামুক্তির ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় নন। কিন্তু তা হলে, তামাকজাত দ্রব্যের নেশার অপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতার জন্য প্রচার অর্থহীন নয় কি? অন্তত ট্রামেবাসে বা প্রকাশ্য স্থানে খইনি কি নিষিদ্ধ করা যায় না?

রত্না রায় কলকাতা-৪৭

কিসে আর কিসে

অর্জুন সেনগুপ্ত ‘জরুরি নয়’ (৩০-৫) শিরোনামে চিঠিতে লিখেছেন: ‘‘১৯৬৮ সালের ফরাসি দেশের ছাত্র বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান দাবিটি ছিল মেয়েদের হস্টেলে ছেলেদের ঢোকার দাবি।’’ এই উদ্ভট তথ্য তিনি কোথায় পেলেন? ইতিহাস বলছে, এ রকম দাবি নিয়ে একটি ছাত্র বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল ১৯৬৭ সালের ১৬ মার্চ, সেই দাবির কাছে কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন নতি স্বীকার করে এবং সেখানেই এই ‘বিদ্রোহ’-এর শেষ। ১৯৬৮-র মে মাসের দুনিয়া কাঁপানো ফরাসি ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে ’৬৭-র ওই আন্দোলনের কোনও সম্পর্ক আছে কি?

’৬৮-র এই স্বতঃস্ফূর্ত অতিবাম ছাত্র আন্দোলন দাবানলের মতো সমগ্র সমাজে, বিশেষত কলকারখানার লক্ষ লক্ষ শ্রমিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একে দ্বিতীয় ফরাসি বিপ্লব বললে ভুল হবে না। নোবেল-ত্যাগী জাঁ পল সার্ত্র-র মতো র‌্যাডিকাল মার্ক্সবাদী, মিশেল ফুকো-র মতো ফরাসি সমাজতান্ত্রিক এই আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে ছাত্রদের সমর্থনে বলেন, ‘‘...হিংসা, স্বতঃস্ফূর্ততা, এবং নৈতিকতা, মাওবাদী তরুণদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের প্রাথমিক বৈশিষ্ট্য।’’

বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার জাঁ লুক গোদার বা ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো (যাঁরা ঘোষিত যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী) এই ছাত্রদের সমর্থনে ‘কান’ চলচ্চিত্র উৎসব বন্ধ করতে সমর্থ হন। বার্ট্রান্ড রাসেল-সহ দুনিয়ার যুদ্ধবিরোধী মনীষী ও শিল্পীরা এর সমর্থন করেন। সত্যজিতের ‘গুপী’ এর পরই গাইবেন— ‘‘যুদ্ধ করে করবি কী তা বল’’? এই ঐতিহাসিক বিদ্রোহের সঙ্গে সাম্প্রতিক কলকাতার ‘হোক চুম্বন’, ‘হোক আলিঙ্গন’ রূপ তামাশার তুলনা করে অর্জুনবাবু যুগপৎ কৌতুক ও ক্রোধের উদ্রেক করেছেন বললে ভুল হবে কি?

প্রসঙ্গত, ঠিক এর আগে-পরে, আমেরিকার আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রতিবাদে, বিভিন্ন দেশে একনায়কতন্ত্রের, এবং স্তালিনোত্তর সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার কদাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র বিশ্বে ছাত্র আন্দোলনের জোয়ার সামাজিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। খোদ আমেরিকার সিভিল রাইটস মুভমেন্ট— ব্ল্যাক প্যান্থার পার্টি; উত্তর আয়ারল্যান্ডে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন; মেক্সিকোতে Tlatelolco Massacre; মিলিটারি রাজের বিরুদ্ধে ব্রাজ়িলে গেরিলা যুদ্ধ; চেকোশ্লোভাকিয়াতে ‘প্রাগ স্প্রিং’; যুগোস্লাভিয়াতে টিটো-বিরোধী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন; আর এই বাংলায় ‘প্রেসিডেন্সি কলেজ’ আন্দোলন যা পরবর্তীতে নকশালবাড়ি বিদ্রোহের মূল স্রোতে মিশে সারা ভারতবর্ষ কাঁপিয়ে দেয়।

আন্দোলন যাঁরা করেছেন তাঁদের সব স্বপ্ন পূরণ হয়নি এটা রূঢ় সত্য, ভুলত্রুটিও ছিল। কিন্তু এগুলিকে ‘অরাজনৈতিক’ আন্দোলনের ছাপ দেওয়া যায় না।

স্বরাজ চট্টোপাধ্যায় কলকাতা-৯৬

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।

ই-মেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement