Sabitri Roy

সম্পাদক সমীপেষু: কাহিনির বিস্তার

গারো পাহাড়ের পাদমূলে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাজং, ডালু, বানাই প্রভৃতি জনজাতির মানুষ এবং সব ধরনের কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি হয়েছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ অগস্ট ২০২৪ ০৬:৪৪
Share:

‘নিঃশব্দ জেদে বেঁচে থাকা’ (২০-৭) প্রবন্ধে জয়া মিত্র পরাধীন ভারত ও স্বাধীন ভারতের সন্ধিক্ষণে আবির্ভূত সাহিত্যিক উপন্যাসিক সাবিত্রী রায় প্রসঙ্গে বলেছেন, তাঁর “উপন্যাসের প্রধান বৈশিষ্ট্য বোধ হয় তাঁর চোখে-দেখা ব্যক্তিচরিত্রগুলোর সমকালীন সামাজিক-ঐতিহাসিক ঘটনাবলির অংশ হয়ে যাওয়া।” তাঁর আটটি উপন্যাসের মধ্যে বিশেষত পাকা ধানের গান অবশ্যই এক অনবদ্য এবং ব্যতিক্রমী সৃষ্টি। এ প্রসঙ্গে দু’চার কথা। ১৯৫৬-১৯৫৮— এই তিন বছরে তিন খণ্ডে প্রকাশিত হয় সমগ্র উপন্যাসটি। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ছ’শো পাতার এই উপন্যাস। নাটক বা উপন্যাসে অবশ্যই এক প্রধান চরিত্র থাকে। তার কাজেই তৈরি হয় মূল দ্বন্দ্ব। তাকে ঘিরেই অন্যান্য চরিত্র ও ঘটনা আসে। চরিত্র যখন অসংখ্য হয়ে যায় তখন একের সঙ্গে অন্যদের সম্পর্ক তৈরি করা এবং বজায় রাখা; এ ছাড়া মূল চরিত্র ও ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখা দুরূহ কাজ। অথচ, অত বড় উপন্যাসে সাবিত্রী সেটাই অনায়াসে এবং সফল ভাবে করেছেন। বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে অর্থাৎ ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি উপন্যাসের কাহিনির গোড়াপত্তন। ক্রমে ক্রমে এসেছে যুদ্ধ, সাধারণ মানুষের নানা দুর্গতি, কালোবাজারে যুক্ত মানুষজন এবং সেই সঙ্গে প্রতিরোধে এসেছে বিপ্লবী আন্দোলন। এই ভাবে নানা ঘটনার বিন্যাস করতে করতে চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

গারো পাহাড়ের পাদমূলে এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে হাজং, ডালু, বানাই প্রভৃতি জনজাতির মানুষ এবং সব ধরনের কৃষকদের সক্রিয় অংশগ্রহণে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে উপন্যাসের সমাপ্তি হয়েছে। দরিদ্র মানুষ অভিজাত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মিলিটারি, স্বদেশের মানুষ বিদেশের মানুষ— এমন সব শ্রেণির মানুষই কাহিনিতে চরিত্র হিসাবে হাজির হয়ে ব্যাপ্ত মহিমার পটভূমিকায় এই উপন্যাস রচিত হয়েছে। সেই কারণেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই উপন্যাসকে মহাকাব্যিক (এপিক) উপন্যাস হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। মহিলা উপন্যাসিক হিসাবে সেই সময়কালে অনেকেই কলম ধরেছেন ঠিকই, কিন্তু প্রচলিত রোম্যান্টিকতা, নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত অধিকারের দ্বন্দ্ব, কুসংস্কার— এই সমস্ত বিষয়ের বাইরে সমসাময়িক রাজনীতি ও সামাজিক সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে চরিত্রায়ন করার ক্ষমতা একমাত্র সাবিত্রী রায়ই দেখাতে পেরেছিলেন।

প্রবীর চক্রবর্তী, গোচারণ, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

Advertisement

প্রত্যয়ে দৃঢ়

ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার তাঁকে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন ‘সাম্যবাদিনী’ লেখিকা হিসাবেই। অন্য দিকে, জয়া মিত্রের কথায় তিনি ছিলেন ‘সময়ের পটুয়া’। তিনি সাবিত্রী রায়, এক অবিস্মরণীয় লেখিকা। তাঁর প্রথম উপন্যাস সৃজন প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ বঙ্গাব্দে। ত্রিস্রোতা প্রায় একই সময়। এর পর আসে স্বরলিপি, মালশ্রী, পাকা ধানের গান, মেঘনা পদ্মা, সমুদ্রের ঢেউ, ঘাসফুল ও বদ্বীপ। একটি মাত্র গল্পগ্রন্থ নূতন কিছু নয় প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। এ ছাড়াও লেখেন নীল চিঠির ঝাঁপি (১৯৮০)। তিন বছরের নাতির উদ্দেশে লেখা হলেও এতে রয়েছে রোজনামচা, স্কেচ, টুকরো কবিতা। কিশোর পাঠ্য হলদে ঝোরা ও শিশুপাঠ্য লেখার খেলা তিনিই লিখেছিলেন।

এত বিস্তৃত তাঁর লেখনী, অথচ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি কেউ নন! বাংলা সাহিত্যের কেতাবি আলোচনা গ্রন্থগুলোতে তিনি স্থান পাননি। বর্তমান প্রজন্মের পাঠকদের অনেকেই তাঁর নাম শোনেননি। এমনকি তাঁর নিজের দলেও অপাঙ্‌ক্তেয় ছিলেন তিনি। আপাদমস্তক কমিউনিস্ট ঘরানার মানুষ হয়েও পার্টির বিচ্যুতি চিহ্নিত করায় সাবিত্রী রায় পার্টির কর্ণধারদেরও বিরাগভাজন হয়েছিলেন। স্বরলিপি প্রকাশের পর পার্টি থেকে এই বই প্রত্যাহারের নির্দেশ আসে তাঁর কাছে। সম্মত হননি তিনি। বরং প্রতিবাদে পার্টি সভ্যপদ ত্যাগ করেন। এই প্রত্যয়ে দৃঢ় ছিলেন তিনি।

সাবিত্রী রায় প্রধানত ঔপন্যাসিক। লেখক হিসাবে তিনি এক বিরাট ক্যানভাস সৃষ্টি করতে ভালবাসতেন। তাঁর কাছে উপন্যাস কেবলমাত্র বড় গল্প নয়, বস্তুত নানা কাহিনি-উপকাহিনির সমাহার, যার মধ্যে রয়েছে রাজনীতির প্রশ্ন ও সামাজিক জিজ্ঞাসা। এ দিক থেকে তাঁকে রাজনৈতিক ঔপন্যাসিক বলাই যায়। মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িকতা, দেশভাগ, ক্লিষ্ট দারিদ্র, ওরা-আমরার পার্থক্য তাঁর লেখায় প্রভাব ফেলেছিল। কমিউনিস্ট মতাদর্শে স্থির থাকলেও পার্টির আমলাতান্ত্রিক কর্তৃত্ব ও পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্য তাঁকে ব্যথিত করেছে অবিরত।

পারিবারিক সম্পর্ক থেকে সামাজিক সম্পর্কের টানাপড়েনে যে ক্ষমতার কথা ‘নির্ণায়ক’ ভূমিকা নেয়, সে কথা কী ভাবে সাবিত্রী রায়ের লেখায় এসেছে, প্রবন্ধকার সে কথা বলেছেন। নারী-মন ধ্বস্ত হয় এক আনার চিরুনি থেকে চাঁদির টাকায়, ক্ষমতার দাপটে! সাবিত্রীর নানা গল্প, উপন্যাসে যা এসেছে। প্রগতিশীলতার ভণ্ডামি কী ভাবে খোলস ছাড়ায় কফি হাউসের টেবিলে, কিংবা একজোড়া দুল হারালে, তিনি তা দেখিয়েছেন ‘অন্তঃসলিলা’ ও ‘ওরা সব পারে’ গল্পে। তিনি খোঁজ করেছেন, বামপন্থী পরিবারেও কেন সামন্ততান্ত্রিক নারীভাবনা স্থান পায়, কেন পর্দার আড়ালে থাকা নারী পুরুষের সহযোদ্ধা হতে পারে না!

সাবিত্রী রায়ের ব্যক্তি জীবনের অভিজ্ঞতাই যেন উপন্যাস ও গল্পের চরিত্র সৃজনে উঠে এসেছে। সংসার সুখের করতে চাকরি ছাড়া, সন্তান পালন, অসুস্থতা, মতাদর্শগত বিরোধ— সবই কোনও না কোনও ভাবে প্রভাবিত করেছে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রদের। জিজ্ঞাসা যেন জারি থাকে, এই ছিল তাঁর সাহিত্য ভাবনার লক্ষ্য। নীল চিঠির ঝাঁপি-তে তিনি লেখেন, “কত কাল, কত দীর্ঘকাল আমার নিঃসঙ্গ ঘর থেকে রবীন্দ্র সংগীত হারিয়ে গেছে, হারিয়ে গিয়েছে মালকোশ, বাগেশ্রী, দরবারী কানাড়া।... বন্দিনী কিষাণীর মত আমি একা ঘরে ভীত চোখে চেয়ে দেখি বন্দীশালার সু-উচ্চ গাঁথনী।” বন্দিশালার গাঁথনি ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৯৮৫ সালে মৃত্যু তাঁকে ছিনিয়ে নিয়েছে এ লোক থেকে। এখনও সেই লড়াই যেন জারি আছে বদ্ধ খাঁচার পাখিটার।

প্রলয় চক্রবর্তী, কলকাতা-১২৪

নিঃসঙ্গ বার্ধক্য

একাকিত্ব— শুনতে ছোট্ট একটা শব্দ হলেও একরাশ শূন্যতা জমে রয়েছে তার মধ্যে। ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনে সফল অনেক প্রবীণ ব্যক্তিই একাকিত্বের মুখোমুখি হচ্ছেন। তাঁরা সেখানে নিরুপায়। তাঁদের ছেলেমেয়েরা কর্মসূত্রে বা বিবাহসূত্রে প্রবাসী। কেউ দু’বছরে এক বার আসে, আবার কেউ আসতেও পারে না। সীমিত ছুটিতে বাড়ি এলেও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছেলেমেয়েরা। আবার সুযোগ থাকলেও অনেকেই নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে যেতে চান না। অথচ, বাড়ির সবাইকে নিয়ে অতীতের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকেন। জড়িয়ে ধরে একাকিত্ব। সমীক্ষা বলছে, মধ্যবিত্ত পরিবারের ষাট কিংবা ষাটোর্ধ্বের ৬% একাই থাকেন, ২০% ছেলেমেয়ে ছাড়া দিন কাটান নিঃসঙ্গতাকে নিয়ে।

কর্মসংস্থান ও জীবনের তাগিদে অতীতের ‘পাড়ার ছেলে’ শব্দটিও অবলুপ্তপ্রায়। তবে বয়স্কদের নিঃসঙ্গতাকে উপলব্ধি করে শহরের কিছু জায়গায় গড়ে উঠেছে বেশ কিছু সংস্থা। বাজার করে দেওয়া থেকে শুরু করে তাঁদের সঙ্গে গল্প করা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, সবই এরা করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আগামী ছ’বছরের মধ্যে, বিশ্বের প্রতি ছ’জনে এক জনের বয়স ৬০ বা তার বেশি হবে। একাকিত্ব, সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় এঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি হবে। অন্তত ১৪% মানসিক ব্যাধি নিয়ে বেঁচে থাকবেন। তাই আগামী দিনে বয়স্কদের পাশে থাকার কাজ তৈরি করা হবে প্রশংসনীয় কর্মসংস্থান।

শুভজিৎ বসাক, কলকাতা-৫০

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement