‘ইফ ইউ ওয়ান্ট টু গো ফার গো টুগেদার’ যিনি বলেছিলেন, সেই রতন নভল টাটা আর আমাদের মধ্যে নেই। মুম্বইয়ের ওরলি শ্মশানে যে রকম ভিড় উপচে পড়েছিল, তাতে মনে হতে পারে তিনি যে কোনও প্রবল জনপ্রিয় মহাতারকার চেয়েও জনপ্রিয় ছিলেন। শুধুমাত্র বিজ়নেস ম্যাগনেট হিসাবে এত জনপ্রিয় হওয়া যায় না। তিনি ছিলেন ‘অন্য রকম’। তিনি ১৯ বছর বয়সে এফ-১৬ ফাইটার জেট ও বোয়িং এফ-১৮ সুপার হরনেট চালিয়েছেন। তিনিই আবার ৬৯ বছর বয়সে সেই এফ-১৬ ফাইটার জেট চালিয়েছেন, যা ভারতে প্রথম। পশুপ্রেমী হিসাবে তাঁর নাতির বয়সি যে ছেলেটির সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব হয়, তাঁর কাছ থেকে কম্পিউটারের যাবতীয় বিষয় শিখতে তিনি দ্বিধা করেননি। আমি তাঁকে এক জন দেশপ্রেমিক মনে করি। কারণ, আমাদের দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর গ্রামীণ ভারত নিয়ে তিনি যা চিন্তা করেছেন, যা দান করেছেন, তা এই মুহূর্তে ভারতের ধনীতমদের লজ্জায় ফেলবে। কর্পোরেট লেভেলে সামাজিক দায়িত্ববোধের প্রথম প্রবক্তা ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ টাটা গ্রুপের কাজের জন্যে তাঁকে ‘নাইট গ্র্যান্ড ক্রস’ পুরস্কার দেন। অস্ট্রেলিয়া সরকার তাঁকে সে দেশের সবচেয়ে বড় সিভিল পুরস্কার ‘অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া’ প্রদান করে।
আমাদের দেশে তিনি পদ্মবিভূষণ আগেই পেয়েছিলেন। মহারাষ্ট্র সরকার তাঁকে ‘উদ্যোগরত্ন’ পুরস্কার দেন ও কেন্দ্রের কাছে ভারতরত্নের জন্য সুপারিশ করে। এত পুরস্কারের পরেও তাঁর পা যে মাটিতে ছিল, তার প্রমাণ ‘ন্যানো’ গাড়ি। মধ্যবিত্তরা সাইকেল না চড়ে গাড়ি চড়বে— এই স্বপ্ন থেকেই এক লক্ষ টাকার ন্যানো গাড়ির জন্ম। যে মানুষটির স্বভাবই ছিল স্বপ্নের পিছনে ছোটা, তিনি কিন্তু এ বার হোঁচট খেলেন। তাঁর দোষ— তিনি ন্যানোর জন্মস্থান হিসাবে পশ্চিমবঙ্গকে বেছেছিলেন। আমাদের রাজ্যের কালিদাসরা অমনি দাঁত নখ বার করে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে আরম্ভ করলেন। তিনি বলেছিলেন— মাথায় পিস্তল ধরলেও আমি পিছু হটব না। কিন্তু বাংলার পিস্তলধারীরা আত্মহত্যার শামিল জেনেও শেষ পর্যন্ত পিস্তলের ট্রিগারটাই টেনে দিয়েছিলেন।
আমরা পুরনো বইটা আবার খুলে ধরলাম, যার নাম আত্মঘাতী বাঙালি।
রূপম মুখোপাধ্যায়, পাটুলি, কলকাতা
অভিভাবক
৯ অক্টোবর মা দুর্গার বোধনের দিনেই চলে গেলেন ভারতীয় মানসে ‘আদর্শ পুঁজিপতি’ হিসাবে পরিচিত শ্রীরতন নভল টাটা। তিনি ছিলেন সদাচারী, মৃদুভাষী, এবং অসাধারণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ এক ঐতিহ্যের পরম্পরা। তিনি ক্ষমতার জৌলুস আর প্রাচুর্য থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন। তাঁর দায়িত্বজ্ঞান ও স্নেহশীলতা যে কতটা উচ্চপর্যায়ে ছিল, তার প্রমাণ পেয়েছি আমরা ২৬/১১-তে মুম্বইয়ে তাজ হোটেলে কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী হামলায় বিপদের সময় কর্মচারীদের পাশে অভিভাবকের মতো দাঁড়িয়ে তাঁদের মনোবল জোগানো এবং তাঁদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করায়। শিল্পের বাইরেও তিনি তাঁর কর্মযজ্ঞের সুফলকে সমস্ত শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন। দুর্ভাগ্য বঙ্গবাসীর! তিনি যে স্বপ্ন দেখেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্প শ্মশানটিকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে শিল্পের ভবিষ্যৎ রচনা করার, অর্থাৎ টাটা মোটরসের ‘ন্যানো’ কারখানা গড়ার, এবং এলাকার শিক্ষিত বেকারদের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখানোর, সেই শিল্পের স্বপ্ন ভেঙে গেল ২০০৮ সালে এক রাজনৈতিক আন্দোলনে, যা বঙ্গবাসীর কাছে চিরদিন ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই ঘটনার আড়াই বছর পর এ রাজ্যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হল, সেই শিল্প গড়ায় বাধা দেওয়া রাজনৈতিক দলটি রাজ্যে ক্ষমতায় এল। কিন্তু আজও বাংলার শিল্পের ভবিষ্যৎ পাল্টাল না।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
মানবদরদি
রতন টাটার মৃত্যু শিল্পক্ষেত্রে এক মহাদুর্যোগ। হাসিমুখ নিয়ে দেশবাসীর দিকে তিনি যে ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন আর এই দেশকে বড় করার চেষ্টা করেছেন, তা এক কথায় বলা অসম্ভব। বাণিজ্যের দিক থেকে এই দেশকে তিনি বেশি করে চিনিয়েছেন বিদেশের কাছে। শিল্পপতি হিসাবে তাঁর অবদান শুধু শিল্পে সীমাবদ্ধ হয়নি। সব দিক দিয়ে টাটা একটি আদর্শ মতবাদ নিয়ে মানুষকে ভালবাসতে শিখিয়েছেন। অর্থনীতি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞানমনস্কতা— সবেতেই ছিল তাঁর অবাধ চলন। বহু আশা করে পশ্চিমবঙ্গে সরকারের ডাকে সাড়া দিয়ে সিঙ্গুরে শিল্প গড়তে এসেছিলেন। সরকার জমি দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। বহু জমিদাতা স্বেচ্ছায় জমি দিতে চেয়েছিলেন। উপযুক্ত দাম, সন্তানদের চাকরি, অন্যান্য সুবিধা— সব শর্তে টাটা গোষ্ঠী রাজি হয়েছিল বিরাট কারখানা তৈরি করতে এবং পশ্চিমবঙ্গে একক ভাবে শিল্পের গোড়াপত্তন করতে। কিন্তু কে বা কাদের প্ররোচনায় শিল্পে সক্রিয় রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পুরো বিষয়টিকে ঘেঁটে দেওয়া হল। রাজনীতির ফাঁসে পা গলিয়ে আমরা নিজের ক্ষতি করে ফেলেছিলাম। বুকভরা যন্ত্রণা নিয়ে রতন টাটা চলে গিয়েছিলেন। ভারতের মানুষকে আঘাত কোনও দিন করেনি টাটারা।
টাটার মুম্বইয়ের তাজ হোটেলে সন্ত্রাসবাদী হানায় ত্রিশিরেও বেশি কর্মচারী নিহত হন এবং পঞ্চাশের কাছাকাছি কর্মচারী ভয়ঙ্কর ভাবে আহত হন। শোকস্তব্ধ হয়েছিলেন রতন টাটা। শুধুমাত্র নিজেদের হোটেলের নিহত কর্মচারীদের পরিবার এবং আহত কর্মচারীদের অর্থনৈতিক সাহায্য করেননি, অন্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দিকেও তিনি এবং তাঁর গোষ্ঠী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, যা ভোলার নয়। রতন টাটার মৃত্যু ব্যথিত করেছে দেশের শিল্পে উৎসাহী সমস্ত মানুষকে। আমরা বিস্মিত, হতাশ এবং অসহায় এই মানবদরদির চলে যাওয়ায়।
সমীর চক্রবর্তী, রামরাজাতলা, হাওড়া
প্রতারণা চক্র
ভারতে দৈনিক প্রতি দশ জনের মধ্যে ছ’জন গড়ে তিনটি করে স্প্যাম কল পান। ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১২ লক্ষ ভারতীয় প্রতারণামূলক কল ও মেসেজ পেয়েছেন। ৪৯% ভারতীয় এআই পরিচালিত প্রতারণার শিকার হয়েছেন। ২০২৪-এর গোড়ার দিকেই ভারতীয়দের ১,৭৫০ কোটির বেশি টাকা লুট হয়েছে সাইবার প্রতারণার ফলে। প্রযুক্তির যত উন্নতি ঘটছে, আমরা সবাই যত অনলাইন পেমেন্টে অভ্যস্ত হচ্ছি, ফোন ও ইন্টারনেটের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, তত নতুন নতুন প্রতারণা আসছে আমাদের চোখে। বর্তমানে ইন্টারনেট ফিশিং প্রতারণার মাধ্যমে প্রতারকরা সুপ্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইট সেজে মানুষের কাছ থেকে জরুরি তথ্য চুরি করে অ্যাকাউন্ট থেকে সর্বস্ব হাতিয়ে নিচ্ছে। টাকা আদায়ের প্রতারণা নানা ধরনের হয়ে থাকে। যেমন— কেওয়াইসি ও ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আপডেট, ফোনের সিম, এটিএম কার্ড, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন কেটে দেওয়ার বার্তা, ভুয়ো কলে কাস্টমস দ্বারা পার্সেল আটক করার খবর, ডেটিং অ্যাপ ও সরাসরি হোয়াটসঅ্যাপ কলের দ্বারা অশ্লীল ভিডিয়ো প্রদর্শন করে ব্ল্যাকমেল করা, এমনকি ‘আমি ভারতীয় টেলিকম মন্ত্রণালয় থেকে বলছি’— এইরূপ ভুয়ো কলও আসতে শোনা গেছে। এ ব্যাপারে প্রতারকরা এআই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে থাকে। কয়েক বছর আগে আমরা সবাই জামতাড়া গ্যাং-এর কথা শুনেছি। তবে এখন এই রকম আরও প্রতারণার চক্র সারা ভারতে সক্রিয়।
খুব সম্প্রতি আগরায় একটি এমন ভুয়ো কল আসে এক মায়ের কাছে। তাঁর মেয়ের আপত্তিকর ছবি ও ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল করে দেওয়ার হুমকি ও টাকা আদায়ের দাবি-সহ। মেয়েটির মা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অবিলম্বে এই বিষয়গুলি নিয়ে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার সতর্ক না হলে এক বিরাট সংখ্যক মানুষ ক্ষতির মুখে পড়তে পারেন।
বিপ্লব চৌধুরী, আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান