Spirituality and Science

সম্পাদক সমীপেষু: বিজ্ঞান ও ধর্মবিশ্বাস

শুভঙ্করবাবু বলেছেন, সালাম বলতেন ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রেরণা পেয়ে বিজ্ঞানের আবিষ্কার করেছেন। আর ধর্মবিশ্বাস কোন প্রেরণায় মানুষের মনে এসেছিল? কোনও কোনও বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২৩ ০৭:৫০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

শুভঙ্কর ঘোষের ‘ধর্মবিশ্বাস কি বিজ্ঞানবিরোধী’ (২২-৯) একটি বিশ্বজনীন প্রশ্ন। কয়েক জন বিজ্ঞানীর ব্যক্তিগত মতামতের মধ্য দিয়ে সেই উত্তর খোঁজা অর্থহীন। ধর্মবিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে আলোচনার প্রয়োজন।

Advertisement

ভারতীয় গণিতজ্ঞ রামানুজন নাকি বলেছিলেন, “গণিতের কঠিনতম সমীকরণ ও অন্যান্য ধারণা নামগিরি দেবী তাঁর কানে বলে গেছেন স্বপ্নের মধ্যে।” প্রবন্ধকার বলছেন, তেমনটা আদৌ হতে পারে কি না, সে অনুসন্ধান নিষ্প্রয়োজন। আবার বলছেন, রামানুজনের প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন এক ঘোর নাস্তিক গণিতজ্ঞ। এক নাস্তিক, এক ঈশ্বর-বিশ্বাসী বিজ্ঞানীর অবদানকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরলে প্রমাণ হয় ধর্মবিশ্বাস বিজ্ঞানবিরোধী নয়? নাস্তিক বিজ্ঞানী কি বিশ্বের দরবারে নামগিরি দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করেছিলেন, না রামানুজনের গণিতের তত্ত্ব? প্রবন্ধের উপসংহারে রয়েছে, রামানুজনের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে গণিত শাস্ত্রের অবদানের কোনও সম্পর্ক নেই, বিরোধ নেই, সঙ্গতিও নেই। ব্যক্তিগত বিশ্বাসের আলোচনা বিশ্বজনীন প্রশ্নের আলোচনায় কেন? বলা যায় কি সকল বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণের সঙ্গে ধর্মবিশ্বাসের বিরোধ হয়নি?

গালিলেওর পৃথিবীর সূর্য প্রদক্ষিণ সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ আর তৎকালীন ধর্মবিশ্বাস বিরোধহীন ছিল? ডারউইনের বিবর্তনবাদ আর ধর্মীয় গ্রন্থের জীবসৃষ্টির ব্যাখ্যা বিরোধহীন? বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের তড়িৎদণ্ড ব্যবহার করে বজ্র প্রতিরোধ আর চার্চের সেই দণ্ড স্থাপনে অস্বীকার করাকে কি বিজ্ঞান বিরোধিতা বলা যায় না? চার্চ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, বজ্রপাতের দ্বারা ঈশ্বর পাপীদের সাজা দেন, ওই আবিষ্কার ঈশ্বরের কাজে বাধাদান করছে। বেঞ্জামিন বলছিলেন, তা হলে তো ঘরবাড়ি বানিয়ে ঝড়-বৃষ্টি থেকে রক্ষা পাওয়াও পাপকার্য? বেঞ্জামিন ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন, তবুও সামাজিক ধর্মবিশ্বাসের
বিজ্ঞান বিরোধিতায় তিক্ত মন্তব্য করেছিলেন। গালিলেও এবং ডারউইনও ব্যক্তিগত স্তরে ঈশ্বর অবিশ্বাসী ছিলেন, এমন শোনা যায়নি। কিন্তু তাঁদের বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কার সামাজিক ধর্মবিশ্বাসের বিরোধিতাই করেছিল। এ রকম আরও উদাহরণ আছে। বলা যায়, ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিজ্ঞান বিরোধিতার ঘটনা ঐতিহাসিক।

Advertisement

শুভঙ্করবাবু বলেছেন, সালাম বলতেন ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রেরণা পেয়ে বিজ্ঞানের আবিষ্কার করেছেন। আর ধর্মবিশ্বাস কোন প্রেরণায় মানুষের মনে এসেছিল? কোনও কোনও বিজ্ঞান তার অনুসন্ধান করে। ইসরোর প্রধান, রামানুজন, সি ভি রমন, আবদুস সালাম ধর্মীয় বিশ্বাস ও বিজ্ঞান মিলিয়ে যা যা বলেছেন, তা ব্যক্তিগত মতামতমাত্র, জ্ঞান নয়। ব্যক্তিগত মতামতের ভিত্তিতে ধর্মবিশ্বাস বিজ্ঞান বিরোধী কি না তা বলা সম্ভব নয়, বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকেই। বিজ্ঞানের ইতিহাস থেকে জানতে হবে, জানতে হবে অনেকগুলো বিজ্ঞান বিষয়ের সাহায্যে, ধর্মতত্ত্ব বিষয়ক বই থেকে তথ্য সংগ্রহ করা যাবে, কিন্তু বিশ্বাসটুকু বাদ রেখে। প্রাক্-ইতিহাস, ভূতত্ত্ববিদ্যা, জীববিদ্যা, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব, জীবাশ্ম বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞানের সাহায্যে ধর্মবিশ্বাসের শিকড় খুঁজতে হবে। শুভঙ্করবাবু বলছেন, বহু উচ্চমার্গের বিজ্ঞানী ব্যক্তিগত জীবনে ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন, তাই ধর্মবিশ্বাস বিজ্ঞানবিরোধী নয়। ডারউইনের অরিজিন অব স্পিসিস গ্রন্থে ঈশ্বর দ্বারা জীবসৃষ্টির কথা লেখা নেই, রামানুজনের অঙ্কের গবেষণাপত্রেও নামগিরি দেবী দিয়ে সমীকরণ প্রমাণ করা নেই। বিশ্বাস করলেও লেখেননি। কেন? সেটুকুই ধর্মপুস্তক আর বিজ্ঞান পুস্তকের তফাত, যা সকল বিজ্ঞানীকেই করতে হয়।

শান্তনু গুহ, কলকাতা-১৯

বিস্মৃত নারী

বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যুগান্তকারী বহু আবিষ্কারে নারীদের ভূমিকা ও অবদান গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু পুরুষ অধ্যুষিত বিজ্ঞানের জগতে এই অনন্য কীর্তিস্থাপনকারীদের অনেকেই তাঁদের লব্ধকীর্তির স্বীকৃতি পাননি। বহু ক্ষেত্রে মহিলা হওয়ার জন্য তাঁদের কৃতিত্ব অস্বীকার করে সেই সাফল্যের দাবিদার হয়েছেন সহযোগী পুরুষ গবেষক। অমর্যাদা ও লাঞ্ছনা সহ্য না-করতে পেরে অনেককেই সরে যেতে হয়েছে গবেষণার জগৎ থেকে। বিস্মৃতির অন্ধকারে হারিয়ে গিয়েছেন অনেক মেধাবী নারী।

সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রী, এমনকি প্রাপ্তবয়স্ক অনেক নারী-পুরুষকে বিশ্ববন্দিত তিন জন বিজ্ঞানীর নাম জিজ্ঞেস করলে, সাধারণত নিউটন ও আইনস্টাইনের বাইরে আর কোনও নাম থাকে না। মহিলা বিজ্ঞানীর নাম জিজ্ঞেস করলে, মেরি কুরি ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনও নাম শোনা যাবে না। বিশেষত, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে কোনও ভারতীয় কৃতী মহিলার নাম জিজ্ঞেস করলে প্রায় কেউই বলতে পারে না। আজও বেশির ভাগ বিজ্ঞান পড়ুয়া কসমিক রে নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের গবেষণা করা বিভা চৌধুরী কিংবা এশিয়ার প্রথম মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ইলা মজুমদারের নাম শোনেনি। ভারতের প্রথম উদ্ভিদবিজ্ঞানী (মহিলা) জানকী আম্মাল, পুষ্টিবিজ্ঞানী কমলা ভাগবত সোহনি, প্রযুক্তিবিজ্ঞানী রাজেশ্বরী চট্টোপাধ্যায় কিংবা পদার্থবিজ্ঞানী পূর্ণিমা সিংহের নাম আমরা ক’জনই বা শুনেছি? আজও কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি পড়ুয়াদের অনেকেই লিজ়ে মাইটনার, ডরোথি হজকিন, রোজ়ালিন্ড ফ্র্যাঙ্কলিন, বারবারা ম্যাক্লিনটক, ভেরা কুপার রুবিন প্রমুখের নাম শোনেনি।

ভারতের মতো অনেক দেশে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি বা গণিতকে শুধু পুরুষদের পড়ার ক্ষেত্র হিসাবে ভাবা হয়। একটা সময় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দরজা মেয়েদের জন্য বন্ধ ছিল দশকের পর দশক। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণাকেন্দ্র থেকে শুরু করে কাজের জগতে আজও লিঙ্গবৈষম্যের ছবি প্রকট। এই সব বাঁধাধরা বঞ্চনা আর বৈষম্যের পাঁচিল ভেঙে এগিয়ে যাওয়ার পথ করে নিতে হয়েছে মেয়েদের। এই কারণেই এক জন নারী রোল মডেলকে নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার সঙ্গে সহজে মেলাতে পারে এক জন মেয়ে। ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর সাইকোলজিস্ট এবং সোশ্যাল সাইকোলজির অধ্যাপক পেনেলোপি লকউড-সহ আরও কয়েক জনের গবেষণা থেকেও উঠে এসেছে এই সত্য। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একাধিক নোবেলজয়ী মহিলাও আত্মকথায় তাঁদের পূর্বসূরি বিজ্ঞানীর (মহিলা) অনুপ্রেরণার কথা উল্লেখ করেছেন। দুর্ভাগ্য, আমাদের পাঠ্যক্রমে বিজ্ঞানে বিশ্ববন্দিত মহিলাদের জীবন ও অবদানের কোনও উল্লেখ থাকে না। কী কঠিন বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে, পুরুষ অধ্যুষিত বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে অসীম জেদ, মেধা আর অক্লান্ত কৌতূহলী মনকে সঙ্গী করে সাফল্যের এক-একটি ধাপ পেরোতে হয় তাঁদের। এই সব লড়াইয়ের কথা না জানলে কী করেই বা স্বপ্ন দেখতে শিখবে ওরা?

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও গণিত ক্ষেত্রে মহিলাদের কৃতিত্ব ও অবদান সম্পর্কে এই প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ২০০৯ সাল থেকে একটি আন্তর্জাতিক দিন উদ্‌যাপন করা হয়— ‘আডা লাভলেস ডে’, প্রত্যেক বছর অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার। এ বছর সেই বিশেষ দিনটি পড়েছে ১০ অক্টোবর। কম্পিউটারের অন্যতম পথিকৃৎ গণিতবিদ অগাস্টা আডা লাভলেস ছিলেন ভিক্টোরিয়ান ইতিহাসে এক বিরল প্রতিভা। তাঁর ছিল না কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। খ্যাতনামা গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ মেরি সামারভেলির কাছে তাঁর গণিত শিক্ষা, মেন্টর হিসাবে পেয়েছিলেন স্বনামধন্য গণিতজ্ঞ চার্লস ব্যাবেজকে। ব্যাবেজ উদ্ভাবিত অ্যানালিটিক্যাল ইঞ্জিনের সঙ্কেত, ফর্মুলা, নিয়ম, লজিক ইত্যাদি বহু জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণ করার ক্ষমতার সম্ভাবনা আডাই প্রথম বুঝেছিলেন, কম্পিউটার আসার একশো বছরেরও বেশি আগে। আডার সুদূরপ্রসারী ভাবনাই আজকের ডিজিটাল যুগ শুরুর প্রস্তরফলক। এই বিশেষ দিনটি তাই বিজ্ঞান-প্রযুক্তি এবং গণিতের ছাত্রী এবং মহিলা গবেষকদের সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে শপথ নেওয়ার দিন।

সিদ্ধার্থ মজুমদার কলকাতা-৩১

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement