অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায় ‘যদি শিখতে চাইতাম’ (৬-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে বলেছেন, “এক দিকে আদিবাসী মানুষের অধিকার হরণ, অন্য দিকে ‘প্রথম নাগরিক’-এর ভূমিকায় আদিবাসী মানুষের আবির্ভাব— এই দুই ঘটনার পারস্পরিক বিরোধ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক কথা হয়েছে।” সত্যিই তো, অনেক কথা হয়েছে। প্রত্যেকটা দিন কোথাও না কোথাও আমরা পড়ে থাকি আদিবাসী সম্প্রদায়ের দুঃখের কথা। কী ভাবে তাঁরা জীবনযাপন করছেন, জঙ্গলকে কী ভাবে এখনও লড়াই করে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন, সে সব কথা পাতার পর পাতা লেখা হচ্ছেই। তাতে কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পেরিয়ে এসেও কি শুধুই কাগজের পাতাতেই আদিবাসীদের মর্মান্তিক দুঃখ-দুর্দশার কথা লেখা হবে? উত্তর— হ্যাঁ, লেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকবে। যাঁরা তৈরি করেছেন জঙ্গল, তাঁদেরই আজকে বেঁচে থাকার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে। তাঁদের কষ্টের কথা রাজ্য সরকার বা কেন্দ্র সরকার কেউ ভাবে না। ভাবে না বলেই তো আদিবাসীদের আগলে-রাখা জঙ্গল মাইলের পর মাইল কেটে ফেলা হচ্ছে। বিতাড়িত করা হচ্ছে আদিবাসীদের। আকাশের নীচে আশ্রয় নিতে হচ্ছে তাঁদের। আমরা সবাই জানি বীরভূমের ডেউচা পাঁচামির ঘটনা। সেখানে উন্নয়নের নামে আদিবাসীদের জোর করে গ্রামের পর গ্রাম উচ্ছেদ করা হচ্ছে। একই ভাবে পুরুলিয়ার ঠুরগা এলাকায় উন্নয়নকে সামনে রেখে জঙ্গল কাটা হচ্ছে। এ সব ঘটনা সবার চোখের সামনে ঘটছে, কিন্তু সবাই দেখেও দেখছেন না। দেখলে এই ভাবে আদিবাসীদের অত্যাচারিত হতে হত না। আদিবাসীদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, এ ভাবেই কি উন্নয়ন আসে? তাঁরা বলবেন, “বছরের পর বছর এটাই তো হয়ে আসছে!”
জঙ্গল কেটে উন্নয়নের কথা যদি আমরা ভাবি, তা হলে আমাদের মতো মূর্খ আর কেউ হতে পারে না। প্রকৃতির উপরে অত্যাচার করলে প্রকৃতি সুদে-আসলে ফিরিয়ে দেবেই।
রাজীব মুর্মু, বাঁকাদহ, বাঁকুড়া
প্রকৃত শিক্ষা
অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়ের ‘যদি শিখতে চাইতাম’ প্রবন্ধটি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই প্রাসঙ্গিক। আমরা আজকের আধুনিক যুগের মানুষরা শিক্ষা বা জ্ঞান নিয়ে যে গর্ব করি, তা অত্যন্ত ঠুনকো। ভারতীয় সভ্যতার প্রাণপুরুষ আদিবাসী মানুষরা। অথচ, তাঁরাই এ দেশে চরম অবহেলিত। যে প্রকৃতিকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ পুজো করেন, তাকে রক্ষা করার জন্য তাঁরা সব সময়ই সচেষ্ট থাকেন। আর আজ সেই প্রকৃতিকেই ধ্বংস করে চলেছি আমরা। আদিবাসীরা জানেন, যে প্রকৃতির জন্য আমরা এখনও টিকে আছি, তাকে বিনাশ করা মানে নিজেরই ক্ষতি করা। অথচ, এই সহজ সত্য কথাটা ‘শিক্ষিত’ শহুরে মানুষরা বুঝতে পারছেন না।
সম্প্রতি একটি বাংলা পত্রিকায় আদিবাসীদের উপর বিশেষ সংখ্যায় বিখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, তথা ভারতের সামাজিক আন্দোলনের অন্যতম অগ্রপথিক জঁ দ্রেজ় লিখেছেন, মানবসভ্যতা নিজেকে ধ্বংসের কিনারায় এনে ফেলেছে। পারমাণবিক যুদ্ধ, অতিমারি, জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বব্যাপী আর্থিক বিপর্যয় ইত্যাদি ঘটনাসমূহ নানা ভাবে আমাদের শেষের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এর থেকে বাঁচতে আমরা যদি বিশ্ব জুড়ে সমবায় ও সংহতির সংস্কৃতি তৈরি করতে চাই, তা হলে আদিবাসীদের জীবনধারা থেকেই শিক্ষা নিতে হবে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
আইনের ফাঁদ
‘যদি শিখতে চাইতাম’ শীর্ষক প্রবন্ধ বিষয়ে কিছু বক্তব্য সংযোজন করতে চাই। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে স্বাধীনতার পর কংগ্রেস রাজত্ব, তার পরে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার, প্রত্যেকেই বনবাসীদের উচ্ছেদ করার জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করে চলেছে। ব্রিটিশরা অরণ্যের উপর দখল নেওয়ার জন্য ১৮৬৫ সালে বনবিভাগ তৈরি করেছিল। ১৮৭৮ সালে দেশে প্রথম অরণ্য আইন চালু হয়। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার সরাসরি অরণ্যগুলোকে ‘সংরক্ষিত অরণ্য’ বলে ঘোষণা করে। এই সময় থেকেই অরণ্যের উপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীগুলোর যে স্বাভাবিক অধিকার ছিল, তা খর্ব হতে শুরু করে। ১৮৭৮ সালের অরণ্য আইনের প্রতিবাদ করার মধ্য দিয়েই বিরসা মুন্ডার ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের হাতেখড়ি। ১৮৯৫-১৯০০ সাল পর্যন্ত ছোটনাগপুর এলাকা জুড়ে বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে গড়ে-ওঠা আন্দোলনের ফসল হিসেবে ১৯০৮ সালে ছোটনাগপুর টেনান্সি অ্যাক্ট চালু হয়েছিল। স্বাধীন ভারতে ১৯৪৯ সালে ‘সাঁওতাল পরগনা টেনান্সি অ্যাক্ট’ তৈরি হয়েছিল।
কিন্তু স্বাধীন ভারতেও আদিবাসীদের অরণ্যের অধিকার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির কোনও পরিবর্তন হয়নি। ১৯৫২ সালের অরণ্য নীতিতে অরণ্যের উপর অরণ্যবাসীদের অধিকারের প্রশ্নটিকে আমলই দেওয়া হয়নি। ১৯৫৩ সাল থেকে জমিদার ও ভূস্বামীদের এবং দেশীয় রাজ্যগুলোর অধিকারে থাকা জঙ্গলগুলো অধিগ্ৰহণ করে, সরকারি জঙ্গলে পরিণত করা হয়। ১৯৭২ সালে তৈরি হয় বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইন। তাতেও আদিবাসী ও বনবাসীদের কথা বিশেষ উল্লেখ নেই। ১৯৮০ সালে তৈরি হল বন (সংরক্ষণ) আইন। এই আইনেও বনবাসীদের কথা উল্লেখ করা হল না। ১৯৮৮ সালে রিজ়ার্ভ ফরেস্ট অ্যাক্ট চালু হওয়ার ফলে দেশের প্রায় এক কোটি আদিবাসী ও বনবাসী মানুষ উচ্ছেদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২০০২ সালে বাজপেয়ী সরকার জঙ্গলের জমিতে বংশ-পরম্পরায় বসবাসকারীদের দখলকারী আখ্যা দিয়ে উচ্ছেদের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। তার ফলে এক কোটিরও বেশি আদিবাসী ও বনবাসীদের উচ্ছেদের বিপদ দেখা দিয়েছিল।
এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ হওয়ায় ২০০৩-এ প্রাক্তন বিচারপতি বিএন কৃপালের নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল ফরেস্ট কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশনের সুপারিশ ক্রমে ২০০৬-এ তৈরি হয় ‘ফরেস্ট রাইট অ্যাক্ট’। তাতে বলা হয়েছিল, ২০০৫-এর ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত যাঁরা জঙ্গলে বসবাস করছেন বা চাষবাস করে জীবিকা নির্বাহ করছেন, তাঁরা এই জমির পাট্টা পাওয়ার যোগ্য। এই আইন অনুসারে, বনের পাট্টা পাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গে যত আবেদন জমা পড়েছিল, তার মধ্যে ৮৬,১৪৪টি আবেদন বাতিল করা হয়। ১৬টি রাজ্যে ২০১৮ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪২ লক্ষ আবেদন জমা পড়েছিল, তার মধ্যে ১৯.৩ লক্ষ আবেদন বাতিল হয়। প্রায় ১৯ লক্ষ মানুষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হন বা জীবিকা হারানোর সম্মুখীন হয়ে পড়েন। আদিবাসীদের জমির মালিকানার সাংবিধানিক রক্ষাকবচ রাজ্যগুলিতে আইন থাকা সত্ত্বেও উচ্ছেদ হওয়া আদিবাসীদের সংখ্যা প্রায় দু’কোটি।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বন ও পরিবেশ মন্ত্রক গত জুনে ‘বন সংরক্ষণ ২০২২’ নামে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। এই বিজ্ঞপ্তির ফলে গ্রামসভার অনুমতি ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার জঙ্গলের জমি বেসরকারি বৃহৎ শিল্পগোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে পারবে। তাতে অরণ্যবাসী মানুষের অরণ্যের অধিকার রক্ষিত হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজ্য সরকারের বলে দায় এড়িয়ে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় সরকার। বন সংরক্ষণ বিধি ২০২২ আদিবাসী ও বনবাসী মানুষদের কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল। এই নিয়ম কার্যকর হলে বহু আদিবাসী এবং বনবাসী পরিবার উচ্ছেদ হবে। অথচ, এঁদের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্বটুকু রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করবে না। সুতরাং, অবিলম্বে প্রতিবাদ এবং আন্দোলন গড়ে তুলে এই বিধি বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করতে হবে। তবেই রক্ষা পাবে আদিবাসী ও বনবাসীদের জীবন-জীবিকার অধিকার।
রাসমোহন দত্ত, মছলন্দপুর, উত্তর ২৪ পরগনা