ঈশানী দত্ত রায়ের ‘শিক্ষাপ্রহসন ও গিনিপিগেরা’ (১৮-১০) শীর্ষক প্রবন্ধটির সব তথ্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করতে পারছি না। শহর ও শহরতলির সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয় আজ অর্ধমৃত বা মৃত, তা আমিও স্বীকার করি। আসলে যে দিন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা বেসরকারিকরণ হতে শুরু করল, সে দিন থেকে শিক্ষা পণ্য হয়ে উঠল। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে প্রি-নার্সারিতে ভর্তি করিয়েও নানান অভিযোগ অভিভাবককে শুনতে হয়। যেন এটা অভিভাবকদের প্রাপ্য। প্রতিযোগিতার ইঁদুরদৌড়ে টিকিয়ে রাখতে তাই সন্তানের শৈশবকে নির্মম ভাবে হত্যা করছি আমরা সকলে মিলে। শিশুর খেলার মাঠ নেই, স্কুলে পাঠানো টিফিনে বন্ধুদের ভাগ নেই, শীতে কুঁকড়ে থাকা বন্ধুটিকে নিজের চাদরের অংশে ঢেকে দেওয়া নেই। আছে অর্থ ও বৈভব দেখে বন্ধু পাতানোর রেওয়াজ। এ সব নিয়ে আমরা গর্ব করি এই একবিংশ শতকেও।
মধ্যযুগে অভয়ামঙ্গল কাব্যের নায়ক শৈব ধনপতি সওদাগর সিংহল রাজের কারাগারে বন্দি হন দেবী চণ্ডীর ছলনায়। ধনপতি সওদাগরের পত্নী খুল্লনার গর্ভজাত সন্তান শ্রীমন্ত। পাঠশালায় বিদ্যার্জনকালে গুরুমশাই তার পিতৃপরিচয় ব্যঙ্গের সঙ্গে জানতে চাইলে তাকে সহপাঠীদের হাসাহাসি শুনতে হয়। সহপাঠী, সমাজ থেকে গুরুমশাইয়ের হাতে নাকাল হওয়ার সেই মধ্যযুগীয় বর্বরতার ইতিহাস সমানে চলেছে আজও।
রাজ্য মানেই শহর বা শহরতলি হতে পারে না। গ্রামের কচিকাঁচাদের ভিড়ে-ঠাসা স্কুলগুলোতে এখনও যত্নের সঙ্গে হয়তো কিছু সহৃদয় মাস্টারমশাই-দিদিমণিরা পাঠদান করেন। তবে শিকড়ের টানে যখন যাই গাঁয়ে, তখন দেখি স্কুলগুলোতে সর্বসাকুল্যে দু’এক জন শিক্ষক-শিক্ষিকায় ঠেকেছে। তবুও প্রত্যেক দিন নিয়ম করে তাঁরা বিদ্যালয়ে পড়ানোর কাজটি করে চলেছেন।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
পণ্য নয়
‘শিক্ষাপ্রহসন ও গিনিপিগেরা’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, কমিকস, শিশু সাহিত্য, কিশোর উপন্যাস, গল্পের কাল আজ অতীত। সেই জায়গা আস্তে আস্তে দখল করেছে স্মার্টফোন, ভিডিয়ো গেম— হরেক রকমের আধুনিক গ্যাজেট। শৈশব চুরির দায় কি কেবলই সরকারের? পিতামাতা কেন পারছেন না তাঁদের সন্তানদের সামাজিক মূল্যবোধ শেখাতে? “প্রত্যেকে আমরা পরের তরে” এই শিক্ষা স্কুল-কলেজ দেয় না, ঘরের পরিবেশেই গড়ে তুলতে হয়। সেখানে পিতামাতা সন্তানদের টিফিন ভাগ করে খেতে নিষেধ করছেন, সহপাঠীর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার শিক্ষা দিচ্ছেন। এই শিশুরাই দেশের নাগরিক হবে। সহমর্মিতা, সহনশীলতা ইত্যাদি মানবিক গুণরহিত সমাজই কি আমরা চাই?
প্রায় প্রতিটি গণমাধ্যম জুড়ে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন প্রলুব্ধ করে নাগরিক সমাজকে। মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাওয়া এই শিক্ষাব্যবস্থার বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারছি কই? শিক্ষা পণ্য নয়, ভিক্ষাও নয়, দেশের মানোন্নয়নের পক্ষে একটি অত্যাবশ্যক উপাদান। ক্রমাগত সেই শিক্ষার বিষয়টি যদি উচ্চবিত্তের হাতে পড়ে পণ্যের রূপ পরিগ্রহ করে, তবে ধ্বস্ত হয় শিক্ষা। দায়বদ্ধতা শুধু সরকারের নয়, দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিকের। খুব সহজেই এমন অবস্থার পরিবর্তন হবে, এমনটা আশা করি না। তবে নতুন করে আবার ভাবনা ও চেতনার শিখাকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে তো যেতেই পারি।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
কথার বোঝা
‘এই সময়ে জন্মালে লেখাপড়া শেখা আর হয়ে উঠত না’ ভেবে যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঈশানী দত্ত রায়, তা অমূলক নয়। সকলেই জানে, এ রাজ্যের বেশির ভাগ মানুষের ‘ক্যাপিটেশন ফি’ দিয়ে বেসরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করানোর ক্ষমতা নেই। ফলে ধনীর সন্তানের জন্য এক রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়ে গিয়েছে। বাকিদের জন্য থাকছে নড়বড়ে সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা। এখানে মেধা বিচার্য বিষয় নয়। আর্থিক সামর্থ্যটাই সর্বাগ্রে বিবেচ্য। আর্থিক ভাবে সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা ‘প্রি-স্কুল’ থেকে দৌড় শুরু করে, ‘কোটা ফ্যাক্টরি’তে গিয়ে সেই দৌড় শেষ করে। ব্যর্থতা আর হতাশার মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে, মাঝ পথে কত প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটল, তার হিসাব কেউ রাখেন না। রাখলে, গিনিপিগদের ‘থেরাপিস্টের কাছে যাওয়া’ অনেকটাই আটকানো যেত।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুদের নিজস্ব জগতে বিচরণ করার সুযোগটুকু কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মনে এক বৃহৎ কল্পনার জগৎ রয়েছে। সেখানে ডানা মেলে ওড়ার সুযোগটাই ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে। ‘কাগজের প্লেন’ আকাশে ওড়ানো, কাগজের নৌকা জলে ভাসানো কিংবা কাগজের চরকা তৈরি করে হাতে নিয়ে দৌড়ানোর মনটাকে আমরা বড়রা দায়িত্ব নিয়ে মেরে ফেলছি। ছোটদের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে তোলার সুযোগটুকুও দিচ্ছি না। খেলার মাঠে বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে হুটোপুটি করার দিন প্রায় শেষ। আত্মীয়স্বজন, তুতো ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে মেলামেশাও বন্ধ। আছে কেবল স্কুল, গৃহশিক্ষক আর মোবাইল ফোন। মা-বাবারা যে জগৎ দেখাচ্ছেন, ছোটরা সে জগৎটাকেই চিনছে। আবেগতাড়িত বাবা-মায়েরা শিশু শিক্ষাপদ্ধতি ও শিশু মন বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না। পেলে বহু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হত। অধিকাংশ বাবা-মা প্রতিবেশীর পরামর্শ নিয়ে, বা তাকে অনুসরণ করে সন্তানের পড়াশোনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন। কোন স্কুলে পড়বে, কী বই পড়বে, কোন ভাষায় পড়বে, এ সবই এখন বাবা-মায়ের ইচ্ছাধীন। গোটাটাই নম্বরমুখী পড়াশোনা। যে ভাবে পড়াশোনা করলে ভাষা এবং অন্যান্য বিষয়ের উপর দখল বাড়ে, সে ভাবে পড়াশোনা করানো হচ্ছে না।
ছোটরা জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে। প্রত্যেক সচেতন বাবা-মা পারেন, নিজ নিজ শিশুকে বয়স অনুযায়ী পারিপার্শ্বিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে। একটি শিশুকে স্কুলে প্রথম প্রবেশের সময়ে, কেন এমন অ্যাডমিশন টেস্ট-এর সম্মুখীন হতে হবে, যার জন্য তার অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন হবেন? শিশুর ব্যর্থতার জন্য তাকে সবার সামনে লজ্জা দেওয়া কি শিশু নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে না? শিশু যা শিখে স্কুলে এসেছে, তার পর থেকেই শিশুর শিক্ষা শুরু হওয়ার কথা। এখন দেখছি, যে স্কুলে যত কঠিন ভর্তির পরীক্ষা, সেই স্কুল তত ভাল, এমন একটা ধারণা বাজারে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা যেন পণ্য। শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের তোয়াক্কা না করে, পুঁথিকেন্দ্রিক এক অবৈজ্ঞানিক শিক্ষাব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘শিক্ষার হেরফের’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা বাল্য হইতে কৈশোর এবং কৈশোর হইতে যৌবনের প্রবেশ করি কেবল কতকগুলো কথার বোঝা টানিয়া। সরস্বতীর সাম্রাজ্যে কেবল মজুরি করিয়া মরি; পৃষ্ঠের মেরুদণ্ড বাঁকিয়া যায় এবং মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ হয় না।”
কিছু দিন আগেও মফস্সলের স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকারা শ্রেণিকক্ষে এমন ভাবে পড়া বুঝিয়ে দিতেন যে, গৃহশিক্ষকের প্রয়োজন হত না। সংখ্যায় কম হলেও, এখনও তেমন মাস্টারমশাই, দিদিমণিরা বিভিন্ন স্কুলে ছড়িয়ে রয়েছেন। তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের প্রাণ মন খুলে পড়ান। চন্দ্রযানের বিজ্ঞানীদের সাফল্যের মূল কারিগর তাঁরাই। ওই বিজ্ঞানীদের অনেকেই অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে উঠে আসা মেধাবী ছেলেমেয়ে। এ রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলিতে পড়াশোনা করে ওঁরা ওঁদের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সম্ভাবনার স্ফুরণ ঘটিয়েছেন। শিক্ষা জাতি গঠনের প্রধান শক্তি। একে অবহেলা করা আত্মহত্যার শামিল। রাজনৈতিক দল বা সরকার এ বিষয়ে কতটা সচেতন হয়ে এগিয়ে আসবে, সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। তবে সচেতন নাগরিক সমাজের চুপ করে বসে থাকাটা বিবেককে পীড়া দেয়।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা