আমপান প্রসঙ্গে উঠে এসেছে ১৭৩৭ সালের দুর্যোগের কথা। সাংবাদিক ও সাহিত্যিক শ্রীপান্থ তাঁর ‘কলকাতা’ বইতে সেই দুর্যোগের বর্ণনা দিয়েছেন। ১৭৩৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর যে প্রবল ঝড়, বৃষ্টি, ভূমিকম্প (মতান্তরে) হয়েছিল, তাতে সেন্ট অ্যানের গির্জা ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। গুঁড়িয়ে গিয়েছিল চিৎপুরের গোবিন্দ মিত্রের নবরত্ন। কাঁচা-পাকা বহু বাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে শহর যেন বিস্তীর্ণ মাঠে পরিণত হয়েছিল।
ইংল্যান্ডের ‘জেন্টলম্যান’স ম্যাগাজিন’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিহত মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩০ হাজার, পশুপাখি মারা গিয়েছিল অসংখ্য। ছোট-বড় জাহাজ নৌকা প্রভৃতি কুড়ি হাজার ধ্বংস হয়েছিল। পাঁচ টনের দু’খানা জাহাজ ছিটকে পড়েছিল নদীর বুক থেকে দুশো ফ্যাদম দূরে এক গ্রামের মধ্যে। হুগলি নদীর জলস্তর প্রায় ৪০ ফুট বেড়ে গিয়েছিল।
সেই সময়ের সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য স্যর ফ্রান্সিস রাসেল একটি চিঠিতে সেই তাণ্ডবের বর্ণনা দিয়েছেন, ‘‘বাতাসের বেগ এত তীব্র হয়েছিল সে দিন যে মনে হচ্ছিল যেন ছাদটা ভেঙে পড়বে আমাদের মাথায়। অবশেষে সকাল হল। শহরটার দিকে তাকালে মনে হয় শত্রুপক্ষ এসে যেন বেপরোয়া বোমা বর্ষণ করে গেছে এর উপর। আমাদের সুন্দর ছায়াচ্ছন্ন রাস্তাগুলোর দু’ধারে একটিও গাছ নেই। সব ছিন্নভিন্ন। গতকাল যা ছিল, আগামী কুড়ি বছরেও তেমনটি হবে না আর। নদীটি রূপ নিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রের। সারা নদী ধ্বংসস্তূপে বোঝাই।’’
পড়লে বোঝা যায় ঝড়ের তাণ্ডব কতটা ছিল। অনেক ক্ষেত্রে চেনা লাগে, মনে হয়, আমপানে তো আমরা এই চিত্রই দেখলাম। আমাদের কি এখন চতুর্দিকে উপড়ে থাকা গাছ দেখে মনে হচ্ছে না, শত্রুপক্ষ এসে তছনছ করে গিয়েছে সব? মনে হচ্ছে না, ‘‘গতকাল যা ছিল, আগামী কুড়ি বছরেও তেমনটি হবে না আর’’?
অভিজিৎ ঘোষ
কমলপুর, উত্তর ২৪ পরগনা
খাঁড়ার ঘা
করোনার আতঙ্কে এমনিতেই মানুষের জীবন-জীবিকার শোচনীয় অবস্থা। তার উপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা-এর মতো হুগলি জেলার সিঙ্গুর সহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় আমপান-এর দাপটে প্রায় সব কিছু ধূলিসাৎ হয়ে গেল। অসংখ্য বড় গাছ, বিদ্যুতের পোস্ট, বাড়ির অংশ ভেঙে বহু জায়গায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। সিঙ্গুর সহ পার্শ্ববর্তী বাগডাঙ্গা, নসিবপুর, হাকিমপুর ইত্যাদি বহু গ্রামে এই সময়ের আম, লিচু, জামরুল এবং কলা গাছের এবং জমির ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
বর্তমানে করোনার এই দুর্বিষহ পরিস্থিতিতে কৃষিভিত্তিক এলাকা হওয়ায় এই অঞ্চলের মানুষ ফসল চাষ করে, গাছের ফল বিক্রি করে অন্নবস্ত্রের অনেকটাই সংস্থান করছিলেন— এই ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় প্রায় সব কিছু শেষ করে দিল। এই ক্ষয়ক্ষতি সামলে নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ কবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবেন, জানা নেই।
তাপস দাস
সিঙ্গুর, হুগলি
সুন্দরবন
সমৃদ্ধি হয়তো ছিল না, তবু সুখে-দুঃখে এক রকম দিন কাটছিল সুন্দরবনের মানুষগুলোর। ২০০৯ সালের ২৫ মে সব কিছু তছনছ করে দিল। আয়লার তাণ্ডবে বহু মানুষ ভেসে গেলেন। অনেকের ঠাঁই হল ত্রাণ শিবিরে। বহু মানুষ ভিটেমাটি হারান। নোনা জলে উর্বরতা হারাল জমি। কৃষিজমি, মাছের ভেড়িতে নোনা জল ঢোকায় জীবিকা বদলাতে বাধ্য হন অনেকে, পাড়ি দেন ভিন রাজ্যে। মাটির বাঁধের অবস্থাও দফারফা হয়।
আবারও আকাশে মেঘের ঘনঘটা দেখে বুক কেঁপে উঠল মানুষের। ১১টা বছর শুধুই একটা সংখ্যা যেন। আমপানের আতঙ্ক ফিরতে চোখের সামনে ভেসে উঠল আয়লা ঝড়ের তাণ্ডবের কথা। মাঝে ফণী বা বুলবুল তেমন প্রভাব ফেলেনি। কিন্তু আমপান আয়লার থেকেও ভয়াবহ। আয়লা সুন্দরবনের মানচিত্র অনেকটাই ওলটপালট করে দিয়েছিল। বুধবার গদখালি, গোসাবা এলাকার মানুষের চোখমুখ থেকে করোনা-আতঙ্ক কার্যত উবে গিয়েছে। নতুন আতঙ্ক সে জায়গা নিয়েছে।
সৈকত রানা
বাবুপাড়া, জলপাইগুড়ি
শ্রমিকদের দাবি
সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, পশ্চিমবাংলার বহু শ্রমিক উপকৃত হয়েছেন। সরকারি আদেশনামা অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানে লকডাউন পর্যায়ে কর্মচারীদের বেতনও প্রদান হচ্ছে। তবুও বহু ক্ষেত্রে গভীর সমস্যা, সেগুলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
(১) সরকারি পরিবহণ শিল্পের স্থায়ী শ্রমিকরা লকডাউন পর্যায়ের বেতন পেলেও, কন্ট্র্যাক্ট এবং এজেন্সি শ্রমিকদের মধ্যে প্রায় শতাধিক শ্রমিক লকডাউন পর্যায়ে তাঁদের বেতন পাননি। এই শিল্পের কর্তৃপক্ষের বেআইনি কর্মকাণ্ডের কারণেই তাঁরা আজ বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনও আইনের তোয়াক্কা না করে, যখন-তখন যাঁকে ইচ্ছা কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়ার যে নিয়ম কর্তৃপক্ষ চালু করেছিল, তাতে আজ শতাধিক শ্রমিক তাঁদের পরিবার নিয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন।
(২) পশ্চিমবঙ্গের কলেজগুলির প্রায় পাঁচ হাজারের অধিক ক্যাজ়ুয়াল কর্মচারী বিভিন্ন কলেজে দীর্ঘ ৫/৭/১০ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। কলেজভিত্তিক গভর্নিং বডির মাধ্যমে এঁদের নিয়োগ করা হয়েছে। বেতনের কোনও নির্দিষ্ট কাঠামো না থাকায়, ২ হাজার থেকে ৮/১০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হয়। লকডাউন পর্যায়ে অনেক কলেজের কর্তৃপক্ষ এঁদের বেতনও দিচ্ছে না। অবিলম্বে এঁদের লকডাউন পর্যায়ের বেতন প্রদান করা হোক, এবং গেস্ট টিচারদেরও কলেজ গভর্নিং বডি নিয়োগ করলেও তাঁদের যেমন একটা বেতন কাঠামো আছে, সে রকম এঁদের জন্যও একটা বেতন কাঠামো চালু করা হোক।
(৩) রাজ্য সরকারের শ্রম দফতরের অধীনে প্রায় ৫ সহস্রাধিক কর্মী (SLO) বছরের পর বছর কাজ করে আসছেন। রাজ্যের বিভিন্ন কর্পোরেশন, পৌরসভা, পঞ্চায়েত এলাকার অসংগঠিত শ্রমিকদের কাছ থেকে সামাজিক সুরক্ষা যোজনার ২৫ টাকা সংগ্রহ করলে ২ টাকা কমিশন হিসাবে তাঁরা পেতেন। কিন্তু গত ১৯-৩ তারিখের সরকারি সার্কুলারের পরিপ্রেক্ষিতে সেই কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে ওই কর্মচারীদের প্রতিনিধিরা দেখা করে ডেপুটেশন দেন। শ্রমমন্ত্রী কর্মচারীদের আগামী দিনে নির্দিষ্ট কাজ এবং নির্দিষ্ট বেতন প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু আজও তার সমাধান হয়নি। ইতিমধ্যে লকডাউন পর্যায়ে এঁরা পরিবার পরিজন নিয়ে অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
(৪) বেসরকারি পরিবহণ শিল্পের হাজার হাজার শ্রমিক লকডাউন পর্যায়ে খাদ্য এবং আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। এঁদের অনেকের রেশন কার্ড নেই। আমাদের আবেদন, রেশন কার্ড না থাকলেও আগামী ছ’মাস সবাইকে বিনামূল্যে রেশন দেওয়া হোক এবং দশ হাজার টাকা করে দেওয়া হোক।
(৫) সরকারি নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বহু বেসরকারি সংস্থার কর্তৃপক্ষ তাদের শ্রমিক কর্মচারীদের লকডাউন পর্যায়ের বেতন দিচ্ছে না। বেতন প্রদান করার জন্য সরকারের হস্তক্ষেপ জরুরি।
(৬) স্ট্রিট হকার, রেল হকার, রিকশা চালক, ছোট দোকানদার তথা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষেরা আজ অসহায় এবং অভুক্ত অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। সকলকে বিনা পয়সায় রেশন ও আর্থিক সাহায্যের জন্য সরকারকে যত্নবান হতে হবে। ‘প্রচেষ্টা’ প্রকল্প আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত অফলাইন ও অনলাইনের মাধ্যমে চালু রাখা এবং অর্থের পরিমাণ ১০ হাজার টাকা করার আবেদন জানাচ্ছি
দিবাকর ভট্টাচার্য
রাজ্য সম্পাদক, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটি, এআইসিসিটিইউ
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।
ভ্রম সংশোধন
দীপেশ চক্রবর্তীর ‘উপড়ানো শিকড়ের ছবি’ (২৪-৫, পৃ ৪) উত্তর-সম্পাদকীয়ের শুরুতে ভুল করে লেখা হয়েছে ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্যোগের ঘোর ঘনঘটা’ উদ্ধৃতিটি গিরিশ ঘোষের। উদ্ধৃতিটি আসলে ‘বাংলার ভাগ্যাকাশে আজ দুর্য্যোগের ঘনঘটা’, এবং সেটি নাট্যকার শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌল্লা’ নাটক থেকে নেওয়া। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।