“‘ফেরা’র উপদেশ” (১২-৯) সম্পাদকীয় প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত দৃঢ় ভাবে রাজ্যবাসীর মনের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বা উদ্যোগে সারা বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের উৎসব যে ভাবে পালন করা হয়, তা সম্ভবত বিশ্বের কোথাও হয় না। যে শারদ উৎসবে ফেরার আবেদন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী করেছেন, সেই উৎসবও বিগত কয়েক বছর ধরে নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায়। প্রায় মাসাধিক কাল টানা কর্মসূচি থাকে এই উৎসবের। রেড রোডে কার্নিভ্যাল দিয়ে শেষ হয় সেই শারদ উৎসবের। তার অনুকরণে বহু অঞ্চলে কার্নিভ্যাল শুরু হয়ে গেছে। আর জি কর হাসপাতালে কর্মরত এক তরুণী চিকিৎসকের নৃশংস হত্যা ও তার পরবর্তী ঘটনাবলি মানুষের মনে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করায় সর্বস্তরের মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। এই প্রতিবাদীরা সকলেই সন্তান হারানো মা-বাবার পাশে দাঁড়িয়ে সুবিচারের প্রত্যাশী। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যবাসীকে উৎসবে ফেরার আবেদনের পরেও মানুষ প্রতিবাদী জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিগুলোর পক্ষে দাঁড়িয়ে তাঁদের মনোবল জুগিয়েছেন। সকলেই চান, নির্যাতিতা বিচার পাক, দুর্নীতি ও হুমকি-প্রথার অবসান হোক।
সমাজের সর্বস্তরের সংবেদনশীল মানুষেরা চাইছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিগুলো মেনে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এমন সুশৃঙ্খল পরিবেশ সৃষ্টি হোক, যাতে আর কোনও প্রতিভাবান চিকিৎসককে কর্মরত অবস্থায় নৃশংস ভাবে খুন হতে না হয়। এক তরুণী চিকিৎসকের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির যে প্যান্ডোরার বাক্স খুলে গিয়েছে, তা দেখে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হতবাক। হতবাক শাসক দলের বহু উচ্চ পদাধিকারীরও। তাঁরাও প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। সম্পাদকীয়তে সঠিক ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে বলা হয়েছে, একটি হত্যাকে কেন্দ্র করে কেন এই অভূতপূর্ব ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটল তা বোঝার চেষ্টা করুন। তা না হলে কি রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলিতে পুনরায় সিন্ডিকেট রাজ ও হুমকি-প্রথা কায়েম হওয়ার আশঙ্কা থেকে যাবে না?
মানুষ আগে নিজের মন থেকে সেই আশঙ্কা অন্তত কিছুটা দূর করে তবেই উৎসবে ফিরুক। সমাজে আনন্দের পরিবেশ না থাকলে, ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কি উৎসব পালন করা যায়?
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
অনুরোধের ছল
আর জি করে ঘটে যাওয়া নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে যে ভাবে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজের প্রতিটি স্তরে, সেটা বর্তমান রাজ্য সরকারের কাছে যেমন অস্বস্তির, তেমন অশনিসঙ্কেতও বটে। সেই অবস্থায় আমাদের মুখ্যমন্ত্রী আসন্ন দুর্গাপুজো উপলক্ষে মানুষকে উৎসবে ফেরার যে বার্তা দিয়েছিলেন, তা মোটেই ভাল ভাবে গ্রহণ করেননি সাধারণ মানুষ। “‘ফেরা’র উপদেশ” সম্পাদকীয়তে মুখ্যমন্ত্রীর এই বার্তাকে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ হিসেবে যে ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে, তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মুখ্যমন্ত্রী সাধারণ মানুষকে উৎসবে ফেরার জন্য উপদেশের সঙ্গে পুজো কমিটিগুলোর উদ্দেশেও তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন— যদি কোনও পুজো কমিটি রাজ্য সরকারের দেওয়া অনুদান নিতে অস্বীকার করে, খুব ভাল কথা; অনেকেই আবেদন করে অপেক্ষায় আছে, তাদের যেন সেই টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। এক প্রকার নির্দেশের সুরেই এ বার থেকে পুজোর থিমের প্রতি নজরদারি রাখার জন্য পুলিশকেও তিনি দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। অমানবিকতাকে যিনি অপছন্দ করেন, সেই সংবেদনশীল মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে এই ধরনের বার্তা কোনও শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষই প্রত্যাশা করেন না। তাই অনুরোধের ছলে উৎসব নিয়ে তাঁর সমস্ত বার্তা যে হুকুম বলেই মনে হয়, সেটা সঠিক ভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে।
অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন, দুর্গাপুজো উপলক্ষে বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসবের উপর অনেকের সারা বছরের উপার্জনের বেশির ভাগটাই নির্ভরশীল। তাই এই উৎসব বন্ধ হলে বা আড়ম্বরহীন হলে অনেকেই অসুবিধের মধ্যে পড়বেন। কিন্তু আন্দোলনরত নাগরিক সমাজ তো এক বারও পুজো বন্ধের আহ্বান জানায়নি। তা ছাড়া কোনও বিষয়ে অর্থ বরাদ্দ যখন প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে, তখন যে-ভাবে সরকার বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য অনুদানের সুযোগ করে দিয়েছে, পুজো কমিটিগুলোর জন্য অনুদান বিলির সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এ ক্ষেত্রেও পুজোর উপর নির্ভরশীল মানুষের জন্য প্রশাসন অনুদানের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। প্রশাসনের বিরুদ্ধেই যখন প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উঠছে, তখন এই অভিযোগ এড়িয়ে আন্দোলনের অভিমুখ রাজনৈতিক দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রয়াস মোটেই সমীচীন নয়। গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত একটা সরকারের বিরুদ্ধে সামগ্রিক ক্ষোভকে গুরুত্ব দিয়ে এবং সাধারণ মানুষের ব্যক্তিজীবনের উপর নজরদারি না করে, প্রকৃত অপরাধীদের মুখোশ খুলে দেওয়ার ব্যবস্থাই একমাত্র প্রকৃত রাজধর্ম।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
উৎসবহীন
“উৎসব তো আমরা রচনা করতে পারি নে, যদি সুযোগ হয় তবে উৎসব আমরা আবিষ্কার করতে পারি। সত্য যেখানেই সুন্দর হয়ে প্রকাশ পায় সেইখানেই উৎসব” (শান্তিনিকেতনে ৭ পৌষের উৎসব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করে কী প্রত্যক্ষ করছি আমরা? আসন্ন দুর্গোৎসব উপলক্ষে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারবাবুদের উদ্দেশে মুখ্যমন্ত্রীর বিনীত বার্তা, এক মাস তো তিনি আন্দোলন সহ্য করেছেন, আর নয়। এ বার উৎসবে ফেরার সময়।
পশ্চিমবঙ্গবাসী জানেন, উৎসব-প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় অবিরাম মেলা, খেলায় মেতে ওঠার আবেদন থাকে। সঙ্গীত-মেলা থেকে রবীন্দ্র জন্মোৎসব, কবিতা উৎসব, বইমেলা থেকে লিটল ম্যাগাজ়িন উৎসব, খাদ্য মেলা থেকে বাংলার তাঁতের হাট, হস্তশিল্প থেকে সবলা মেলা, এমনকি ইলিশ উৎসবও এখন স্বমহিমায় পালিত হয়। উৎসববিহীন রাজ্য অকল্পনীয়। সুতরাং, পুজোয় ‘ফেরা’র আবেদন তাঁর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া বলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে। কিন্তু, এক জন রাজ্য-প্রধানের পক্ষে কোন আবেদন সঙ্গত? স্মর্তব্য রবীন্দ্রনাথের গানের পঙ্ক্তি, “শাসনে যতই ঘেরো আছে বল দুর্বলেরও।” সাধারণ নাগরিক বিস্মিত, একটা নৃশংস ধর্ষণ এবং হত্যাকে ধামাচাপা দিতে প্রশাসন কেন এত তৎপর? কাদের আড়াল করতে চাইছে রাজ্য প্রশাসন?
ব্যবসা-বাণিজ্য, রুজি রোজগারের মহান আকর্ষণ, প্রবাসীর ঘরে ফেরার টান, সব সত্যি। বিক্রি-বাট্টার আশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে বড় দোকানদার, পুজোকেন্দ্রিক বিকিকিনির দিকে চেয়ে থাকেন। তবু কেন একটা ‘কিন্তু’ এসে বাতায়ন পথে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে? মন থেকে সাড়া না দিলে পুজোর বাজার জমে? শুধু নিউ মার্কেটের জনজোয়ার, শপিং কমপ্লেক্সের জনসমাগম দেখে তামাম বঙ্গ-চিত্র উদ্ঘাটিত হয় না। সমস্ত বঙ্গবাসীর মনের কথা, কিছুই ভাল লাগছে না, মন থেকে সাড়া মিলছে না। গান-ছবি আঁকা-লেখালিখি এমনকি আড্ডাতেও একই ছবি। বনগাঁ লোকালেও সেই একই আলোচনা। কোথায় সেই পাতাল রেলে ভ্রমণকারী বিশাল বিশাল ব্যাগবাহী পুজোর বাজার ফেরত পরিবার?
“বাহিরের দুঃখ শ্রাবণের ধারার মতো আমাদের মাথার উপর নিরন্তর বর্ষিত হইয়াছে, অহরহ এই দুঃখভোগের যে তামসিক অশুচিতা, আজ তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। তাহার প্রায়শ্চিত্ত কোথায়? নিজের মধ্যে নিজের ইচ্ছায় দুঃখকে বরণ করিয়া। সেই দুঃখই পবিত্র হোমাগ্নি, সেই আগুনে পাপ পুড়িবে, মূঢ়তা বাষ্প হইয়া উড়িয়া যাইবে, জড়তা ছাই হইয়া মাটিতে মিশাইবে...” (‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
তাই যেন হয়।
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী,কলকাতা-১২৫