Old People

সম্পাদক সমীপেষু: নিঃসঙ্গ জীবন

সামাজিক বলতে যে শুধু ঘরের বাইরের সমাজে তাঁরা কোণঠাসা, তা নয়। পরিবারের মধ্যেও তাঁদের কোণঠাসা হওয়ার বা বাড়তি বোঝা হওয়ার মতো যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, সেটাও খুব স্পষ্ট ভাবে লক্ষণীয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২২ অক্টোবর ২০২৪ ০৯:০৩
Share:

সোনালী দত্তের লেখা “‘একলা’ প্রবীণদের জন্য” (২-১০) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। প্রবন্ধকার এখানে খুব স্পষ্ট ভাবে তুলে ধরেছেন বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে ভারতে প্রবীণ-প্রবীণাদের সামাজিক অবস্থার কথা। সামাজিক বলতে যে শুধু ঘরের বাইরের সমাজে তাঁরা কোণঠাসা, তা নয়। পরিবারের মধ্যেও তাঁদের কোণঠাসা হওয়ার বা বাড়তি বোঝা হওয়ার মতো যে পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়েছে, সেটাও খুব স্পষ্ট ভাবে লক্ষণীয়। বাড়ির বয়স্করা যখন কর্তা বা কর্ত্রী থেকে ‘বোঝা’তে পরিণত হন, তখন সেখানে অনেক বিষয় কাজ করে। তার মধ্যে একটা বড় কারণ হল সংসারে যথেষ্ট পরিমাণ আর্থিক ভূমিকা পালন করতে না পারা। দেখা গেছে, যখন বাবা-মায়ের হাত থেকে সংসারের হাল ছেলে-মেয়ের হাতে এসে পড়েছে, তখন তারা তাদের মতো সংসার চালাতে গিয়ে বাবা-মাকে অতটা গুরুত্ব দেয় না। যার ফলে ছেলে-মেয়ের সংসার চালানো এবং বাবা-মায়ের সংসার চালানোর মধ্যে একটা আন্তরিকতার পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

Advertisement

আবার বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার পিছনেও এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের একা হয়ে যাওয়ার ঘটনা জড়িয়ে আছে। আগেকার দিনের এক প্রজন্ম থেকে আর এক প্রজন্ম যখন সংসারের হাল ধরত, তখন পূর্বতন প্রজন্ম নিজেদের মতো করে একটা মহল তৈরি করে নিতে পারত সংসারের মধ্যে, তাদের সমবয়সি দাদা-বৌদি-ভাইদের নিয়ে। কিন্তু বর্তমানে একান্নবর্তী পরিবার না থাকার জন্য প্রবীণদের সঙ্গে সময় কাটানোর লোকের অভাব। আর সবচেয়ে যেটা চোখে পড়ার মতো কারণ, তা হল— এই গতিশীল যুগে দাঁড়িয়ে প্রবীণ-প্রবীণাদের সময় দেওয়া পুরোপুরি ভাবে একটা ‘সময়ের অপচয়’-তে পরিণত হয়েছে। তাঁদের যত্ন নেওয়া মানে তো ‘গোদের উপর বিষফোড়া’। বর্তমান সময় এতটাই আত্মকেন্দ্রিকতার জন্ম দিয়েছে যে, সংসারে যদি ঘণ্টাদুয়েক করেও প্রতি দিন তাঁদের সময় দেওয়া হয়, তা হলে সেটা ব্যর্থ সময় হিসাবে পরিগণিত হয়। অথচ, একই সংসারে থেকে যখন প্রবীণ-প্রবীণারা অবহেলিত হচ্ছেন আর শিশুরা বাড়তি যত্ন পাচ্ছে, তখন শিশু মনেও এর প্রভাব পড়ে। পরবর্তী কালে মা-বাবার প্রতি তারাও সেই আচরণ প্রদর্শন করতে পারে।

ভারতে এই প্রবণতা ধীরে ধীরে বাড়ছে এবং এই প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। সরকারের উচিত প্রবীণ-প্রবীণাদের প্রতি আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এমন কিছু পদক্ষেপ করা, যাতে তাঁদের কারও মুখাপেক্ষী হয়ে বার্ধক্য অতিবাহিত করতে না হয়। এই আত্মকেন্দ্রিক গতিশীলতার যুগে যাতে তাঁরা শেষ বয়সটা অন্তত একটু শান্তিতে কাটাতে পারেন।

Advertisement

শুভজয় সাধু, শ্রীরামপুর, হুগলি

উদাসীন সমাজ

“‘একলা’ প্রবীণদের জন্য” অত্যন্ত সময়োপযোগী। আমি নিজে এক জন প্রবীণ নাগরিক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার কথা এ ক্ষেত্রে বলতে চাই। কিছু দিন আগে আমি সল্ট লেকে একটি ট্রাভেল এজেন্সির কার্যালয়ে গিয়েছিলাম। এজেন্সির অল্পবয়সি মালিক গল্প করতে করতে হঠাৎ বললেন, “জানেন তো, এই ব্যস্ত রাস্তার দু’পাশের সুসজ্জিত যে বাড়িগুলো দেখছেন, এর বেশির ভাগই কিন্তু এক-একটা বৃদ্ধাশ্রম।” শুনে চমকে উঠেছিলাম। উনি আরও বললেন, “এই সব বাড়ির ছেলেমেয়েরা বিদেশে অথবা ভারতের অন্য রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তাঁদের এখানে আসা-যাওয়ার টিকিট আমার মাধ্যমেই হয়। তাঁরা যখন আমাকে তাঁদের বাবা-মা’কে একটু দেখাশোনা করতে বলেন, আমি সানন্দে তা পালন করি। অনেক সময় এমন হয়, ওঁরা হয়তো বাইরে থেকে বিভিন্ন কারণে ফোনে যোগাযোগ করতে পারছেন না। তখন আমাকে জানালে আমি সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের সেই সংবাদ জানিয়ে দিই।”

অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও এখন প্রবীণ ও বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। এক সময়ের অপরিহার্য মানুষ যখন ধীরে ধীরে অশক্ত, অক্ষম, অকর্মণ্য হতে থাকেন, তখন থেকেই শুরু হয় পরিবার ও সমাজের অন্য মানুষগুলির অবহেলা, উপেক্ষা কিংবা মানসিক-শারীরিক নির্যাতন‌। এর হাত থেকে যেন কোথাও বিন্দুমাত্র রেহাই নেই। এখনকার অনেক বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা যথাযথ যত্ন পান না, হাসপাতালগুলিতেও তাঁরা পরিষেবার ক্ষেত্রে অবহেলিত হন অনেক সময়েই।

ভারতের চেয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোতে কিংবা আমেরিকায় জনসংখ্যার অনুপাতে প্রবীণ নাগরিকদের সংখ্যা বেশি। যদিও উন্নত দেশগুলোতে প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধাও স্বাভাবিক ভাবেই অনেক বেশি। এ দেশে ৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দরিদ্র হওয়ায় প্রবীণদের প্রতি অবিচার, অবহেলা অনেকটাই বেশি। ভারতে ভিখারি, না-খেতে পাওয়া মানুষ, রাস্তার ধারে অনাহারে পড়ে থাকা মানুষের কোনও হিসাব পাওয়া দুষ্কর। সরকারি অব্যবস্থা এবং অবহেলাও এ ক্ষেত্রে সমান ভাবে দায়ী। তাই আমরা দেখতে পাই, সুযোগ-সুবিধা তো দূরস্থান, ট্রেনে প্রবীণদের ভাড়া ছাড়ের ন্যূনতম সুযোগটাও কেড়ে নেওয়া হল কোভিড-অতিমারির অজুহাতে। আজ অবধি তা আর ফিরিয়ে আনা হল না।

আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, রেলমন্ত্রী, সকলেই প্রবীণ। কিন্তু প্রবীণ নাগরিকদের কল্যাণ-চিন্তার ক্ষেত্রে তাঁরা সকলেই উদাসীন। অথচ, আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতির ঢক্কানিনাদ প্রতিনিয়ত শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে গেল। আসলে সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষেরও মানসিকতা যত দিন না প্রবীণদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে উঠছে, তত দিন ভাল কিছু আশা না করাই উচিত।

তপন কুমার দাস, কলকাতা-১২২

অবক্ষয়

সোনালী দত্তের সংবেদনশীল প্রবন্ধের জন্য ধন্যবাদ। কেবল শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত পরিবারেই নয়, তথাকথিত শিক্ষিত পরিবারেও বহু ক্ষেত্রে প্রবীণদের নানা দুঃখ-দুর্দশায় দিনযাপন করতে হয়। সম্পত্তির ভাগ চুলচেরা হিসাব করে বুঝে নেওয়ার পর দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের জন্য বাবা-মাকে ভিখারির মতো করে রাখার নজির বিস্তর। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আজকের প্রবীণ মানুষটি যৌবনকালে তাঁর বাবা-মায়ের সঙ্গে অনুরূপ অমানবিক আচরণই করেছিলেন, তাঁর সেই স্বার্থপরতা, অমানবিকতা পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছে। এই দুর্দশাগ্রস্ত প্রবীণরা এতটাই অসহায় হয়ে পড়েন যে, তাঁরা সামাজিক ভাবে বা প্রশাসনিক দিক থেকেও কারও সাহায্য পান না। ব্যতিক্রমী দু’-একটি ক্ষেত্রে প্রবীণ বাবা-মাকে সুবিচারের আশায় আদালতের দ্বারস্থ হতে দেখা গেছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁরা এই অমানবিক আচরণ মেনে নিয়ে অসহায় ভাবে গতানুগতিক এই জীবন বয়ে চলেন।

বৃদ্ধাদের অবস্থা আরও দুঃসহ। পরনির্ভরশীল জীবন তাঁরা হাসিমুখে যাপন করতে পারেন শুধু তাঁদের প্রতি যদি একটু মানবিক আচরণ করা হয়, সামান্য একটু কর্তব্য পালন করা হয়। মূল্যবোধের অবক্ষয় মানুষকে কোন অতলে নামিয়ে দিচ্ছে! বিবেকহীন, মনুষ্যত্বহীন, কর্তব্যজ্ঞানহীন ভোগবাদী মানুষের বিবেক জাগাতে প্রয়োজন কঠোর অনুশাসন ও আইন। কেউ যদি নিজের বৃদ্ধ বাবা-মাকে সামান্য খাওয়া-পরার অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে, তা হলে শুধুই রাষ্ট্র তাঁদের দায়িত্ব নেবে, এই মনোভাব ঠিক নয়।

নিশ্চিত ভাবেই সহায়-সম্বলহীন একক প্রবীণদের জন্য সরকারকে যথেষ্ট সাহায্যের পরিকল্পনা করতে হবে। কিন্তু পাশাপাশি যাঁরা তাঁদের পরিবার-পরিজন দ্বারা উপেক্ষিত, তাঁদের বঞ্চনার জন্য পরিবারের সংশ্লিষ্ট লোককে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য করতে হবে। কর্তব্য যারা ভুলে যায়, তাদের বিবেককে চাবুক মেরে জাগানো প্রয়োজন।

সন্দীপ সিংহ,হরিপাল, হুগলি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement