Singur

সম্পাদক সমীপেষু: শিল্পের মৃত্যু

১৯৭০-এর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক গোষ্ঠী কেন্দ্র-বিরোধিতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন করে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২২ ০৫:৪০
Share:

শুভজিৎ বাগচীর লেখাটির প্রসঙ্গে (‘যে ভাবে বঞ্চিত হল রাজ্য’, ৮-১) এই চিঠির অবতারণা। লেখক সুচারু ভাবে শিল্পোন্নয়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিমাতৃসুলভ মনোভাব এবং বঞ্চনার ইতিহাসকে বর্ণনা করেছেন। ঐতিহাসিক ভাবে এই আলোচনা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ১৯৬০-এর দশকে সাংবাদিক রণজিৎ রায় একটি অতি পরিচিত নাম। আমরা যারা ওই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনা করতাম, তারা তাঁর বিদগ্ধ নিবন্ধগুলির (বাংলা ও ইংরেজি) উৎসাহী পাঠক ছিলাম। এ কথা অবশ্যস্বীকার্য যে, কেন্দ্রের বৈরী ভাব পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সম্ভাবনাকে বিভিন্ন ভাবে বিড়ম্বিত করেছে। স্বাধীনতার পরের দু’দশক তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সদর্থক সহায়তা পাননি। নেহরুও পশ্চিমবঙ্গের প্রতি কিছুটা বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন। কিন্তু শিল্পোন্নয়নে উদ্যোগী বিধানচন্দ্র, নেহরুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ১৯৫৯ সালে দুর্গাপুর স্টিল প্লান্ট স্থাপন করতে সক্ষম হন এবং দুর্গাপুরকে শিল্পনগরী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। দুর্গাপুর স্টিল ব্রিটিশ প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ একটি আধুনিক ইস্পাত কারখানা হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তাঁর অপর শিল্পকীর্তি এসিসি ভিকার্স অ্যান্ড ব্যবকক (এভিবি)। এই বিদেশি সংস্থাটি দুর্গাপুরে একটি বৃহদাকার ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পের সূচনা করে। কল্যাণীকে শিল্পনগরী করে গড়ে তোলার প্রয়াস তাঁর সময়েই সূচিত হয়। তিনিই পশ্চিমবঙ্গের শিল্পোন্নয়নের একমাত্র রূপকার।

Advertisement

১৯৭০-এর দশক থেকে পশ্চিমবঙ্গের শাসক গোষ্ঠী কেন্দ্র-বিরোধিতাকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করে রাজ্যের শিল্প সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন করে। বাম জমানায় উগ্র শ্রম আন্দোলন অনেক সুপরিচালিত শিল্পসংস্থাকে পশ্চিমবঙ্গচ্যুত হতে বাধ্য করে। বাম জমানার শেষ পর্যায়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পোন্নয়নে নতুন করে আগ্রহী হন। কিন্তু সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির মোটরগাড়ি তৈরির কারখানাটি রাজনৈতিক টানাপড়েনের শিকার হয়ে পশ্চিমবঙ্গের শিল্প সম্ভাবনার চিরমৃত্যু ঘটায়। কোনও স্বদেশি বা বিদেশি শিল্পসংস্থা তার পর পশ্চিমবঙ্গের দিকে ফিরে তাকায়নি। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে।

কালীশঙ্কর অধিকারী

Advertisement

কলকাতা-১৯

ভূমিকা শূন্য

শুভজিৎ বাগচীর প্রবন্ধ থেকে যা আমরা জানতে পারলাম না তা হল, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রেক্ষাপটে রাজ্যের তদানীন্তন ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতা-মন্ত্রীদের ভূমিকা ঠিক কী ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত দিল্লিতে কংগ্রেস আধিপত্য কায়েম ছিল, কখনও শাসক দল, কখনও শক্তিশালী বিরোধী দল হিসাবে। তা সত্ত্বেও বঙ্গের কংগ্রেসি নেতা-মন্ত্রীদের রাজ্যের অর্থনৈতিক বা শিল্পোন্নয়নের কোনও উদ্যোগ দেখা গেল না কেন? নেহরুর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হওয়া সত্ত্বেও বিধানচন্দ্র রায়কে দুর্গাপুরে ইস্পাতনগরী বানানোর জন্যে অনেক কসরত করতে হয়েছিল। বরকত গনি খান চৌধুরী রাজীব গান্ধীর সরকারের রেলমন্ত্রী, দেশের প্রথম মেট্রো রেল প্রকল্পটি আদায় করে এনেছিলেন কলকাতার জন্যে। এর মধ্যে, এবং এর পরে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক তথা সামাজিক উন্নয়নে কংগ্রেসি নেতাদের ভূমিকা ছিল শূন্য।

কেন্দ্রে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকশো চটকল, দুর্গাপুরের ইস্পাতশিল্পের মতো শিল্পগুলিকে পুনরুজ্জীবিত করার কোনও উদ্যোগ তাঁরা করেননি। ১৯৭৭-এর সিপিএম জমানার শুরু থেকে শ্রমিক আন্দোলনের জেরে শিল্পপতিদের চোখে পশ্চিমবঙ্গ শ্রমিক আন্দোলনের রাজ্য হয়ে গেল। গোটা দেশে শিল্পক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নাম উঠে এল ধর্মঘট আর বন্‌ধের নৈরাজ্যের রাজ্য হিসাবে। মূলত পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসি নেতা-মন্ত্রীরা ব্যক্তিস্বার্থ এবং নিজেদের ‘লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট’ নিয়েই ভেবেছেন বেশি, যত না ভেবেছেন রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের দিকটি। ১৯৭৭ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত বাংলার প্রভাবশালী কংগ্রেসি নেতারা দলের সাংগঠনিক কার্যকলাপ শিকেয় তুলে সিপিএম দলটির সঙ্গে আঁতাঁত করে চলাটাই যুক্তিযুক্ত মনে করেছিলেন।

নীরদচন্দ্র চৌধুরীর আত্মঘাতী বাঙালি গ্রন্থে বাঙালির স্বজাতির প্রতি ঈর্ষা ও বিদ্বেষের কথা লিখেছিলেন, সেটা আক্ষরিক অর্থে ফলে গেল ১৯৯৮-এ, যখন তদানীন্তন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সভাপতি সীতারাম কেশরী কলকাতায় এসে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে কংগ্রেস সভাপতি হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোনয়ন খারিজ করেন। আজ জাতীয় স্তরে মমতার প্রাসঙ্গিকতাই প্রমাণ করে, সেই সব কংগ্রেসি নেতার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার অভাব কতখানি ছিল।

পিনাকী রুদ্র

কলকাতা-১২৪

মধুকবি

আজ মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রাক্-দ্বিশতবর্ষের সূচনা হল। আগামী বছর ২৫ জানুয়ারি সূচনা ঘটবে এই মহাকবির দ্বিশতবর্ষের।

অসাম্প্রদায়িকতার উপাসক মধুকবি নির্দিষ্ট কোনও ধর্মের প্রতি পক্ষপাতী ছিলেন না। ব্যক্তির মানবিক পরিচয় তাঁর কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হিন্দু কলেজের ছাত্র হিসাবে তাঁর সমর্থন ছিল এই বাক্যে: “টু গিভ এডুকেশন টু অল ক্লাসেস, সেক্টস, অ্যান্ড ক্রিডস।” মাদ্রাজ-প্রবাসী মাইকেল একটি ইংরেজি কাব্যনাট্য রচনা করেছিলেন: ‘রিজ়িয়া— দ্য এম্প্রেস অব ইন্ডি’, এটি সেখানকার ইউরেশিয়ান পত্রিকার ১৮৪৯-৫০ সালে পর পর সাতটি সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। এই নাটকে তিনি মুসলমানদের শৌর্য-বীর্য এবং বীরত্বের আখ্যানকে উজ্জ্বল ভাবে বর্ণনা করেছেন। মুসলিম রিজ়িয়া ভারতসম্রাজ্ঞী— এই বর্ণনায় মধুকবি ইতিহাস-চেতনার গভীরতার পাশাপাশি নারীর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধকে অনন্য গুরুত্ব দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িকতা এবং মুক্তবুদ্ধি এখানে হাত ধরাধরি করে অবস্থান করছে। স্বরচিত নাটকে আরও বেশি করে মুসলিম মানস ও জীবনকে নিয়ে আসার পক্ষে সওয়াল করেছেন তিনি। কারবালার বিয়োগ ব্যথাতুর বিষয় নিয়ে মহাকাব্য রচনার কথাও ভেবেছিলেন। হিন্দু ক্রনিকল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মুসলমানস ইন ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধটিতে মুসলমান শাসনকালের যুক্তিতীব্র সমালোচনা করেছেন ঠিকই, কিন্তু ছেড়ে কথা বলেননি লিডেন হল-কে। তাঁর শাসনব্যবস্থায় ভারতের দুরবস্থা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে, তা মাইকেল চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এর পরিণাম ভাল হয়নি তাঁর পক্ষে। আথেনিয়াম পত্রিকায় মধুসূদনের স্ববিরোধিতাকে আক্রমণ করে লেখা হল যে, এক দিকে তিনি মুসলমান শাসকের প্রশংসা করছেন, আবার সেই সঙ্গে কর্নাটের নবাবের রাজ্য অপহরণের সমর্থন করছেন কী ভাবে! সমালোচকরা বুঝতে পারেননি মাইকেল-মানসের গভীরতা। মধুকবি ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম শাসকের উচ্ছৃঙ্খলতাকে সমর্থন করতে পারেননি কোনও দিন। মুসলমানের ভালকে তিনি মুক্তকণ্ঠে ভাল বলেছেন, খারাপকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খারাপ বলেছেন।

খ্রিস্টান মাইকেল মধুসূদন বলপ্রয়োগ বা কৌশলে দলিত এবং সাধারণ মানুষকে খ্রিস্টধর্মান্তরিত করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন। ‘নেটিভ এডুকেশন’ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, বিদ্যালয়ে বাইবেল পড়ানোর মতো জবরদস্তি কাজকে প্রশ্রয় দেওয়া ব্রিটিশ সরকারের অনুচিত। শাসক বাইবেল শিক্ষাকে আবশ্যক করছে, অথচ ভারতীয়দের প্রকৃত শিক্ষার আলো দিতে অনিচ্ছুক— মধুকবি এই প্রচেষ্টাকে মানতে পারেননি। হিন্দুদের হিন্দুত্ব বিষয়ে অতি সচেতনতা নিয়ে সমালোচনা, উগ্রহিন্দুত্ববাদীদের প্রতি আক্রমণ তাঁর ক্ষুরধার কলমের জাত চিনিয়ে দিতে সক্ষম ছিল। তবে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করলেও মাইকেল মধুসূদন দত্ত হিন্দুধর্মদ্বেষী ছিলেন না। তার প্রমাণ রয়ে গেছে এই বক্তব্যে: “আমরা যে সমাজে জন্মগ্রহণ করেছি তার নৈতিক দৃষ্টিকোণ খ্রিষ্টসমাজ থেকে হীনতর ছিল একথা মানি না। তবে হিন্দুসমাজের প্রভূত উন্নতিসাধনের অবকাশ রয়েছে।”

শুভাশিস চক্রবর্তী

অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement