Coronavirus Lockdown

ডেনভার শহরে ঘরবন্দি আমরা, মানুষে-মানুষে নতুন সম্পর্কের আলো দেখতে পাচ্ছি

এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।এই লকডাউন পরিস্থিতিতে পাঠকদের থেকে তাঁদের অবস্থার কথা, তাঁদের চারপাশের অবস্থার কথা জানতে চাইছি আমরা। সেই সূত্রেই নানান ধরনের সমস্যা পাঠকরা লিখে জানাচ্ছেন। পাঠাচ্ছেন অন্যান্য খবরাখবরও। সমস্যায় পড়া মানুষদের কথা সরকার, প্রশাসন, এবং অবশ্যই আমাদের সব পাঠকের সামনে তুলে ধরতে আমরা ম‌নোনীত লেখাগুলি প্রকাশ করছি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০২০ ১৬:৪৯
Share:

এখন স্মোকি হিল। —নিজস্ব চিত্র।

আমি কলোরাডো রাজ্যের ডেনভার শহরের ‘স্মোকি হিল’ নামক একটি শহরতলিতে থাকি। ইউনাইটেড স্টেটস অফ আমেরিকায় অবস্থিত এই ডেনভার শহরটি। যা ‘রকি মাউনটেন্স’ এর সাদা বরফে মোড়া অনাবিল সৌন্দর্যে মন্ডিত সুদৃশ্য ছোট্ট পাহাড়ি শহর। উচ্চতা ৫,২৮০ ফুট (১,৬০৯.৩ মি)। সমুদ্র থেকে এক মাইল উঁচুতে তার অবস্থান বলে আদর করে ডাকা হয় ‘মাইল হাই সিটি’ নামে।

Advertisement

স্বচ্ছ নীল আকাশ, বরফ গলা কিছু পাহাড়ি নদী, ঝরনা এবং পাইন, আসপেন, উইলো, ওক গাছের জঙ্গল দিয়ে ঘেরা এই মিষ্টি শহরে আমাদের বসবাস। এখানে সকালে ঘুম ভাঙে নানা রকম সুরে বিচিত্র সব পাখপাখালির কিচিরমিচির কলতানে। সন্ধ্যেবেলায় এই একই আকাশে অগুনতি তারারা মায়াভরা আচ্ছাদনে আমাদের মন-প্রাণ জুড়িয়ে দেয়।

অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে মে মাসের মাঝ পর্যন্ত এখানে স্কিয়িং, স্নোবোর্ডিং, মাউন্টেন হাইকিং, হোয়াইট রিভার রাফটিং, রক ক্লাইম্বিং ইত্যাদি হয়। যার জন্যে সারা পৃথিবী থেকে ট্যুরিস্টদের আগমনে মুখরিত থাকে এই অতিথিপরায়ণ শান্ত পাহাড়ি রাজ্যটি। নির্ভেজাল আনন্দ, অ্যাডভেঞ্চার, এক্সসাইটমেন্ট, দৈনন্দিন জীবনযুদ্ধের অক্লান্ত পরিশ্রম সত্ত্বেও এক ভালবাসার চাদর যেন ছড়ানো সারা রাজ্য জুড়ে।

Advertisement

আরও পড়ুন: অপেক্ষায় আছি কবে এই দুর্দিন কাটবে

সব কিছুই তো বেশ সুন্দর চলছিল তাল-ছন্দ মিলিয়ে। কিন্তু আকস্মিক ছন্দপতন। শান্তিপ্রিয়, চঞ্চল এই মিষ্টি শহরটিও সারা দেশ তথা পৃথিবীর সঙ্গে করোনাভাইরাসের কঠিন করাল থাবায় স্তব্ধ দিশেহারা। সারা বিশ্বের মতোই এক ঝলকে শতশত জীবন এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুভয়ের মুখোমুখি। অজানা আশঙ্কায়, যন্ত্রণায় রাত-দিন সব এক হয়ে গেল ডেনভারবাসীদেরও। সারা বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গে এখানেও সবাইকে ‘লকডাউন’, ‘স্টে অ্যাট হোম’, ‘সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং’ এর মতো বিচ্ছিন্নতার অমোঘ নিয়মকানুন ঘোষিত হল। অবশ্যই ‘জনহিতকর’ কারণে এবং সবার জীবনের স্বার্থে। মৃত্যুদূত যে সবার দরজায় কড়া নাড়ছে।

জীবন-মৃত্যুর এক ভয়ঙ্কর দোলায় দুলছি আমরা। হঠাৎ করে যে কোনও সময়ে ঝুপ করে যদি কেউ পড়ে যায় তা হলে আর কিছু করার নেই। গোটা শহরটাই তাই ঘরে বন্দি। এখানেও সারা বিশ্বের সকল শহরের মতোই জনকোলাহলের তরঙ্গে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ডেনভার ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টটি সারা ‘নেশন’-এ পঞ্চম ব্যস্ততম এয়ারপোর্ট। ২০১৯ সালে প্রায় সাত কোটির কাছাকাছি মানুষের যাতায়াত ছিল এই এয়ারপোর্টে। আমি, আমার স্বামী ও আমার বড় ছেলেকে কাজের সূত্রে প্রায় প্রত্যেক মাসেই দু’-তিনবার বাইরে যেতে হয়। লোকে লোকারণ্য এই এয়ারপোর্টের বহুতল পার্কিং ফ্লোরগুলো সম্পূৰ্ণ ভর্তি থাকত । কিন্তু এখন খাঁ খাঁ করছে চারিদিক। এয়ারপোর্টের কয়েকশো বিলাসবহুল রেস্টুরেন্ট এবং বাহারি সামগ্রী বিক্রি করার বিপণি যেন ধুঁকছে। যেখানে প্রতিদিন প্রায় পৌনে দু’লাখ জনতার আসা-যাওয়া ছিল, সেখানে এখন সারা এয়ারপোর্টে সর্বসাকুল্যে এক হাজার লোকও চোখে পড়ে না।

বিশাল বিশাল শপিং মলগুলিতে আর জনতার মিছিল আছড়ে পড়ছে না। সব কিছু সুনসান, মনে হয় যেন ডেড-সিটি। মানুষগুলো বন্ধ ঘরের অন্তরালে থমকে গিয়েছে। না, ‘অ্যাডভেঞ্চার’ -র শহরের মানুষগুলো আজ কেউ আর জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছে না।

তবুও হাসপাতালগুলোতে ডাক্তার, নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা নির্ভীক সৈনিকের মতো রাত-দিন যুদ্ধ করে চলেছেন নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সারা দেশ অন্তর থেকে তাঁদের কুর্নিশ জানাচ্ছে। কিন্তু এই বিষণ্ণ অন্ধকারের মধ্যেও সারা বিশ্বের হাজার-হাজার মানুষের মতো আমরাও একবুক আশা নিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে আছি। হয়তো খুব শিগগিরই এই জীবন-মরণের দোটানা থেকে আমরা মুক্তি পাব। সারা পৃথিবীর বৈজ্ঞনিকরা মিলে এই ভয়ঙ্কর রোগটির প্রতিষেধক আবিষ্কার করবেন নিশ্চয়ই।

আরও পড়ুন: জনশূন্য জনপদ, রূপকথার গল্পে যেমন হয়​

আর আমরা, স্মোকি হিলের বাসিন্দারা? আর সকলের মতোই, যতটা পারি এই যন্ত্রণাদায়ক সত্যিকে মেনে নিয়ে নিজেদের মতো করে বেঁচে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই ‘লক ডাউন’-র সময়ে সকলকে বাড়িতেই যখন থাকতে হবে, তখন যার-যার পরিবারের সকলে মিলে এই পুরো সময়ে নিজেদের মতো করে সুন্দর ভাবে কাটালে মন্দ কী? এমনিতেও এই চির ব্যস্ততাময় জীবনে কেউ কারওর সঙ্গে একফোঁটা সময়ও বের করে উঠতে পারেন না নানা কারণে। এখনকার এই অফুরন্ত সময়টাই আমাদের পরমপ্রাপ্তি। আমরা এখানে নিজ-নিজ কাজ সেরে, সেটা আমার স্বামী বা বড় ছেলের ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ই হোক, আর আমার ‘ঘরকন্নার’ কাজই হোক, এ সবের মাঝেও সবাই যার যার মতো সময় বের করে নিচ্ছি। বাচ্চারা, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি পড়ুয়ারা (যার মধ্যে আমার ছোটছেলেও আছে)— সকলেই হঠাৎ করে চাপিয়ে দেওয়া কঠোর অনলাইন স্টাডি সেশনগুলোতে একটু যেন বিভ্রান্ত। বাকি সময়টুকু কাটছে ‘ভিডিও চ্যাট’-এর মাধ্যমে, অনলাইন গেম খেলে, গান-বাজনা ইত্যাদি করে। আমরা বড়রাও কিন্তু উইকএন্ড-এর জন্যে এখনও আগের মতোই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকি | তবে, বন্ধুদের সঙ্গে সেই সব আড্ডা, গল্প-গুজব, সমবেদনা, সমচেতনার আদান-প্রদান সবটাই হচ্ছে ভিডিয়ো কনফারেন্সে।

ঘরে বসে মন ভাল রাখার কিছু সুন্দর অভ্যাস আয়ত্তে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ভাল গান শুনে, নানা রকম ভাল চলচ্চিত্র দেখে, গল্প করে পরিবারের সকলকে নিয়ে একটি পরিচ্ছন্ন নির্বিঘ্ন ‘কোয়ালিটি টাইম’ কাটানো এই দেশে কিন্তু বহু মানুষেরই চিরকালীন স্বপ্ন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যেন এই চরম সংকটের মুহূর্তটি এটি পূরণ করতে সাহায্যই করছে আমাদের। হয়তো খুবই অবাস্তব লাগছে এটি শুনতে I কিন্তু আজকের এই ঘরবন্দি জীবনে একটি নিগূঢ় সত্যি আমার কাছে ধরা দিয়েছে। মানুষ সব হারানোর ভয় পেলেই বোধহয় আপনজনদের, আপন পারিপার্শ্বিককে নতুন করে চেনে, মানুষমাত্রকেই কাছের মানুষ ভাবতে ভালবাসে। জাগতিক স্বার্থচিন্তা দূরে ঠেলে দিয়ে সকলে সকলের জন্য বেঁচে থাকার আনন্দ যে কী মহৎ প্রাপ্তি, তা বুঝতে পারে।

এখন মনে শুধু সুন্দর এক আশার আলো জ্বলজ্বল করছে। রকি মাউন্টেনের উপর থেকে কালো মেঘ কেটে গেলে যেমন হয়, আমরা আবার নতুন সূর্যোদয় দেখবো, নতুন ভাবে নতুন আবেগে জীবনধারণের অঙ্গীকার করব। জাতি-ধর্মের রেষারেষি-বিহীন এক সুন্দর পৃথিবী জন্ম নেবে। আমরা সকলে আবার উদাত্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠব ‘ভুবন জোড়া আসন খানি আমার হৃদয় মাঝে বিছাও আনি….’। আমরা আবার বাঁচব এক নতুন পৃথিবীতে।

রুচিরা রায় বর্মন, স্মোকি হিল, কলোরাডো, আমেরিকা

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।​)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement