—প্রতীকী ছবি।
সুগত মারজিৎকে ধন্যবাদ, শিক্ষিত সমাজকে ঘা দিয়ে জাগিয়েছেন বলে (যে সমাজ বিজ্ঞান-অবিশ্বাসী, ২২-৫)। তিনি অর্থনীতিবিদ। অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে এক সাধারণ অভিযোগ এই যে, তাঁরা জিডিপি বৃদ্ধি তথা দারিদ্র নিরসন নিয়ে যতই মাতামাতি করুন, বিজ্ঞান নিয়ে দু’এক জন ব্যতিক্রমী ব্যক্তি ব্যতীত একেবারেই নীরব। জিডিপি বৃদ্ধি ও দারিদ্র হ্রাসের আসল চাবিকাঠি যে বিজ্ঞানের হাতে, এ সহজ সরল সত্যটা তাঁদের রচনায় কী করে অনুপস্থিত থাকে, সেটাই বিস্ময়কর।
সারা জীবন বিজ্ঞানের গবেষণাগারে কাটিয়ে আমার বিজ্ঞানী বন্ধুদের মধ্যে কুসংস্কার ও ‘অনেক ঈশ্বর’-এর প্রতি প্রীতির ঘটা দেখে যুগপৎ বিস্মিত, দুঃখিত ও আশাহত হই। এ পোড়া দেশে কোনও দিন কি বিজ্ঞানের কিছু হবে? শিক্ষিতদের মধ্যে কুসংস্কার নিয়ে এক প্রয়াত অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, অশিক্ষিতদের মধ্যে যে কুসংস্কার তার মধ্যে কোনও খাদ নেই, কারণ তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য একটুও বিজ্ঞানের মিশ্রণ ঘটানোর চেষ্টা করেন না। কিন্তু শিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বা বিজ্ঞান-দীক্ষিতদের বিপদ হল, তাঁদের কুসংস্কার যে বিজ্ঞান-সমর্থিত, সেটা প্রমাণ করার জন্য তাঁদের আপ্রাণ ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। তা না হলে তাঁদের সামাজিক সম্মান বজায় থাকে না।
প্রবন্ধকারের একটি বক্তব্য নিয়ে অবশ্য মন্তব্য করতেই হচ্ছে। তিনি গণিতশাস্ত্রকে যথার্থ বিজ্ঞানের মধ্যে স্থান দিয়েছেন। পদার্থবিদ্যা, রসায়নবিদ্যা এবং জীববিদ্যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য প্রাকৃতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে পারে, সে জন্য সেগুলো বিজ্ঞান। এ জিনিসটা গণিতশাস্ত্র পারে না। এই কারণেই গণিতশাস্ত্র বিজ্ঞান বহির্ভূত— নোবেল প্রাইজ়ের বিষয়গুলির মধ্যে গণিতশাস্ত্র স্থান পায়নি। বড়জোর একে বিজ্ঞানের একটি সহায়ক পদ্ধতি বা ‘টুল’ বলা যেতে পারে।
সুব্রত ঘোষ, কলকাতা-৬৮
আলাদা অঙ্ক
সুগত মারজিৎ বহুচর্চিত ‘ঈশ্বর বনাম বিজ্ঞান’ বিতর্ককে ফের উত্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, বিসমিল্লার সানাইয়ের ফুঁ, জ়াকির হোসেনের তবলার চাঁটি, আলি আকবর খাঁ সাহেবের হাতের জাদু, অথবা রবীন্দ্রনাথের সৃজনস্ফুরণ ইত্যাদিকে যে দিন গণিতের সাহায্যে অবিকল পুনর্নির্মাণ করা যাবে, সে দিনই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আস্থা আর একটু বাড়তে পারে সাধারণ মানুষের। তত দিন অবধি শুনতে হবে ‘ঈশ্বরের জয়’— তা সে যে ঈশ্বরই হোক না কেন।
গণিতের দ্বারা শিল্পীদের সৃষ্টির অবিকল পুনর্নির্মাণ করা গেলে সাধারণের বিজ্ঞানে আস্থা বাড়বে, এই অদ্ভুত বিশ্বাস কার? লেখকের, না সমাজের? শিরোনামের সঙ্গে উপসংহার মিলল কি? বিশ্বের অধিকাংশ মানুষই ঈশ্বর-বিশ্বাসী। ঈশ্বরে বিশ্বাসী করে তোলার শিক্ষা কত সুদূরপ্রসারী, সংখ্যা তার বড় প্রমাণ। যদিও সব মানুষই ঈশ্বরের কথা লোকমুখে শুনেছে, অথবা পুস্তকে পড়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীর বা উপলব্ধির দাবিদার নিতান্তই কম। এত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এত বিশ্বাসী? কিন্তু বৈজ্ঞানিক শিক্ষার এমন ব্যাপক ব্যবস্থা আছে কি, যেমন আছে ধর্মের, ঈশ্বর-বিশ্বাসের?
বিজ্ঞানীদের মধ্যে রামানুজন যেমন আছেন, চন্দ্রশেখরও আছেন, নিউটন যেমন আছেন, স্টিফেন হকিংও আছেন। দু’দিকেই কীর্তিমান ব্যক্তিরা আছেন। তাঁদের ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাস দিয়ে সমাজের বিজ্ঞান-বিশ্বাস কেমন, জানা সম্ভব নয়। মানবমনে ঈশ্বরবোধ সংক্রান্ত ধারণার ইতিহাস পদার্থবিদ, গণিতজ্ঞ, রসায়নবিদরা তাঁদের বিষয়গত জ্ঞানের দ্বারা যত প্রাঞ্জল করতে পারেন, তার থেকে বেশি পারেন সমাজবিদ্যা বিশারদ, নৃতত্ত্ববিদ, মনোবিদ, পুরাতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদেরা। কারণ, মানবমনে ঈশ্বর অনুসন্ধানে এই সমস্ত বিষয়ের সংগৃহীত তথ্য নতুন জ্ঞানের সঞ্চার করেছে। ধর্মপুস্তকের বাইরেও মানবমনে ঈশ্বর-বিশ্বাসের খবর আছে এই সমস্ত বিদ্যায়।
আলতামিরা, ভীমবেটকার গুহায় মানুষ ছবি এঁকেছিল কিসের? সেগুলো শিল্প-কর্ম নয়? কোনও ঈশ্বর নয়, সেখানে পাওয়া গিয়েছে শিকারের ছবি, পশুর ছবি, মধু সংগ্রহের ছবি— জীবিকা আহরণের প্রমাণ, পাথরের গায়ে আঁকা। প্রাক্-ইতিহাসবিদরা সংগ্রহ করেছেন পাথরের হাতিয়ার। সেগুলি কি বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নয়? এর ব্যাখ্যা কি গণিতজ্ঞ করবেন, না কি নৃতত্ত্ববিদ? অঙ্ক দিয়ে মন মেলাতে চাইলে মিলবে কেন, মনের অঙ্ক আলাদা।
শান্তনু গুহ, কলকাতা-১৯
ধ্যানও উপায়
‘যে সমাজ বিজ্ঞান-অবিশ্বাসী’ পড়ে সমৃদ্ধ হলাম। বিজ্ঞান হল এমন জ্ঞান যা বিশেষ ভাবে পরীক্ষিত। বিজ্ঞানের এই সংজ্ঞা অনুসারে গণিত হল বিজ্ঞানীর ভাষা, বিজ্ঞান নয়। ধ্যানও জানার একটি উপায়। বৈদিক ঋষিরা ধ্যানমগ্ন হয়ে যা উপলব্ধি করেছিলেন, তা অবৈজ্ঞানিক বলে অবহেলা করা সমীচীন নয়। পাশ্চাত্যের বিজ্ঞান আর প্রাচ্যের বিজ্ঞান ও পদ্ধতি এক নয়। যে-হেতু বিজ্ঞান পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণিত, তাই তা গ্রহণযোগ্য, আর ধ্যানলব্ধ জ্ঞান পরীক্ষানিরীক্ষার দ্বারা প্রমাণ করা যায় না বলে পরিত্যাজ্য, এই ধারণা ঔপনিবেশিকতার প্রভাব। বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মতে, “বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ, ধর্ম ছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া।” বিজ্ঞান প্রভাবিত হয় বিজ্ঞানীর বিশ্বাসের দ্বারা, আর বিশ্বাস তৈরি হয় ধর্মকে আধার করে।
ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাঠ্যবিষয় থেকে বাদ গেলে এমন কিছুই হবে না। কারণ পাঠ্যবিষয় পড়ে যে জ্ঞান হয়, বাস্তবে তার প্রয়োগ হয় কম। তাই বিজ্ঞান পড়ে, বিজ্ঞানী হয়েও বাস্তবে আমরা বিজ্ঞান-অবিশ্বাসী, বিজ্ঞান-বিমুখ। তবে পাঠ্য থেকে বিবর্তনবাদ বাদ দেওয়ার পিছনে যে যুক্তি, তা অযৌক্তিক। ডারউইনের বিবর্তনবাদ পাঠ করলে ক্ষতি হবে না। বরং যুক্তিতর্কের দ্বারা মানব, প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের একাত্মতার শিক্ষা লাভ হবে।
সমরেশকুমার দাস, জালুকি, নাগাল্যান্ড
বিতর্ক চাই
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি ভবিষ্যতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সৃষ্ট দানব হয়ে উঠতে পারে? সন্দেহ নেই, এর নেতিবাচকতা সম্বন্ধে আমাদের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। চিন্তা একটু হয় বইকি, যখন অনেক প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানী একটি খোলা চিঠির মাধ্যমে সম্প্রতি একটি নির্দিষ্ট ধরনের কৃত্রিম মেধার গবেষণা ও প্রয়োগ স্থগিত রাখতে অনুরোধ করেছেন ছ’মাসের জন্য। পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যে, সকলে মিলে যাতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্যে একটি রূপরেখা, নীতি ও প্রোটোকল তৈরি করা হয়। প্রায় একই সময়ে, ইটালির মতো দেশ কৃত্রিম মেধার প্রযুক্তি চ্যাটজিপিটি-র উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে। ডিপ ফেক প্রযুক্তি-তে কৃত্রিম মেধা ব্যবহার হয়। এখন সমাজমাধ্যমে আমরা প্রায় এই ডিপ ফেক প্রযুক্তির অপব্যবহার দেখি। ভুয়ো ছবি বা ভিডিয়ো তৈরি করা হচ্ছে। একের কথা অন্যের মুখে বসিয়ে ভিডিয়ো তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের কাছে নিমেষে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবণতা সাংঘাতিক।
চিকিৎসাবিজ্ঞান, কৃষিবিজ্ঞান, প্রশাসন, প্রতিরক্ষা ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে কৃত্রিম মেধার উপকারিতা অপরিসীম। কিন্তু এর অপব্যবহার রুখবে কে? এর জন্যে আমাদের দেশে দরকার একটি যথাযথ আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ইতিমধ্যেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স অ্যাক্ট নামে একটি আইন তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ব্রাজ়িল, কানাডা-সহ বহু দেশ এই বিষয়ে আইন তৈরির রাস্তায় এগিয়েছে। ভারতেও এই বিষয়ে জাতীয় স্তরে আলোচনা ও বিতর্কের প্রয়োজন।
শঙ্কর দে, কলকাতা-৭৪