Politics

সম্পাদক সমীপেষু: রেউড়ির বিকল্প

অশোকবাবুর যুক্তি মানলে সেটাও রেউড়ি। অবশ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিজেপির শিবরাজ সিংহ চৌহানের সমালোচনা আর প্রধানমন্ত্রী মোদীজির সমালোচনা তো এক কথা নয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২৪ ০৬:১৩
Share:

—ফাইল চিত্র।

নরেন্দ্র মোদী যাকে ‘রেউড়ি’ বলে থাকেন, তাকেই বিজেপি বিধায়ক অশোক কুমার লাহিড়ী রাজনৈতিক অর্থনীতির ভাষায় সমালোচনা করেছেন ‘কাল ও পরশুর চিন্তা’ (১-৭) প্রবন্ধে। যদিও মোদীজি যে প্রকল্পের কথা বলে ভোট চেয়েছেন, সেই পাঁচ কিলো চাল বিতরণের প্রকল্প নিয়ে একটা কথাও বলেননি। অশোকবাবুর যুক্তি মানলে সেটাও রেউড়ি। অবশ্য, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা বিজেপির শিবরাজ সিংহ চৌহানের সমালোচনা আর প্রধানমন্ত্রী মোদীজির সমালোচনা তো এক কথা নয়।

Advertisement

প্রশ্ন হল, রেউড়ি কেন দিতে হচ্ছে? কারণ, দেশের বেশির ভাগ মানুষ গরিব, এবং মুষ্টিমেয় সরকারি কর্মচারী ও কিছু সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারী ছাড়া আর কারও জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। তা হলে এই লোকগুলির কী হবে? সেই সমাধানের চেষ্টাতেই কয়েকটি রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকার কিছু ‘রেউড়ি’র ব্যবস্থা করতে বাধ্য হয়েছে। অবশ্য অন্য সব রাজ্য যে নীতিগত বিরোধিতার জন্য ‘রেউড়ি’ দিচ্ছে না, তা নয়। যদি এ দেশে শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকত, তা হলে কি এ সবের প্রয়োজন হত? এই সব রেউড়িকে কাজে লাগিয়ে, রাজ্যের বা দেশের শিল্পভিত্তি সামান্য হলেও বাড়ানো যায়। যেমন, সবুজসাথী প্রকল্পে যে সব সাইকেল দেওয়া হয়েছে, সেই সব সাইকেল অন্য রাজ্য থেকে আমদানি না করে এই রাজ্যে সাইকেল কারখানা তৈরি করা যেত। এই টাকা গঠনমূলক ভাবে ব্যবহার করা দরকার।

ঠিকই, গরিব মানুষরা যাতে নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে পারেন তার ব্যবস্থা করা দরকার। অশোকবাবু নিজে আমলা হিসেবে ও বিধায়ক হিসেবে দীর্ঘ দিন ক্ষমতার চার পাশেই আছেন। তিনি ভাল করেই জানেন, কংগ্রেস সরকার বা বিজেপির সরকার কেন তা করতে পারেনি। ইন্দিরা গান্ধী গরিবি দূর করার কর্মসূচি নিলেও, সেই সময়ে একটা সমীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখেছি, তাঁর দলের বাস্তুঘুঘুরা কী ভাবে সেই কর্মসূচির বিরোধিতা করেছিল। আবার বিজেপির আমলে দেখা গিয়েছে, এই দল তাদের প্রিয় পুঁজিপতিদের ব্যাঙ্কঋণ মকুব করতে, তাঁদের করছাড় দিতে, উপরের ২০-২৫ শতাংশ মানুষের চাহিদার উপর নির্ভর করে অর্থনীতি চালাতে যতটা আগ্রহী, তার কণামাত্রও আগ্রহী নয় গরিবের আয় বাড়ানো ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে।

Advertisement

অথচ, এই ৭৫-৮০ শতাংশ মানুষের যদি আয় বাড়ে, তা হলে এক দিকে যেমন সঞ্চয় বাড়বে, তেমনই তাঁদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ার সুফল শিল্প, কৃষি সমেত আর্থিক ব্যবস্থার বিভিন্ন ক্ষেত্র পাবে। সেই বৃদ্ধি ঢের বেশি সমতা-ভিত্তিক হবে।

সুনীল মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-১১৪

নগদের টান

অশোক কুমার লাহিড়ীর সুচিন্তিত বিশ্লেষণ প্রণিধানযোগ্য। তবে লক্ষ্মীর ভান্ডারের প্রসঙ্গে বলতে চাই, দারিদ্র, অশিক্ষা যেখানে বারো মাসের সমস্যা, সেখানে বিনা পরিশ্রমে নগদ টাকা পাওয়ার আর্কষণ সাধারণ মানুষকে যে চুম্বকের মতো টানবে, তা বলা বাহুল্য। এই প্রকল্পই পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলকে এ বার লোকসভা নির্বাচনে আরও বেশি আসনে জয় এনে দিয়েছে।

প্রবন্ধকার এখানে বলছেন, লক্ষ্মীর ভান্ডারের লভ্যার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ১১ লক্ষের বেশি। প্রত্যেককে মাসে গড়ে ১০০০ টাকা করে দিতে হলে বছরে সর্বমোট ২৫,৩২০ কোটি টাকা প্রয়োজন। অথচ, লক্ষ্মীর ভান্ডারের বাজেট দেখাচ্ছে ১৪,৪০০ কোটি। তা হলে বাকি টাকা কোথা থেকে আসবে? রাজ্যের কোষাগার ক্রমেই কৃশ হচ্ছে। কোটি কোটি টাকা খরচ করে বছর বছর বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন করেও কোনও শিল্পপতি এ রাজ্যে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ করতে উৎসাহ দেখাননি। অনুদান দিয়ে মানুষকে আর্থিক স্বাধীনতা এনে দেওয়ার রাজনীতি আসলে যে সোনার পাথরবাটি, এটা পশ্চিমবঙ্গ সরকার আর কবে বুঝবে? পূর্ববর্তী শাসক বামফ্রন্ট তাদের বিদায়কালে ৩ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ রেখে যায়। তা এখন বেড়ে প্রায় ৬ লক্ষ কোটি হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে। এক দিকে রাজ্যে শিল্প, কারখানা, কর্মসংস্থান নেই, অন্য দিকে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, বেআইনি অস্ত্রশস্ত্রের রমরমা এ রাজ্যের ভবিষ্যৎকে কোন পথে ঠেলে দিচ্ছে, সরকার কি তার হদিস দিতে পারবে? ভোটের রাজনীতি করতে গিয়ে রাজ্যের অর্থনীতিকে এত কুশ্রী করে তোলার কোনও অর্থ হয় কি?

মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১

স্কুলের ভূমিকা

‘অসুস্থ হয়ে ছাত্রের মৃত্যু, ধুন্ধুমার কুশমণ্ডির স্কুলে’ (১১-৭) প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এক জন শিক্ষক হিসাবে কিছু বলতে চাই। দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডির একটি স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র অভিজিৎ সরকার মিড-ডে মিলের লাইনে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেলে শিক্ষকেরা জল ঢেলে, বাতাস করে, ওষুধ দিয়ে তাকে সুস্থ করার চেষ্টা করেন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, ছাত্রটির বাবাকে খবর দেওয়া হলে তিনি স্কুলে আসেন। বাবা ছেলেকে নিয়ে ইটাহার হাসপাতালে রওনা দিলে পথেই মৃত্যু ঘটে ছাত্রটির। বেদনাদায়ক এই ঘটনার পরবর্তী অংশটি ভয়ঙ্কর। ছাত্রটির মৃত্যুর খবর জানাজানি হতেই এলাকার বাসিন্দাদের একটি অংশ স্কুলে চড়াও হয়ে প্রধান শিক্ষক-সহ চার জন শিক্ষককে মারধর করা, ১০-১২টি বাইকে অগ্নিসংযোগ, গ্রন্থাগার, অফিস, শ্রেণিকক্ষে ভাঙচুর চালানো, প্রধান শিক্ষকের ল্যাপটপ এবং সোনার চেন ছিনতাই করে বলে অভিযোগ উঠেছে।

স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রটির বাবার অভিযোগ, তাঁরা গাড়ি জোগাড় করে দেননি। স্থানীয় এক জন রাজনৈতিক নেতার মতে শিশুটিকে স্কুলে মিনিট পঁয়তাল্লিশ না রেখে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ব্যবস্থা করে যদি স্কুল কর্তৃপক্ষ হাসপাতালে নিয়ে যেতেন, তবে হয়তো বিপদ হত না। অভিযোগকে গুরুত্ব দিয়েও বলা যায়, এই ঘটনার প্রতিকার কি স্কুলের উপর আক্রমণের মাধ্যমে উঠে আসা সম্ভব? পুরনো কোনও রোগ, বা সেই দিনের কোনও বিশেষ ঘটনা, যা-ই মৃত্যুর কারণ হোক না কেন, শিক্ষকসমাজকে ‘গণশত্রু’তে পরিণত করা চলে কি? স্কুল কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ছাত্রটির মৃত্যুর ক্ষেত্রে কতটা দায়ী, তা তদন্তসাপেক্ষ। তবে মৃত্যুর খবর পেয়েই স্কুলের উপর চড়াও হওয়া কাঙ্ক্ষিত নয়।

প্রকৃতপক্ষে উচ্চ প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত পাশ-ফেল প্রথা উঠে যাওয়ায় এক শ্রেণির অভিভাবক এবং তাঁদের ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি কোনও ভালবাসা জন্মাচ্ছে না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের আইনি মারপ্যাঁচে জড়িয়ে দেওয়ার বিপজ্জনক প্রবণতা নষ্ট করে দিচ্ছে বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ।

এ বছর জুলাই মাসে দ্বাদশ শ্রেণির অভিভাবক সভায় আমাদের স্কুলে ৫৫ জন অভিভাবকের মধ্যে মাত্র চার জনকে পেয়েছি। অথচ, সরকারি প্রকল্পের বিষয়ে সভা ডাকা হলে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও উপস্থিতি ৯০ শতাংশের কম কখনও হয় না। সত্যিই মন ভেঙে যায় এই রকম ঘটনায়। বিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনার প্রকৃত পরিবেশ ফেরাতে হলে পড়াশোনা বাদে অন্যান্য জনকল্যাণমূলক সরকারি প্রকল্পের কাজ স্কুলের হাত থেকে সরিয়ে, অন্য কোনও উপায়ে বাস্তবায়নের উদ্যোগ করা দরকার। কারণ তাতে পড়াশোনা ব্যাহত হয়।

পাশাপাশি, শিক্ষকদেরও এই পেশার প্রাচীন মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করে নয়, বরং এলাকার আর্থসামাজিক বৈশিষ্ট্যকে উপলব্ধি করে, সেই অনুযায়ী অতীতের আদর্শ শিক্ষকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে, পাঠদানের কাজ সুশৃঙ্খল ভাবে চালাতে হবে। সমাজকেও মনে রাখতে হবে, শিক্ষকরা সমাজের শত্রু নন, তাঁরা শিশুদের মঙ্গলার্থে কর্তব্যরত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাতাবরণ যত তাড়াতাড়ি এমন স্বাস্থ্যকর ধারণাকে গ্রহণ করবে, ততই মঙ্গল। অন্যথায় শিক্ষক ও সমাজের এক অংশের মধ্যে চলতেই থাকবে এই ‘শত্রু শত্রু’ খেলা।

তন্ময় মণ্ডল, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement