— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
‘বুদ্ধিজীবীরা কোথায়?’ (১৫-৩) শীর্ষক লেখায় কৌশিক সেন যেমন নীরব-সরব শ্রেণিতে বুদ্ধিজীবীদের বিভক্ত করলেন, তেমনই সুকৌশলে এড়িয়ে গেলেন এই প্রশ্নটি— যাঁদের শ্রেণিবিভাগ তিনি করছেন, তাঁরা কি আসলে বুদ্ধিজীবী? তাঁরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করতেই পারেন। কিন্তু ফরাসি দার্শনিক জুলিয়েন বেন্দা মনে করতেন, বুদ্ধিজীবীরা জ্ঞানের পাশাপাশি জাতির সঙ্কটে নিজেদের জীবন তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন, তাঁদের কোনও জাগতিক মোহ নেই। আমাদের রাজ্যের অনেক বুদ্ধিজীবীই কিন্তু এই দলে পড়েন না— সে নীরব হোক বা সরব। ব্যতিক্রম প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ। কবি থেকে নাট্যকার, কেউ সরাসরি ডিগবাজি খেয়ে শাসকের পায়ে, তাঁরা হলেন নীরব। আবার যাঁরা ডান-বাম সব দিক ভেবে দু’চারটে মূল্যহীন বক্তব্য রাখছেন মিডিয়ায়, তাঁরা হলেন সরব। বাংলার এক শ্রেণির সুবিধাবাদী বুদ্ধিজীবী সাধারণ মানুষকে ভুল বুঝিয়ে নিজেদের স্বার্থ গুছিয়েছেন। শিল্পবিরোধী রাজনীতি করেছেন দিনের পর দিন। আজ সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম বুঝতে পারে তাঁদের ভুল। পার্ক স্ট্রিট, কামদুনি থেকে শুরু করে সন্দেশখালি, সর্বত্র রাজ্যবাসী দেখেছে তাঁদের দ্বিচারিতা।
রাজ্যের এই বুদ্ধিজীবীরা ফরাসি দার্শনিকদের কথা পড়েননি বা বোঝেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান পড়লে আজ পশ্চিমবঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের নীরব-সরব শ্রেণিতে ভাগ করতে হত না। আজ তাঁরা মানুষের পাশে নেই। অতএব শ্রেণি বিভাজন না করে, কিছু মানুষের আজ দরকার, না হলে গণতন্ত্র বাঁচবে না। বুদ্ধিজীবীরা আর মানুষের আবেগ নিয়ে খেলবেন না।
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
সত্যের প্রকাশ
কৌশিক সেন তাঁর প্রবন্ধে যথার্থই লিখেছেন, যাঁরা বাম শাসনের ‘পরিবর্তন’ চেয়েছিলেন, তৃণমূল আমলে শাসক দলের যাবতীয় অন্যায় তাঁদের উপরে বর্তাতে শুরু করে। ১৪ মার্চ ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে গণহত্যার প্রতিবাদে মহামিছিলে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা কলকাতার রাজপথে নেমেছিলেন। ছয় বছর পর ২০১৩ সালে সেই শঙ্খ ঘোষের ডাকেই পথে নামলেন শহরের বিশিষ্ট মানুষরা। কামদুনি-সহ রাজ্যের নানা প্রান্তে বাড়তে থাকা নারী-নির্যাতন ও ধর্ষণের প্রতিবাদে। তবে সেই মিছিলে সরকার পরিবর্তনের ডাক ছিল না, সরকারকে সতর্ক হওয়ার বার্তা পাঠানো হয়েছিল।
বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন, তার উত্তর কৌশিক সেন পরোক্ষ ভাবে নিজেই দিয়েছেন। নন্দীগ্রাম-সিঙ্গুর আন্দোলনের প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেওয়ার পূর্বে কবি শঙ্খ ঘোষ জানিয়েছিলেন, তিনি মিছিলে যোগ দেবেন যদি তা রাজনৈতিক মিছিল না হয়। কলকাতার ইতিহাসে পতাকাহীন প্রতিবাদ মিছিল বার বার ঘটেছে। কিন্তু গত ১২-১৩ বছরে কলকাতা সে রকম কোনও মিছিল দেখেনি, শঙ্খ ঘোষের আহ্বানে কামদুনির প্রতিবাদ মিছিল ব্যতীত। তাই প্রশ্ন জাগছে, বুদ্ধিজীবীরা নীরব কেন? বুদ্ধিজীবীরা কি এখন রাজানুগ্রহ লাভে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছেন? তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের বুদ্ধি ও বিবেচনা দিয়ে সঠিক কথাটা জনসাধারণকে জানাচ্ছেন না। তাঁরা কথা বলছেন নির্দিষ্ট ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য। প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের কর্তব্য সত্য উদ্ঘাটন করে সেটা জনসমক্ষে আনা, রাজপথে নেমে অথবা লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ করা, অন্যায় কাজের হেতু ও উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ। আজকের এই দুর্নীতি-মেঘাচ্ছন্ন আকাশে বুদ্ধিজীবীরা তাঁদের দায় নিয়ে এগিয়ে আসবেন, সেটাই প্রত্যাশা।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
যাঁরা অবিচল
বামেদের শক্ত ঘাঁটিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবিসংবাদিত নেত্রী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা কতটা সহযোগিতা করেছিলেন? না কি জনগণের চেতনাই রাতারাতি রাজনৈতিক অঙ্ক বদলে দিয়েছিল? কৌশিক সেন স্বয়ং নাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। আরও অনেকে যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পী ও চিন্তক বামফ্রন্ট সরকারের ব্যর্থতা এবং অপশাসনের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিলেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তাঁদের অনেকেই শাসক তৃণমূলের কৃপাপ্রার্থী হয়ে সরাসরি নিজেকে যুক্ত করলেন রাজনীতিতে। প্রবন্ধকার-সহ সেই সময়ের অনেক ব্যক্তিত্ব আজও নিজেকে ‘বামপন্থী’ হিসাবে দাবি করেন। এই ‘পন্থী’ ও ‘পন্থা’-র মধ্যে ব্যবধান বামফ্রন্ট সরকারের পতন নিশ্চিত করেছিল। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এই ব্যবধান রয়েছে, যার জন্য তাঁদের সমালোচনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ব্যক্তিসুখের প্রত্যাশী নেতাদের দিয়ে আর যা-ই হোক, বামপন্থার পথ সুগম হয় না। শাসনক্ষমতা দখল এবং সংসদীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে আগ্রহই বেশি। এই মনোভাবের কারণে আজ বামপন্থার দৈন্য বড়ই প্রকট। সামগ্রিক স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থ পূরণ প্রাধান্য পাচ্ছে। কলাকুশলী, নাট্য ব্যক্তিত্ব, শিল্পী, কেউই এই আবহাওয়ায় নিজেকে সামলে রাখতে পারছেন না। নিজের নিজের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা এবং পারঙ্গমতা স্ফুরণের জন্য যোগ্যতার চেয়েও রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য ভূমিকা পালন করছে।
সরকারের প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠার দৌড়ে এগিয়ে থাকতে গেলে সততাই সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। নিজে প্রকৃত অর্থে সাহসী, সাবলম্বী ও সৎ হয়ে উঠতে হবে। প্রলোভনে অবিচল থাকতে হবে। এ পথ নির্বান্ধব। তবুও আশা থাকে, এক দিন নিষ্ঠাবান মানুষরা এগিয়ে আসবেন নিজেদের প্রকৃত অর্থে ‘বুদ্ধিজীবী’ প্রমাণ করতে।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
শব্দদৌরাত্ম্য
আমার মতে, বছরে মাঝে মধ্যে বোর্ড পরীক্ষা থাকলে ভাল হত। বোর্ড পরীক্ষা (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) চলাকালীন দেখেছি শব্দ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খুব সজাগ থাকে প্রশাসন। অথচ, সারা বছরই শব্দ যন্ত্রণায় বিদ্ধ হয় মানুষ। রাস্তায় বেরোলে গাড়ির হর্নের অতিরিক্ত ব্যবহার, ছোটখাটো অনুষ্ঠানেও ডিজে বক্সের তীব্র আওয়াজ ও কানফাটানো শব্দবাজির আওয়াজে ভুগতে থাকি আমরা। অভিযোগ জানালেও প্রশাসনের তরফে দ্রুত উদ্যোগ করতে তেমন দেখা যায় না। কয়েক বছর নতুন দিল্লিতে থাকাকালীন দেখেছি, দীপাবলির পরের দিন গোটা শহরটাকে ধোঁয়ার আস্তরণে ঢাকা পড়ে যেতে। দেখেছি, ক্রমাগত শব্দবাজির আওয়াজে পাড়ার কুকুর, বেড়ালগুলি কী ভাবে ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। এক জন সাধারণ নাগরিক হিসাবে তাই যে কোনও অসহনীয় মাত্রার আওয়াজ বন্ধের দাবি জানাই প্রশাসনের কাছে। কারণ শব্দের প্রাবল্য আমাদের বধিরতা, হৃদ্যন্ত্রের ক্ষতির কারণ।
শুধু শব্দবাজি নয়, বাজির বিবিধ ক্ষতিকর প্রভাব দেখে ২০১৮ সালে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি এ কে সিক্রি এবং বিচারপতি অশোক ভূষণের ডিভিশন বেঞ্চ এক রায়ে জানায়, শুধুমাত্র নির্ধারিত দু’ঘণ্টা সময়ে বাজি পোড়ানো যাবে। ২০২১ সালে সর্বোচ্চ আদালত জানায়, কালীপুজো ও দেওয়ালিতে সন্ধ্যা ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত কেবলমাত্র সবুজ বাজি পোড়ানো যাবে। সবুজ বাজি মানেই যে পুরোপুরি নিরাপদ তা বলা যায় না, তবে এই ধরনের বাজি কম ক্ষতিকারক। শব্দদূষণের প্রাবল্য এক জন পূর্ণবয়স্ক কর্মক্ষম ব্যক্তির যতখানি ক্ষতি করে, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি করে গর্ভবতী মহিলা, শিশু, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের।
অপরের ক্ষতি হচ্ছে ও নিজের ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও, এই যে প্রচণ্ড শব্দ করে বক্স বাজানো ও তীব্র আওয়াজের শব্দবাজি ফাটিয়ে আনন্দ করতে চাওয়া— এর পিছনে কী কী কারণ থাকতে পারে তা সমাজতাত্ত্বিক ও মনস্তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করে জানালে হয়তো এই ধারাবাহিক সমস্যার সমাধানের উপায় পাওয়া যেতে পারে।
প্রশান্ত দাস,খলিসানি, হুগলি