রিজেন্ট পার্ক এলাকায় নিকাশি ম্যানহোলে নেমে চার শ্রমিকের মৃত্যু (‘ম্যানহোলে নেমে মৃত ৪’, ২৬-২) একটি বেদনাদায়ক খবর। যে কোনও মৃত্যুই বেদনাদায়ক, কিন্তু এই চার শ্রমিকের মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা, না কি এঁরা কোনও অব্যবস্থার শিকার, এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। ম্যানহোল পরিষ্কার করার জন্য বিশেষ ধরনের মেশিন আছে, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে সেই মেশিনের ব্যবহার এখনও সর্বজনীন করা যায়নি। যার ফলে মেশিনগুলি অকেজো হয়ে পড়ে আছে। একদা মানুষের মল মানুষই মাথায় করে বয়ে নিয়ে যেত। সেই অমানবিক প্রথা এখন আইনত বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একই কারণে ম্যানহোলে মানুষ নামানো অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত, এবং সেই কারণে মেশিনের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করাও অত্যন্ত জরুরি। সেটাই এই সময়ের দাবি।
কিন্তু এই সমস্যার একটা অন্য দিকও আছে। দীর্ঘ দিন ইস্পাত নির্মাণ প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এক শ্রেণির কর্মী ‘সেফটি রুল’ অগ্রাহ্য করে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করাই বেশি পছন্দ করেন। কাজের প্রতি তাঁদের নিষ্ঠা-উৎসাহ-উদ্যম অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। এঁরা যে কোনও প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। এঁরা কাজপাগল— কাজ করেন, নিয়ম বাঁচিয়ে চাকরি করেন না। যদিও ঝুঁকি নিতে গিয়ে এঁরাই মরেন, এবং বেঁচে থাকলে নিয়ম ভঙ্গের জন্য এঁরাই চার্জশিট পান। কিছু দিন আগে একটি বাড়ি তৈরির কাজে এমন এক জন উৎসাহী কর্মীকে বিপজ্জনক ভাবে তিনতলার ছাদের কার্নিশে ঝুলে কাজ করতে দেখে বললাম, “উপযুক্ত মই নিয়ে এসে কাজটা করছেন না কেন?” তিনি হাসতে হাসতে বললেন, “মই আনতে যত সময় যাবে, তার আগে আমার কাজটা শেষ হয়ে যাবে। তার উপর মই আনতে গিয়ে হয়তো শুনব মই নেই, অথবা দেখব সেটা ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে।”
সেফটি ডিপার্টমেন্টের লোকেরা প্রায়শই কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত থাকেন না, সেটা সম্ভবও নয়। তবে, এই ধরনের কর্মীদের এমন বিপজ্জনক উৎসাহ দমন করার দায় কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিরই নেওয়া উচিত। কিন্তু যে দেশে বেকার বেশি, লেবার সস্তা, সে দেশে এমন উৎসাহী কর্মীও থাকবে এবং বিকল মেশিনও থাকবে।
মানস বিশ্বাস, রাউরকেলা, ওড়িশা
ইতিহাস
সরকারি নিকাশি প্রকল্পের কাজে নেমে গত মাসে ম্যানহোলে চার জন শ্রমিকের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনা ১৯০৭ সালের একটি ঘটনার কথা মনে করিয়ে দেয়। দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুরে নফরচন্দ্র কুন্ডু নামে এক জন ব্যক্তি অফিস যাওয়ার সময় দেখতে পান ড্রেনের মধ্যে দু’জন শ্রমিক বিষাক্ত গ্যাসে আটকে পড়ে ছটফট করছেন। এই দৃশ্য দেখে তৎক্ষণাৎ তাঁদের উদ্ধার করার চেষ্টায় ড্রেনে নামলে সেখানে বিষাক্ত গ্যাসে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তাঁর স্মরণে ওই স্থানে ‘নফর কুন্ডু লেন’ নামে একটি রাস্তা ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘নফর কুণ্ডু’ শীর্ষক কবিতাটি আজও প্রাসঙ্গিক। পুর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা একশো বছর পরেও একই রকম।
অসিতাভ দাশ, কল্যাণী, নদিয়া
সেই শিশুরা
অশোক ঘোষ মহাশয়ের নিবন্ধ (‘একে মৃত্যু বলা যায়, না কি হত্যা’, ৪-৩) পাঠ করে মনে এল ব্রিটিশ কবি উইলিয়ম ব্লেকের বিখ্যাত কবিতা ‘দ্য চিমনি সুইপার’-এ বিবৃত বীভৎস এক শ্রমের কাহিনি। অষ্টাদশ শতকে ইংল্যান্ডের একটি অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় ছিল শিশুশ্রম প্রথা। অর্থাভাবে হতদরিদ্র বাবা-মা তাঁদের শিশুপুত্রদের বিক্রি করে দিতেন কারখানার মালিকদের কাছে। অভুক্ত, অর্ধনগ্ন এই সব শিশুর কাজ ছিল কলকারখানার বিশাল চিমনিগুলোর ভুসোকালি পরিষ্কার করা। এই জন্য তাদের ফেলে দেওয়া হত চিমনির উপরিভাগ থেকে। পড়ে গিয়ে, অথবা সারা দেহে ঝুলকালি মাখার ফলে অচিরেই বহু শিশুর মৃত্যু ঘটত। যারা টিকে থাকত, শ্বাসজনিত সমস্যার জন্য তাদের যন্ত্রণা থেকে যেত জীবনভর।
অসম লড়াইয়ে এই পরিযায়ী শ্রমিকদের অসহায় আত্মসমর্পণেও উঠে এল অনুরূপ দৃষ্টান্ত। এক দিকে মৃত্যুর চোখরাঙানি, অপর দিকে অর্থপ্রাপ্তির আশা, এই দোলাচলের সঙ্গেই চলে নিয়মমাফিক নিকাশি-নালা পরিষ্কারের কাজ। উপরন্তু কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা উপযুক্ত ক্ষতিপূরণের ক্ষীণ আশাটুকুও মুছে দেয়। “পেশাগত সুরক্ষা বিধি কাগজে-কলমে আছে, কিন্তু এ দেশে তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা নেই”— নজরদারির এহেন অনুপস্থিতিই ডেকে আনে মৃত্যুর এমন বীভৎস রূপ।
সুপ্রতিম প্রামাণিক, আমোদপুর, বীরভূম
নিয়ম কী
‘একে মৃত্যু বলা যায়, না কি হত্যা’ নিবন্ধের সঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছু সংযোজন করতে চাই। ক্ষেত্রবিশেষে মাটির নীচে কাজ করার জন্য নীচে নামতে হয়। সব কাজ উপর থেকে হয় না। অভিজ্ঞতা বলছে, যেখানে কাজ হবে, তার ম্যানহোলের সঙ্গে দু’দিকের কয়েকটি ঢাকনা খুলে দিতে হবে, বাতাস চলাচলের জন্য। সেখানে একটা বা দুটো ফ্যান দিতে হবে, যাতে বাইরের বাতাস ভিতরে ঢুকে অন্য দিক দিয়ে বেরিয়ে যায়। যদি কোনও বিষাক্ত গ্যাস থাকে, বেরিয়ে যাবে। জমা জল পাম্প করে বার করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় অন্তর সেফটি অফিসার ‘এক্সপ্লোসিভ মিটার’ দিয়ে ভিতরের বাতাস পরীক্ষা করবেন। অক্সিজেন এবং অন্য বিস্ফোরক গ্যাস কতটা আছে, তা জানা যাবে। অক্সিজেন ২০% হলে সেফটি অফিসার কাগজে কলমে ‘সেফটি পারমিট’ ঠিকাদারকে দেবেন। শ্রমিকরা যাতে তাড়াতাড়ি ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন, তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। সেফটি মাস্ক, অক্সিজেন সিলিন্ডার, দড়ি ইত্যাদি থাকবে। কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পুরসভার কর্মী, ঠিকাদার এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আমার বিশ্বাস, এই ব্যবস্থা করলে মৃত্যু আটকানো যাবে।
দেবকুমার ঘোষাল, কলকাতা-৫৫
মূল্যহীন
2 অশোক ঘোষ ঠিকই লিখেছেন, ম্যানহোলে নেমে কাজ করতে গিয়ে চার শ্রমিকের মৃত্যুর জন্যে শ্রমিকদেরই দায়ী করা হবে। এবং প্রমাণিত হবে যে, তাঁরা সুরক্ষাবিধি না-মেনে ম্যানহোলে নেমেছিলেন। সত্যিই তো, মহামান্য আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশাবলি থাকা সত্ত্বেও কেন এই শ্রমিকরা তা পালন করেন না? কেনই বা তাঁদের এই সব ‘কাজ’ এখনও করতে হয়? একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক শহর, ততোধিক আধুনিক জনজীবন। সেখানে তো কত আধুনিক কাজ আছে, তা না করে কিছু মানুষকে এখনও কেন ‘প্রাগৈতিহাসিক’ কাজ করে যেতে হয়! এই মৃত্যুগুলির না আছে রাজনৈতিক মূল্য, না আছে কোনও সামাজিক মূল্য। তাই তো বাম-ডান-অতি ডান, শিক্ষিত ও বৌদ্ধিক সমাজ— সবাই চুপ।
প্রসেনজিৎ সরকার, পেনসিলভেনিয়া, আমেরিকা\
দৃষ্টান্ত
মৃত যুবকের অঙ্গদানের স্বীকৃতি দিয়ে আবারও নজির গড়লেন বাবা (‘দুর্ঘটনায় মৃত যুবকের অঙ্গ চার গ্রহীতার শরীরে’, ৩-৩)। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবংয়ের বাসুদেব দাস অধিকারী বাইক দুর্ঘটনায় মারা গেলে বাবা শুকদেব দাস অধিকারী সিদ্ধান্ত নেন, ছেলের অঙ্গসমূহ দান করবেন। দেশে দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। প্রশাসনিক তৎপরতায় কিছুটা কমলেও সম্পূর্ণ নির্মূল করা যায়নি। জাতীয় স্বাস্থ্য পোর্টালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর ৫ লক্ষ মানুষ অঙ্গ না পাওয়ায় মারা যান। শুকদেববাবু যে নজির তুলে ধরলেন, তা অনেকের সচেতনতা বাড়াবে, ও অঙ্গদান কর্মসূচিকে ত্বরান্বিত করবে।
অমরেশ পাল, সাহাগঞ্জ, হুগলি