শিক্ষক ও দুর্নীতি।
‘অবিশ্বাস্য’ (১-১০) সম্পাদকীয়ের জন্য ধন্যবাদ। গত কয়েক মাস ধরেই রাজ্যে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। প্রতি দিন খবরের কাগজে শিরোনামে আমরা পাচ্ছি নিয়োগ দুর্নীতির খবর। শিক্ষকদের নিয়ে ওঠা এই ঢেউ সারা সমাজে ধীরে ধীরে চারিয়ে যাচ্ছে। ফলত এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি।
ছোটবেলা থেকে আমাদের শেখানো হয়েছে যে, শিক্ষা হল একটি জাতির মেরুদণ্ড। আজ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানোর লোকজন কম। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে যা ঘটে চলেছে, তাতে শিক্ষকসমাজের মাথা ক্রমান্বয়ে হেঁট হচ্ছে। আমার এক শিক্ষক বন্ধুর কাছে শোনা একটি কথা আমাকে প্রতিনিয়ত কুরে কুরে খাচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিকের এক ছাত্র তাঁকে প্রশ্ন করেছে, “স্যর, আমরা একটু নকল করলেই এত বকেন, আর শিক্ষামন্ত্রী যখন জেলে যান, তার বেলা?” এর কী জবাব দেবেন শিক্ষক? সমাজের প্রত্যেক শিক্ষক এক বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন। কে ঠিক, কে ভুল এই বিচার করতে বসে আজ সকলকেই এক দাঁড়িপাল্লায় মাপা হচ্ছে। শিক্ষকরা ধীরে ধীরে সমাজের চোখে যেন গণশত্রুতে পরিণত হয়েছেন। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে প্রশাসনের শীর্ষ পদে আসীন কোনও কর্তা যদি ইঙ্গিত দেন যে, সকলেরই চাকরি থাকবে, তখন ভাবতে হয় বইকি— আমরা কোন দিকে যাচ্ছি, কোথায় চলেছি?
শুভঙ্কর সাহা, সিন্দ্রাণী, উত্তর ২৪ পরগনা
কেন ব্যতিক্রম?
‘অবিশ্বাস্য’ সম্পাদকীয়টি অনবদ্য। নীতিহীনতা আজ কোন পথে রাজ্যকে গ্ৰাস করতে উদ্যত, তার বিবরণ পড়ে জীবন সায়াহ্নে স্তম্ভিত হয়ে যাই। ‘ব্যতিক্রমী’ শব্দের আড়ালে দুর্নীতিকে পাকাপাকি ভাবে সরকারি তকমা দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। তীব্র বিরোধিতা করি রাজ্য সরকারের এই অবস্থানের, ও আদালতে পেশ করা বক্তব্যের। সরকার হয়তো আশঙ্কা করছে, আদালতের নির্দেশমাফিক অযোগ্যরা চাকরি খোয়ালে, তাঁরা যদি এই চাকরি পাওয়ার নেপথ্য কাহিনি জোটবদ্ধ ভাবে বলতে শুরু করেন, সরকারকে চরম বিব্রত হতে হবে। তা থেকে স্বস্তি পেতে মুখ্যমন্ত্রীর সহানুভূতিশীল রূপটি সামনে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এই সূত্রে এটাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, ক্ষমতাবানদের সন্তানের যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে চাকরি পাওয়া, হারানো এবং যোগ্য প্রার্থীর পুনর্নিয়োগ রাজ্য সরকার ভাল ভাবে গ্রহণ করেনি, মানতে বাধ্য হয়েছে। কী করে রাজ্য সরকার এই দাবি আদালতের কাছে পেশ করল, সহজ বুদ্ধিতে এর ব্যাখ্যা মেলা ভার। আদালত সেই যুক্তি কী ভাবে গ্রহণ করে, সেটাই দেখার।
সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা-৩৫
সবাই হিন্দু?
‘ভাগবতদের ভারতদর্শন’ (২৯-৯) প্রবন্ধের শেষ লাইনে প্রেমাংশু চৌধুরী প্রশ্ন করেছেন, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত কি কখনও গুজরাতের বিলকিস বানোর সঙ্গে দেখা করেছেন? সুন্দর প্রশ্ন। কিন্তু তাতে বিজেপি, বা আরএসএস প্রধানদের কিছু যায়-আসে বলে মনে হয় না। ভারতকে ওঁরা এ বার হিন্দু রাষ্ট্র বানিয়েই ছাড়বেন। তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে। সেখানে বিলকিস বানোর কাছে গিয়ে দলীয় সদস্যদের কাজের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে যাবেন ভাগবত, তা কি ভাবা যায়? আরএসএস বলতে শুরু করেছে যে, সব ভারতীয়ই হিন্দু। এটা ঠিক যে, সনাতন হিন্দু ধর্মের ভাবনার জন্ম কয়েক হাজার বছর আগে, তুলনায় ইসলাম, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ ধর্ম অনেক পরে এসেছে। তা বলে কি সমস্ত ধর্মকেই হিন্দু ধর্মের কাছে বন্ধক দিতে হবে? এই বিজ্ঞানের যুগে, গণতান্ত্রিক পরিবেশে, এমন দাবি চরম বেমানান। বৈচিত্রের মধ্যে একতার আদর্শ, অহিংসা ও সহিষ্ণুতার নীতি ভারতকে বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসন দিয়েছে। বিজেপির উগ্র সাম্প্রদায়িক, হিন্দুত্ববাদী, পুরুষতান্ত্রিক, মনুবাদী ভাবনা ও শাসন আগামী দিনে এক বিরাট ধ্বংস, হানাহানি ডেকে আনতে পারে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির মধু খাব, আর কথায় কথায় হিন্দুত্ববাদী আচরণ চালিয়ে যাব, তা কী করে হয়? মোহন ভাগবত এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন আরএসএস-এর এই অবিরাম ধর্মীয় পেষণের সামনে দাঁড়িয়ে বিরোধীদের আগামী দিনে ঐক্যবদ্ধ হতে দেখা না গেলে, এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড শেষ হবে না বলেই মনে হয়।
মৃত্যুঞ্জয় বসু, কলকাতা-৩০
গর্ভের অধিকার
আমেরিকা যখন নারীর গর্ভের অধিকারে হস্তক্ষেপ করল, ভারত তখন নারীর গর্ভের পূর্ণ অধিকার নারীর হাতেই তুলে দিল। নারীর গর্ভের অধিকার নারীর নিজের, এমন ঐতিহাসিক রায় দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত। প্রাচীন কাল থেকেই নারীর গর্ভ নিয়ে সমাজপতিদের মাথাব্যথা দেখা গিয়েছে। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনিতে বনে-জঙ্গলে, নদীর পারে-আশ্রমে অবিবাহিত নারীর সন্তানকে বিসর্জন দেওয়ার অনেক দৃষ্টান্ত মেলে। অবিবাহিতা শকুন্তলা গর্ভবতী হলে তাঁর দুর্গতির শেষ ছিল না। দুনিয়ার প্রায় সব ধর্মই টিকে আছে নারীর গর্ভ তথা শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণকে পুঁজি করে। সাম্প্রতিক সময়ে ইরানে শুধুমাত্র ধর্ম নির্দেশিত পোশাক না পরার কারণে তরুণী মাহশা আমিনিকে পুলিশ মেরে ফেলল। ঘৃণায় শিউরে উঠেছে সভ্য সমাজ। নারীর শরীর কতটা ঢাকা থাকবে, নারী কত বার গর্ভধারণ করবেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ করা যাবে কি না, গর্ভপাত করা যাবে কি না, সব কিছু নির্ধারণ করে দেওয়ার মালিক হচ্ছেন ধর্মের প্রভুরা। বলা বাহুল্য, এই নির্ধারণকারীরা সকলেই পুরুষ। ১৯৫১ সালে মেক্সিকোর বিজ্ঞানী কার্ল জেরাসি আবিষ্কার করলেন গর্ভনিরোধক ওষুধ, যা মহিলাদের জীবন বদলে দিয়েছিল। সারা বিশ্বে মেয়েরা মুক্তির স্বাদ পেয়েছিলেন।
কিন্তু নারীর কি আর মুক্তি ঘটে? প্রেমিক পুরুষটি প্রায়ই তার অভিমুখ পরিবর্তন করে। তখন সঙ্কটে পড়েন নারী। গর্ভধারণের একটি নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে সেই সন্তানের জন্ম তাঁকে দিতেই হবে। এখন ২৪ সপ্তাহকে গর্ভপাতের নিরাপদ সময় ধরা হয়েছে। সামাজিক অপবাদের হাত থেকে বাঁচতে কত মেয়ে আত্মগোপন করে গর্ভপাত করছেন। আগে দাই-রা এই গর্ভপাতের কাজটি করতেন। এখন নার্সিংহোমে হয়। কত অবিবাহিত মেয়ে গর্ভপাত করাতে গিয়ে মারা গিয়েছেন, তার হিসাব নেই। তাই নারীকে বাঁচিয়ে রাখতে গর্ভপাতের অধিকার দেওয়াটা জরুরি। গর্ভপাতের ক্ষেত্রে নারী বিবাহিত, না অবিবাহিত— এটা বিবেচ্য হতে পারে না। গর্ভপাতের আইনি অধিকার সব নারীর ক্ষেত্রেই সমান হওয়া উচিত। তাই সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে, তাকে পূর্ণ সমর্থন করি।
এই রায়ের ফলে মেয়েদের কী কী সুবিধে হবে? প্রথমত, অবিবাহিত মেয়েরা গর্ভবতী হলে ডাক্তারি সাহায্য নিতে তাঁর কোনও আইনি ভয় থাকবে না। আইনের ভয় দেখিয়ে মোটা টাকা দাবি করা বন্ধ হবে। মেয়েদের প্রেম করা ও বেঁচে থাকাটা অনেক সহজ হবে। অনেকেই ভাবছেন, এই আইন মেয়েদের উচ্ছন্নে যাওয়ার পথে প্ররোচিত করবে। তাঁদের প্রতি সবিনয়ে বলি, প্রেম নারী ও পুরুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা। আইন দিয়ে, বা আইনের অভাব দিয়ে, তা কখনও নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি।
আমাদের সমাজে অবিবাহিত গর্ভবতী নারী বোঝেন, সামাজিক নিন্দা জিনিসটা কী। আইন তো বাঁচার শেষ হাতিয়ার মাত্র। নারী পরিস্থিতির শিকার, সাধ করে কেউ গর্ভপাত করতে যান না। শুধু আইন নয়, পাশাপাশি সমাজের চোখ আরও বেশি উন্মুক্ত হোক। নারীকে দেওয়া হোক পূর্ণ আকাশের অধিকার।
মৃণাল মাইতি, ডিভিসি, বাঁকুড়া