ভোট দেখে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে। বাবা ছিলেন কট্টর জাতীয় কংগ্রেসের সমর্থক। ভোটের সময়ে স্কুল ছুটির পর মিটিং-মিছিলে নিয়মিত যেতেন। ফিরতেন রাত করে। গ্রামের অনেকে অন্য পার্টি করলেও, কাউকে কোনও দিন এ সব নিয়ে কটূক্তি বা ঝামেলা করতে দেখিনি। ভোটপ্রার্থীরা এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে ঘুরে ঘুরে নির্ভয়ে প্রচার করতেন। তাঁদের ঘিরে কোনও বডিগার্ড বা পুলিশ থাকত না। তখন দেওয়াল লিখন, ব্যানার, হোর্ডিং— এ সব প্রায় চোখেই পড়ত না।
তবে বড় বড় পোস্টার ছাপা হত। তাতে প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার জন্য আবেদন করা হত। আর থাকত প্রার্থীর নাম ও দলের প্রতীক। বাবা ভোটের সময় ওগুলো বাড়িতে নিয়ে আসতেন। আমাদের উপর দায়িত্ব পড়ত পোস্টারগুলো বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে দেওয়ার। আমরা একটা পাত্রে খানিকটা ময়দা জলে গুলে উনুনে গরম করে আঠা তৈরি করতাম। ওই আঠা দিয়ে পোস্টারগুলো এখানে-ওখানে লাগিয়ে দিতাম। মনে আছে, এক বার গোটা দুই পোস্টার প্যাকেট থেকে সরিয়ে রেখে বইয়ের মলাট করেছিলাম। পরে বাবার চোখে পড়ায় খুব বকুনিও খেয়েছিলাম।
আমাদের গ্রামের ভোট কেন্দ্র ছিল ফাঁকা মাঠের মাঝখানে একটা স্কুলে। স্কুলের নাম নারায়ণবাড় হাই স্কুল। ভোটের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে প্রিসাইডিং অফিসার দলবল সমেত সেখানে এসে যেতেন। তাঁদের সঙ্গে থাকত আমাদের গ্রামের চৌকিদার। তাঁর উপর ভোটবাবুদের দেখাশোনা ও খাবারদাবারের দায়িত্ব পড়ত। ও সব জায়গায় দোকানপাট, হোটেল এ সব কিছু ছিল না। গ্রামের গৃহস্থ পরিবারের রান্না করা খাবার ওঁরা তৃপ্তির সঙ্গে খেতেন। আমাদের বাড়ি থেকেও দু’এক বার এ রকম খাবার পাঠাতে দেখেছি। খাবার খেয়ে রাতের মধ্যে ভোট কেন্দ্র সাজিয়ে নিতেন ওঁরা।
ভোটের দিন আমরা ছোটরা ঘুম থেকে উঠে পড়তাম ভোরবেলা। গোটা দুই মাদুর বগলে নিয়ে বাবার পিছু পিছু গিয়ে ভোট কেন্দ্রের কিছুটা দূরে সেগুলো পেতে বসতাম। গ্রামের লোকজন ভোট দিতে যাওয়ার আগে আমাদের কাছে এসে বসতেন। বাবা সাদা টুকরো কাগজে ভোটার তালিকা থেকে নাম ও কী সব নম্বর লিখে দিতেন। ওঁরা সেই কাগজ নিয়ে ভোট কেন্দ্রে যেতেন এবং হাসিমুখে বেরিয়ে আসতেন। আমাদের মতো অন্য দলের আরও দু’একটি ক্যাম্প পাশাপাশি থাকলেও কোনও দিন গোলমাল হতে দেখিনি। দেখিনি কোনও ‘খেলা’ হতে। দেখেছি প্রত্যেকের মধ্যে সৌহার্দ বজায় রাখতে, প্রত্যেককে ভোট দেওয়ায় সাহায্য করতে।
‘রিগিং’, ‘ছাপ্পাভোট’, ‘বুথ দখল’ শব্দগুলো কলকাতায় এসে প্রথম শুনলাম। আর কিছু কিছু স্বচক্ষে দেখলাম, নিজে প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছিলাম যখন।
অমরনাথ করণ, কলকাতা-৬০
ভোট নষ্ট?
যে দল ক্ষমতায় আসতে পারবে সেই দলকেই ভোট দেব, অন্য দলকে ভোট দেওয়া মানে ভোট নষ্ট, নির্বাচনের আগে জনতার একাংশের মনে এমনই চিন্তাধারা চলতে থাকে। এই প্রবণতা অবশ্য বিভিন্ন গদিলোভী দল তৈরি করেছে। যে দিকে হাওয়া, সে দিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা ভয়াবহ। এই হাওয়াটাকে আরও প্রবল করে এক শ্রেণির গণমাধ্যম। প্রতিটি রাজনৈতিক দলের প্রত্যেক প্রার্থীকে সমান প্রচার অনেক গণমাধ্যমেই দেয় না। হাওয়া নয়, যে দলকে সঠিক মনে হবে সেই দলকেই ভোট দেব— এই চিন্তা নিয়ে ভোট দেওয়া দরকার সবার। কে ক্ষমতায় আছে, কে ক্ষমতায় আসতে পারে, কার এমপি এমএলএ আছে, কে বড় দল, কে ছোট দল— এ সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে জনতার ভাবা উচিত কোন দল জনগণের সমস্যা সমাধানে আন্দোলন করে, কোন দলের নেতা-কর্মীরা নীতি আদর্শের ভিত্তিতে ব্যক্তিগত জীবন-সহ রাজনৈতিক জীবন পরিচালনা করে।
ভোটের আগে জনমত সমীক্ষা প্রকাশ করছে কিছু সংস্থা। প্রায় ১০ কোটি জনসংখ্যার রাজ্যে সেখানে মাত্র কয়েক হাজার মানুষের মতামত নিয়ে সমীক্ষা বেশির ভাগ জনগণের মতামত প্রতিফলিত করে না। এই জনমত সমীক্ষা মূলত দু’টি দলের হয়ে হাওয়া তোলার কাজটা করে। হয় এই দল, নাহয় ওই দল। ভোটের আগে জনমত সমীক্ষা প্রকাশ বন্ধ করা প্রয়োজন।
ভোট কোনও উৎসব নয়। ভোট কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিন। এ জন্য প্রত্যেক ভোটার নিজের বিধানসভা এলাকার প্রার্থীদের বিশ্লেষণ করে দেখবেন। প্রার্থীদের দলের নীতি, কাজকর্ম এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল হবেন। এর পর যে প্রার্থীকে সঠিক মনে হবে, তাঁকেই ভোট দেবেন।
সাধারণ মানুষ যে দলকে ভোট দেন, সেই দলের প্রতি একটা আবেগ থাকে। কিন্তু সেই দলেরই নেতা-মন্ত্রীরা এক দলে টাকা কামানো শেষ হলে অন্য দলে চলে যাচ্ছেন। শাসক দলগুলো রাজনীতিকে ব্যবসায় পরিণত করেছে। আবার সাধারণ মানুষের একাংশের মধ্যেও ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়ার মানসিকতা কাজ করে। পঞ্চায়েত-ঘনিষ্ঠ থাকলে সহজে একশো দিনের কাজ-সহ কিছু সরকারি সুবিধা পাওয়া যাবে— এই ভেবে অনেকেই শাসক দল ঘেঁষে থাকেন। শাসক দলের প্রতি ঘৃণা থাকলেও তার পক্ষেই ভোট দেন।
এই চাওয়া-পাওয়াটাও বড় করে দেখতে হবে। সরকারি সুযোগ সুবিধা যাতে সবাই পান, তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাই ভাবতে হবে, চাকরির সংস্থানের জন্য কোন দল কী করছে? বছরের পর বছর নিয়োগ নেই। শূন্যপদের অবলুপ্তি ঘটছে। যতটুকু নিয়োগ ভোটের স্বার্থে হচ্ছে, সেখানেও ভয়াবহ দুর্নীতি। শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ মানে সাধারণ জনগণকে বিপদে ফেলা। তাই যে দল শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বেসরকারিকরণ রুখে দিয়ে সরকারি শিক্ষা-স্বাস্থ্যের উন্নতির পথ দেখাচ্ছে, সেই দলের দিকে ভোট দেওয়ার প্রবণতা প্রয়োজন।
আমি ভোট দেব সেই দলকেই, যে দল বেকার সমস্যা সমাধানে সঠিক দিশা দেখাবে, সরকারি শিক্ষা, স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটানোর সদিচ্ছা দেখাবে, সরকারি চাকরির সুযোগ বৃদ্ধির কথা বলবে, শূন্যপদের অবলুপ্তি না ঘটিয়ে প্রতি বছর দুর্নীতিমুক্ত ভাবে চাকরিতে নিয়োগ করবে, কৃষকের ফসলের ন্যায্য দাম দেবে, শ্রমিকের কাজের নিশ্চয়তা দেবে, কৃষিজাত পণ্য উৎপাদনের সরঞ্জাম তৈরির জন্য সরকারি ভাবে কারখানা খুলবে।
আব্দুল জলিল সরকার, হলদিবাড়ি, কোচবিহার
বিশেষ ট্রেন
আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন প্রচুর মহিলা ভোটকর্মী নিয়োগ করেছে। বুথপিছু ভোটার সংখ্যা কমলেও ভোট গ্রহণের সময়সীমা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভোট গ্রহণের পরও আনুষঙ্গিক ক্রিয়াকর্ম শেষ করে রিসিভিং সেন্টারে সমস্ত কিছু জমা দিয়ে রিলিজ় পেতে অধিক রাত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ভোটকর্মীদের, বিশেষ করে মহিলা কর্মীদের রাতে বাড়ি ফেরার তাগিদ থাকাটাই স্বাভাবিক। সে দিকে খেয়াল রেখে রাজ্য পরিবহণ ব্যবস্থার সঙ্গে যদি সারা রাত পুলিশি সুরক্ষা-সহ বিশেষ ট্রেন চালানোর উদ্যোগ করা হয়, তা হলে বহু ভোটকর্মী ভোটপর্ব সম্পন্ন করার পর নিশ্চিন্তে ঘরে ফিরে স্বস্তি পেতে পারেন।
রত্না মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৬
আধঘণ্টা
আসন্ন বিধানসভা ভোটে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছি। ভোটের কাজ করতে যাওয়া যে কী নিদারুণ অভিজ্ঞতা, তা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। এ বারের ভোট তো আরও বেশি সময়ের। ভোটের দিন ভোর চারটেয় উঠে সাড়ে পাঁচটায় ‘মকপোল’ শুরু করে, সাড়ে ছ’টায় শেষ (যদি হয়) করা। মাননীয় নির্বাচন কমিশনের কাছে অনুরোধ, দুপুরে অন্তত আধঘণ্টা খাওয়ার জন্য সময় বরাদ্দ করুন, যাতে ভোটকর্মীরা একটু নিশ্চিন্তে দুপুরের ভাতটা মুখে তুলতে পারেন!
দেবাশিস বড়ুয়া , কলকাতা-১১০