—ফাইল চিত্র।
‘বর্বর জয়ের উল্লাসে’ (৩-১১) শীর্ষক প্রবন্ধে সেমন্তী ঘোষ যথার্থই বলেছেন, বিবেকবান ভারতীয় নাগরিকের মাথা আজ নিচু হয়েছে, লজ্জায়, আত্মধিক্কারে। স্বাধীন ভারত কখনও প্রতিবেশী দেশের ভূখণ্ড দখল করে রাখেনি, যা ইজ়রায়েল করেছে। তা হলে আমরা কী করে পাকিস্তানের মদতে ভারতের উপর সন্ত্রাসবাদী হামলার সঙ্গে ইজ়রায়েলের উপর হামাসের হামলার তুলনা টানতে পারি? রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস যথার্থই বলেছেন, ইজ়রায়েলের উপর হামাসের হামলা শূন্য থেকে হয়নি। প্যালেস্টাইনের মানুষ ৫৬ বছর ধরে দম আটকানো দখলদারিত্বের অধীনে বাস করছেন। তাঁরা হিংসায় জর্জরিত, বাস্তুচ্যুত। তাঁদের অর্থনীতি বিপর্যস্ত।
ক্ষুদিরাম বসু এবং প্রফুল্ল চাকী কিংসফোর্ডকে মারার উদ্দেশে যে বোমা ছুড়েছিলেন, সেই বোমার আঘাতে মারা গিয়েছিলেন এক ব্রিটিশ মহিলা ও তাঁর মেয়ে। কিন্তু এর জন্য কি আমরা ব্রিটিশদের জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন জানাব? ৭ অক্টোবরের হামাস আক্রমণের পর ইজ়রায়েল যে হত্যালীলায় মেতে উঠেছে, তা জালিয়ানওয়ালা বাগকে লজ্জা দেবে। গাজ়ার ‘কিলিং ফিল্ড’-এ মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দশ হাজার, যার মধ্যে রয়েছে চার হাজার শিশু।
ভিয়েতনাম থেকে পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ), স্বাধীন ভারত বরাবর তার বৈদেশিক নীতিতে নিপীড়িতের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। ভারত প্রথম থেকেই ইজ়রায়েলের প্যালেস্টাইন দখলের বিরুদ্ধে কথা বলেছে। চেয়েছে, ১৯৯৩-এর অসলো চুক্তি অনুযায়ী দু’টি দেশের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। ভোট না দেওয়ার কারণ হিসাবে দেখানো হয়েছে যে, ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের উপর হামাস আক্রমণের নিন্দা রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ছিল না। কিন্তু এই যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ, ওই প্রস্তাবে অসামরিক মানুষের উপর প্যালেস্টাইন এবং ইজ়রায়েল, এই দু’পক্ষেরই আক্রমণের নিন্দা করা হয়েছে।
মানবিকতার দিক থেকে তো বটেই, ভারতের এই ভোট না দেওয়া বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রেও এক বড় বিপর্যয়। কারণ, এর ফলে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রিকস দেশগুলির মধ্যে একা হয়ে গেল। ভারত ছাড়া বাকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ব্রিকস অন্তর্ভুক্ত অন্য দেশগুলি (ব্রাজ়িল, রাশিয়া, চিন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।
এর প্রথম কুফল ফলেছে কাতারে। কাতারের আদালত ভারতের নৌসেনার আট জন প্রাক্তন কর্তাকে যে প্রাণদণ্ড দিয়েছে, সে বিষয়ে কাতার ভারত সরকারকে অন্ধকারে রেখেছিল। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অভিজ্ঞদের মতে, কাতারের মতো একটি বন্ধু দেশের এমন শীতল আচরণের কারণ, প্যালেস্টাইন বিষয়ে ভারত এবং কাতারের ভিন্ন অবস্থান। এটা খুবই উদ্বেগের বিষয়। কারণ, কাতারে বহু ভারতীয় বাস করেন। তা ছাড়া ভারতে তরল প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহকারী দেশগুলির মধ্যে প্রধান হল কাতার।
ভারতের বৈদেশিক নীতি নির্ধারকদের ভেবে দেখা প্রয়োজন, মলদ্বীপ কেন ভারতকে ছেড়ে চিনের হাত ধরল। গত সেপ্টেম্বর মাসে মোহামেদ মুইজ্জু মলদ্বীপে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতেছেন এই প্রতিশ্রুতির উপর ভর করে যে, তিনি ভারতকে ছেড়ে চিন-ঘেঁষা বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করবেন।
প্যালেস্টাইন, মলদ্বীপ, চিন, সব ক্ষেত্রেই অতীতে ভারত যে বৈদেশিক নীতি গ্রহণ করে চলেছিল, তার থেকে বিচ্যুত হলে বড় মাসুল গুনতে হবে।
সুজিত দে, কলকাতা-১১০
কে অমানবিক?
সেমন্তী ঘোষ আক্ষেপ করেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভারত সম্মতির ভোট দেয়নি। প্রবন্ধকারকে প্রশ্ন, আক্রমণকারী কে? কারা প্রথম ইজ়রায়েলে রকেট আক্রমণ করে অসংখ্য নিরপরাধ শিশু, নরনারী হত্যা করল, ইজ়রায়েলিদের অপহরণ ও পণবন্দি করল? যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে হামাসের এই বর্বরতার কোনও নিন্দার উল্লেখ ছিল কি? কানাডার দাবিমতো, প্রস্তাবে নিন্দার উল্লেখ করার কথা বললেও তা মানা হয়নি। তা কোন মানবিক কারণে? হামাসের রকেট হামলায় হাজার হাজার প্রাণ গেলে তা কি ন্যায়সঙ্গত? আর আত্মরক্ষায় ইজ়রায়েল ড্রোন আক্রমণ করলেই সেটা অমানবিক? মানবিকতার এমন প্রকারভেদ করা চলে না।
প্রবন্ধকার লিখেছেন, প্যালেস্টাইনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নির্যাতনই হামাসকে তৈরি করেছে। তাঁর বক্তব্য, নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে হিংসা পরিত্যাজ্য, সব সময়ে, সব পরিপ্রেক্ষিতে। তা যদি হয়, তা হলে এই হিংসা-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে ভারত যখন একপেশে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে (যেখানে হামাসের হিংসা-সন্ত্রাসের নিন্দা করা হয়নি) ভোটদানে বিরত থেকেছে, তখন কেন বিবেকবান ভারতীয় নাগরিকদের মাথা নিচু হবে? দীর্ঘ দিন ধরে ভারত সন্ত্রাসবাদের শিকার। কাজেই সন্ত্রাসবাদের নিকাশ না হলে কোনও শান্তি যে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না, সেটা ভারত উপলব্ধি করতে পারে। কাশ্মীরই যে তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
মিহির কানুন, গোকলকাতা-৮১
অনিদ্র বিবেক
অম্লানকুসুম চক্রবর্তীর ‘আছি সুখে হাস্যমুখে’ (১০-১১) লেখাটি যে কোনও সংবেদনশীল মানুষের বিবেককে প্রবল ঝাঁকুনি দেবে। হামাসের আচমকা হামলার বদলা নিতে ইজ়রায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর নির্দেশে যে ভাবে নির্বিচারে গাজ়া ভূখণ্ডে বসবাসকারী শিশু ও মহিলা-সহ সাধারণ নাগরিকদের হত্যা চলেছে, তা সম্ভবত অতীতের সব বীভৎসতাকে ছাপিয়ে গিয়েছে। এই হত্যাকাণ্ডে ইজ়রায়েলের শক্তি বৃদ্ধি করেছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও তাঁর সঙ্গীদের উদ্বাহু সমর্থন। ‘লাইভ টেলিকাস্ট’-এ প্রদর্শিত হচ্ছে বিপুল সমরাস্ত্রের সম্ভার, যা কেবলমাত্র প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের সম্পদ ধ্বংস আর প্রাণহরণ করার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষ দলে দলে উদ্বাস্তু শিবিরে স্থান নিচ্ছে, কোনও মতে জীবন ধারণ করছে। এ সব দেখেও আমরা কেন নির্বিকার চিত্তে খেলা-মেলা-বাজার করা-বেড়াতে যাওয়া, কিংবা বিভিন্ন উৎসবে মগ্ন হয়ে থাকতে পারছি? এ প্রশ্ন কি আমরা নিজেকে করব না?
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সংবেদনশীল মানুষেরা ইজ়রায়েলের হানার প্রতিকার চেয়ে পথে নেমে বিক্ষোভ, মিছিল, সমাবেশ করে যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছেন। এই সময়ে তাঁদের পাশে না থাকলে তো সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই অস্বীকার করা হয়। এক দিকে আমরা নিজেকে বিশ্ব নাগরিক হিসাবে জাহির করব, আর অন্য দিকে যুদ্ধের বীভৎসতা দেখেও চুপ করে ঘরে বসে থাকব, এটা দ্বিচারিতা। মানুষের দুর্দশা দেখে যে সমব্যথী মনটা কেঁদে উঠত, সেই মনটাই যেন আজ নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে। তাই বিশ্বকাপের ক্রিকেট ম্যাচটাই বড় যুদ্ধ বলে মনে হয়। তারা নির্দ্বিধায় বলতে পারে, “আপনি একটু বেশি জেনে ফেলেছেন মনে হচ্ছে, দাদু।”
হ্যাঁ, সত্তরোর্ধ্বদের একটা অংশ এখনও যুদ্ধবিরোধী মিছিলে চে গেভারার ছবিওয়ালা টি-শার্ট ছাড়াই হাঁটেন। এই পদাতিকের দল যে থামতে শেখেননি। উদাসীনতা দেখিয়ে কিছু না দেখার ভান করে দূরে থাকতে পারেন না। আজ যে বিবেকবান তরুণ-তরুণীরা ভোগবিলাসের প্রবাহে গা ভাসিয়ে না দিয়ে, বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মের মধ্যে এগিয়ে আসতে উৎসাহী হয়, তারা অধিকাংশই এঁদের হাতে তৈরি।
বিশ্বের পরিবেশ ধীরে ধীরে নরক হয়ে উঠছে। ছোট ছোট শিশু যদি প্রতিনিয়ত এমন বীভৎসতার সংবাদ শুনে ও ছবি দেখে বড় হয়, তা হলে ওদের সংবেদনশীল সহমর্মী মনটাই তো ভাল করে গড়ে ওঠার সুযোগ পাবে না। চার পাশে নির্মমতার ছবি দেখতে দেখতে সব কিছুই ওদের গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে। ওরাই বড় হয়ে এক দল আত্মসুখ সর্বস্ব, স্বার্থপর মানুষে পরিণত হবে, এতে আশ্চর্যের কিছু নেই।
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা