মণিপুর হিংসার তিন মাস অতিক্রান্ত। —ফাইল চিত্র।
জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ “কোন ‘গণ’র তন্ত্র?” (২৮-৭) প্রসঙ্গে এই চিঠির অবতারণা। লেখাটি যেন মনুষ্যত্বের মূল ধরে নাড়া দেয়। আত্মপ্রশ্নে ধিক্কৃত করে আমাদের, প্রশ্ন করে কোন ‘গণ’র অংশ আমরা? আতঙ্কে, লজ্জায় বিহ্বল হয়ে পড়ি। মনে হয়, আমরা যেন এক ‘ডিসটোপিয়া’য় বাস করছি। আজ মণিপুর হিংসার তিন মাস অতিক্রান্ত। মৃত্যু শতাধিক, বাস্তুচ্যুত প্রায় ৬০০০০, নারী নির্যাতন— এটা বোধ হয় সংখ্যা দিয়ে বিচার না করাই শ্রেয়। সব তথ্যই সরকারি। এর সঙ্গে আছে লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, সংখ্যালঘুদের চার্চ পোড়ানো। রাজ্যের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বহু আলোচিত সেই ভিডিয়োটি যেন আমাদের বার বার শিহরিত করে, ঘুমের মধ্যে হানা দেয় এক বিকট উল্লাস আর অসহায় হাহাকার। দীর্ঘ দিন ইন্টারনেট বন্ধের আড়ালে মানবতার বিরুদ্ধে ঠিক কত অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, তার হিসাব আর কোনও দিন পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ। এই পরিস্থিতিতে সমস্ত বিরোধী দলের সরব দাবি উপেক্ষা করে রাষ্ট্রপ্রধান আজও নীরব, নীরব দেশের সুবৃহৎ সুশীল সমাজ। শাসকের কাছে এই নীরবতা আজ অনুমোদনেরই লক্ষণ। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথায় বলতে ইচ্ছে করে, “ফিরাবে বিমল চক্ষু কোন্ দিকে ফিরাবে/ কার হাতে রক্ত নেই?”
আইনের শাসন, সংবিধানকে এই ভাবে পরাজিত হতে ভারতবাসী আগে দেখেছে কি? দিনের শেষে শুধু ভাবতে ইচ্ছে করে, কিসের তাড়নায় বা কোন মনস্তত্ত্বে আপাত সাধারণ মানুষ এত হিংস্র হয়ে ওঠেন! বার বার দেখা যায় গোষ্ঠী সংঘর্ষে, দাঙ্গার সময় পরিচিত, পড়শি বা বন্ধুরাই কেমন ‘অপর’-এর প্রতি ঘৃণা নিয়ে এগিয়ে যায়, নেতৃত্ব দেয়। হত্যা-লুণ্ঠন-নারী নির্যাতনে চেনা মানুষগুলোই আক্রান্তের কাছে যেন ভিনগ্রহের জীব হয়ে যায়। বার বার যেন অনুরণিত হয় জীবনানন্দ দাশের সেই অমোঘ লাইনগুলো, “মানুষ মেরেছি আমি— তার রক্তে আমার শরীর/ ভ’রে গেছে; পৃথিবীর পথে এই নিহত ভ্রাতার/ ভাই আমি; আমাকে সে কনিষ্ঠের মতো জেনে তবু/ হৃদয়ে কঠিন হ’য়ে বধ ক’রে গেল, আমি রক্তাক্ত নদীর/ কল্লোলের কাছে শুয়ে অগ্রজপ্রতিম বিমূঢ়কে/ বধ ক’রে ঘুমাতেছি...।” মানুষের মনের গভীরে বোধ হয় হিংসার এই বীজ বপন করে দেওয়া যায়। তাকে পরিণত করা যায় এক চলমান হত্যাযন্ত্রে— যার মানবিক কোনও বোধই আর কাজ করে না। না কি এ ফ্রয়েডের সেই ‘গ্রুপ সাইকোলজি’, যেখানে সমুদায় আর তার নেতার মধ্যেই তার আত্মবিলীনতা, তার একমাত্র আত্মপরিচয়, এক বোধহীন আচ্ছন্নতা। না হলে কোন যুক্তিতে, কোন ব্যাখ্যায় এক নারী অন্য এক নারীকে হিংস্র পুরুষ নরখাদকের মুখে ঠেলে দেয়, শুধু সে ‘অপর’ বলে!
বহু প্রশ্নেরই আজ উত্তর মেলে না। শুধু চোখের সামনে দেখতে পাই চার পাশের চেনা মানুষগুলো কেমন ক্রমশ বিদ্বেষপূর্ণ, মনে মনে হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। এই পত্র লেখার সময়ে খবরে দেখা যাচ্ছে হরিয়ানার নুহ’তে গোষ্ঠী সংঘর্ষের চিত্র— প্রাণহানি অগ্নিসংযোগ আর লুটতরাজ। বিদ্বেষ আর হিংসার যেন এক অবিরাম স্রোত চলছে। এটাই কি নতুন ভারত?
অনিন্দ্য ঘোষ, কলকাতা-৩৩
আশ্বাসহীন
“কোন ‘গণ’র তন্ত্র?” প্রবন্ধে জাগরী বন্দ্যোপাধ্যায় মণিপুরের জ্বলন্ত সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত সময়োপযোগী এক জ্বলন্ত প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন। জানি না, এই প্রশ্ন কাকে, কোথায়, কতটা বিদ্ধ করবে, না কি আদৌ করবে না। যে হিংস্র, অমানবিক ঘটনার কথা সামনে এসেছে, চূড়াচাঁদপুরে জমায়েত হওয়া জনতার সঙ্গে গলা মিলিয়ে তার তীব্র প্রতিবাদ করছি। কিছু দিন আগেই আমরা জেনেছি যে, পারস্পরিক হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকা মণিপুর নিয়ে, প্রায় আড়াই মাস বাদে প্রধানমন্ত্রী মোদীজি সংসদে খুবই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, যা মণিপুরবাসী-সহ দেশের জনগণের কাছে অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়। আক্ষেপের গভীরতা আরও বাড়ে এই জন্য যে, মণিপুর রাজ্যে তাঁরই দলের শাসন চলে, অথচ তিনি এমন কোনও আশ্বাস দেননি যাতে রাজ্যে অচিরে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসে। লেখিকার লেখনীতে, আক্রান্ত মহিলার সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে, “...সবাই যখন পালাতে ব্যস্ত, তখন পুলিশই তাঁদের পাঁচ জনকে ধরে উন্মত্ত জনতার হাতে তুলে দেয়।” অত্যন্ত ভয়াবহ। এই ভয়াবহতার মাত্রা নির্ধারণ করা যায় না। উত্তর হয়তো আছে, কিংবা নেই। কিন্তু প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, সরকারের ইচ্ছেটা কি? তাঁর কোনও এক অতীতের ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ কি তা হলে নিছকই নাটকসর্বস্ব ছিল? রাজ্যের প্রশাসনিক শক্তি দিয়ে যখন হচ্ছে না বা তারা যখন পক্ষপাতদুষ্ট, তাঁর নিরপেক্ষ সামরিক বাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী, বা কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠিয়ে শক্ত হাতে একে কি নির্বাপিত করতে পারতেন না? না কি এখনও পারেন না?
বিশ্বনাথ মুর্মু, খাটখুরা, ঝাড়গ্রাম
উলুখাগড়া
‘রাজনৈতিক আবাস’ (২৮-৭) সম্পাদকীয়টির সঙ্গে সহমত পোষণ করে কিছু কথা। কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য আদায় করার পরিবর্তে দলীয় স্বার্থসিদ্ধি করার জন্যই মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের অর্থে ১১.৩৬ লক্ষ বাড়ি তৈরির কথা ঘোষণা করেছেন। আবার কেন্দ্র ও এই রাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে ক্ষমতা জাহিরে ব্যস্ত। কেন্দ্র-রাজ্যের এই রাজনৈতিক তরজায় মানুষ প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
একই কথা প্রযোজ্য মনরেগা প্রকল্পের ক্ষেত্রে। দুই সরকারের তরজায় রাজ্যে একশো দিনের কাজ বন্ধ। অথচ, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা আইন অনুসারে, জব কার্ড থাকা পরিবার আবেদন করলে কাজ পাওয়ার অধিকারী। কাজ না পেলে বেকার ভাতা পাবে। আইন অনুসারে মনরেগায় মজুরি বকেয়া রাখা যায় না। কেন্দ্র ও রাজ্যের সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক লড়াইয়ে রাজ্যের মানুষ সেই আইনি অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
মুখ্যমন্ত্রী ২১ জুলাইয়ের সমাবেশ থেকে মনরেগার পাল্টা ‘খেলা হবে’ নামক প্রকল্পের কথাও ঘোষণা করেছেন। আইনি অধিকার এ ভাবেই নিছক সরকারের অনুগ্রহপুষ্ট প্রকল্পে পরিণত হচ্ছে। গণতন্ত্রের পরিবর্তে সরকার ও নাগরিকের সম্পর্কটা রাজা-প্রজায় রূপান্তরিত হচ্ছে।
অথচ, ১৯৯২ সালের সংবিধানের ৭৩তম সংশোধনী অনুসারে, গ্রামবাসীরা এই সব কাজে সরাসরি যোগদানের অধিকারী। মনরেগা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রভৃতি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা কেন্দ্রীয় ফাইনান্স কমিশনের মাধ্যমে পঞ্চায়েতে আসবে। পঞ্চায়েত সেই কাজ করবে। রাজ্য সরকার নজরদারি করবে এবং কেন্দ্রকে হিসাব দেবে।
রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনানুযায়ী, জনসাধারণই পঞ্চায়েতের উন্নয়ন পরিকল্পনার মূল কর্মকর্তা। ভোটে জেতা জনপ্রতিনিধি ও সরকারি কর্তারা সহযোগী হিসাবে থাকবেন। সামাজিক নিরীক্ষা, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভার বৈঠকের মাধ্যমে সাধারণ গ্রামবাসী এ সব বিষয়ে মত বিনিময়, পঞ্চায়েতের কাজের মূল্যায়ন করার এবং আর্থিক হিসাব, বিভিন্ন প্রকল্পে উপকৃতদের তালিকা জানার অধিকারী। এমনকি প্রয়োজনে জনশুনানির ব্যবস্থাও আইনে রয়েছে। খাতায়-কলমে এ সব বৈঠক হয়। কিন্তু, বাস্তবে মানুষের মতপ্রকাশ করা ও তথ্য জানার উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ নেই। পঞ্চায়েত আইনের অধিকারের বদলে সবই সরকার ও শাসক দলের দয়ার দানে পরিণত হয়েছে।
কেন্দ্র চাইছে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো দুর্বল করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে। রাজ্যও চাইছে পঞ্চায়েতে মানুষের ক্ষমতা সঙ্কুচিত করে রাজনৈতিক মাতব্বর ও আমলাদের ক্ষমতা বাড়াতে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থা অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ মডেল। সামাজিক নিরীক্ষা, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভায় মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে, আবাস যোজনা, মনরেগা নিয়ে এই সঙ্কীর্ণ রাজনীতি বন্ধ হবে।
মৃন্ময় সেনগুপ্ত, শ্রীরামপুর, হুগলি