৫ মার্চ, ২০০৯ সালের দুপুরবেলা নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনে নিলামে বিক্রি হয়ে যায় মহাত্মা গাঁধীর বিখ্যাত চশমাখানি। ক্রেতা ভারতীয় ধনকুবের বিজয় মাল্য। নিলামঘরে তখন বহু সাংবাদিকের ভিড়। সশরীরে আছেন প্রায় এক ডজন সম্ভাব্য ক্রেতা, ৩০ জন ফোনে এবং প্রায় দু’ডজন লোক লিখিত ভাবে জানিয়েছেন চশমাটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহের কথা। ভারত সরকার এই নিলাম বন্ধের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ। অবশেষে মাল্যসাহেব ৪,১৮৮,৩৬৩ টাকায় চশমাটি নিলামে জিতে নিলেন। গাঁধী চশমাটি কিনেছিলেন বিলেতে আইন পড়ার সময়, ১৮৯০-এর দশকে। শোনা যায়, ১৯৩০ সালে বাপুজি তাঁর প্রিয় গোল মেটাল ফ্রেমের চশমাখানি উপহার দিয়েছিলেন এক কর্নেলকে। সেই সেনা অফিসারকে বলেছিলেন, “এই চশমা আমাকে স্বাধীন ভারতের দর্শন দিয়েছিল।” প্রাপকের নাম, কর্নেল এইচ এ শ্রী দিওয়ান নবাব।
৩০ জানুয়ারি, ১৯৪৮। গাঁধীজির ভাইঝি মনুবেনের স্মৃতিকথায় ধরা আছে সেই ভয়ঙ্কর দিনটির বিবরণ। মহাত্মার সকাল শুরু হয়েছিল দিল্লির বিড়লা ভবনে ভগবদ্গীতার পাঠ শুনে। তার পর তিনি কিছু লেখালিখি করেন। স্নানশেষে তাঁর ওজন নেওয়া হয়। দেখা গেল, ওজন ৪৯.৭ কেজি। তাঁর বয়স তখন ৭৮ বছর। বিকেলে দু’জন দেখা করতে এলে মনুবেনকে বলেন, “ওদের বলে দাও যে যদি আমি বেঁচে থাকি, তা হলে আজ সন্ধের প্রার্থনাসভার পরে ওদের সঙ্গে দেখা হবে।” মনে রাখতে হবে যে, দশ দিন আগে (২০ জানুয়ারি) গাঁধীজির বিড়লা ভবনের সভায় গ্রেনেড ছোড়া হয়েছিল। শীর্ণকায়, দুর্বল গাঁধী মনুবেন ও আভার (আভাবেন, গাঁধীর দত্তক কন্যা) কাঁধে ভর দিয়ে সে দিন সভায় ১০ মিনিট দেরিতে পৌঁছেছিলেন। হঠাৎ দেখা গেল, ভিড় ঠেলে খাকি পোশাক পরা এক জন যুবক বাপুজির দিকে এগিয়ে আসছেন। নাথুরাম গডসে। এক ধাক্কায় তিনি মনুবেনকে সরিয়ে গাঁধীর কাছে চলে আসেন। তার পরই মনু শোনেন চার বার গুলির আওয়াজ এবং দেখেন চারিদিক ধোঁয়াচ্ছন্ন। গাঁধীজির হাত জোড় করা, আর তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে দু’টি অন্তিম শব্দ, “হে রাম”!
পর দিন জাতিধর্ম-নির্বিশেষে সারা ভারত যে ভাবে শোক প্রকাশ করেছিল, তা ইতিহাসে বিরল। কোনও বাড়িতে সে দিন উনুন চড়েনি। দুঃখের বিষয়, যিনি সত্যের জন্য সারা জীবন লড়াই করে গেলেন এবং তার জন্য নিজের প্রাণ দিতেও ভয় পেলেন না, সেই গাঁধীজির দেশ আজ বিশ্বের অন্যতম প্রধান দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। জাতির জনকের চশমার অধিকারী যিনি, তাঁর নামে আজ হুলিয়া এবং তিনি বিদেশে পলাতক। এই পোড়া দেশে ওই চশমাটির বড় প্রয়োজন।
পার্থসারথি ঘোষ দস্তিদার , কানপুর, উত্তরপ্রদেশ
মেয়েদের দিন
১১ ফেব্রুয়ারি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন: ‘ইন্টারন্যাশনাল উওমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সায়েন্স অ্যাসেম্বলি ডে’। ২০১৫-র ২২ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ সভায় সিদ্ধান্ত হয় এই দিনটি পালনের। সেই হিসেবে এ বারের ‘ইন্টারন্যাশনাল উওমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সায়েন্স অ্যাসেম্বলি ডে’ ষষ্ঠতম। ইউনাইটেড হেড কোয়ার্টার্স এ বার কোভিড প্রোটোকল মেনে অনুষ্ঠানটি ভার্চুয়াল মাধ্যমে আয়োজিত করছে। আলোচ্য বিষয়— বিয়ন্ড বর্ডারস ইকুয়ালিটি ইন সায়েন্স ফর সোসাইটি।
উন্নয়নের জন্যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমানাধিকার যে অপরিহার্য, তা আজ স্বীকৃত। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগে মহিলারা এখন কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে, সে দিকে দৃষ্টি দিলে কিছুটা ধারণা পাওয়া যাবে। বর্তমানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির ক্লাসে ছাত্রী-সংখ্যা দু’-তিন দশক আগের তুলনায় বেড়েছে। তবে এটাও লক্ষ করার, বিজ্ঞানের সব শাখায় এই বৃদ্ধি একই রকম নয়। এর পরের ধাপে, অর্থাৎ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে মহিলা গবেষকের সংখ্যা অনেক কম। ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রির চেয়ে তুলনামূলক ভাবে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বা গণিতের ক্ষেত্রে মহিলা গবেষক বেশি। গবেষণার কাজ শেষ হওয়ার পর কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বা রিসার্চ ইনস্টিটিউটে যোগ্য মহিলা গবেষকদের ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে স্থায়ী পদে নিযুক্ত হওয়ার সুযোগ অপেক্ষাকৃত কম।
এ ছাড়াও নানা কারণে অনেক মহিলা গবেষক শেষ অবধি কাজ টেনে নিয়ে যেতে পারেন না। যতই কাগজে-কলমে মহিলাদের ক্ষেত্রে নানা নিয়ম আর সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হোক, বিজ্ঞান গবেষণার আঙিনায় মহিলাদের অবস্থান এখনও খুব উন্নত হয়নি।
কেন উন্নত হয়নি, তারও বিভিন্ন কারণ। বিভিন্ন দেশ বা একটি দেশের বিভিন্ন প্রদেশের মহিলাদের উন্নতির অবস্থানের কিছু পার্থক্য থাকে। মিল এক জায়গায়— পুরুষতান্ত্রিকতা। কয়েকটি ছাড়া প্রায় প্রতিটি উচ্চতর গবেষণাগারে প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে আসীন যিনি, তিনি এক জন পুরুষ। ঠিক এখানেই গুরুত্ব ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে অব উওমেন অ্যান্ড গার্লস ইন সায়েন্স’-এর।
মৌলিক গবেষণার স্বীকৃতি আসে উচ্চমানের আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে সংশ্লিষ্ট গবেষকের গবেষণার ফলাফল প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এ ছাড়া আছে বিভিন্ন বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির ফেলো উপাধি প্রাপ্তির স্বীকৃতি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার ইত্যাদি। আর বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মান যে নোবেল পুরস্কার, সে তো আমাদের সকলের জানা। নোবেল পুরস্কার ১৯০১ সাল থেকে দেওয়া হচ্ছে। এখানে ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি আর ফিজ়িয়োলজি অর মেডিসিন বিভাগের পুরস্কার দেওয়া হয়। গত ১২০ বছরের পরিসংখ্যান বলছে, বিজ্ঞানে এই পুরস্কারের ৯৭ শতাংশই পুরুষদের দখলে। মাত্র তিন শতাংশ মহিলা আবিষ্কারকরা পেয়েছেন। সংখ্যা হিসেবে বিচার করলে ৫৮৭ জন পুরুষ আর ২০ জন মহিলা পেয়েছেন এই পুরস্কার। এ বার ভারতের ছবিটা কেমন, দেখা যাক। শান্তি স্বরূপ ভাটনগর প্রাইজ় ভারতের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ পুরস্কার। আজ পর্যন্ত মোট ৫৬০ জন পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় মাত্র ১৮ জন মহিলা।
গত এক বছরে এক বিশাল সংখ্যক মহিলা চিকিৎসা বিজ্ঞান, নার্সিং এবং গবেষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত এবং তাঁদের অনেকেই ‘ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার’ হিসেবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। আজকের দিনটি হোক তাঁদের কুর্নিশ করার দিন।
সিদ্ধার্থ মজুমদার, কলকাতা-৩১
খালবিল
২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১, ইরানের রামসার শহরে বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে এক নবদিগন্তের সূচনা হয়। বিশ্বের তাবড় রাষ্ট্রনেতা জলাভূমি বাঁচানোর সম্মেলনে মিলিত হয়েছিলেন। পরবর্তী বছরগুলিতে এই সম্মেলনের রূপরেখা মেনেই জলাভূমি চর্চা পরিচালিত হওয়ার কথা। অতি গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি বা ‘রামসার সাইট’-এর মর্যাদা পাওয়া জলাভূমির সংখ্যা নগণ্য, ভারতে বর্তমানে ৪২টি ও পশ্চিমবঙ্গে দু’টি— পূর্ব কলকাতা জলাভূমি ও সুন্দরবন এই পর্যায়ভুক্ত।
ওই সম্মেলন বিশ্ববাসীকে এও বলেছিল যে, রামসার সাইট-এর বাইরে থাকা পুকুর, ঝিল, হ্রদ, নদী, বিলও জলাভূমি হিসেবে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
পঞ্চাশ বছর অতিক্রান্ত। আজ জলাভূমি আমাদের কাছে শুধু বাস্তুতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সম্পদ সৃষ্টিতেও সমান কার্যকর। জলাভূমির যথাযথ অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করতে পারলে তবেই প্রকৃত ব্যবস্থাপনা সম্ভব। মাছ চাষ শুধু নয়, হোগলা পাতার চাষ করে মাদুর ও শেড নির্মাণ, শোলা চাষ করে প্রতিমার সাজ তৈরি, মাদুরকাঠি, পদ্ম, পানিফল ও বিভিন্ন শাকসব্জির চাষ নিয়ে ব্যবস্থার অভাব আছে। জলাভূমি ধ্বংস হলে কে ধরে রাখবে বন্যার সময় অতিরিক্ত জল? কে দেবে সেচের জলের জোগান? নিঃশব্দে চলে যাবে জলাভূমি দিবস। স্কুলপাঠ্যে আলাদা করে জলাভূমি ব্যবস্থাপনার অন্তর্ভুক্তি, পঞ্চায়েত ও পুরসভার বুথ স্তরে এই বিষয় আলোচনা সভার প্রয়োজন আজও উপেক্ষিত। এই ঝাপসা জলছবি বড় বেদনার।
সৌরভ চট্টোপাধ্যায়, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া