বছরের পর বছর বিদ্যালয়গুলোতে কেন পড়াশোনার মান যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না? ফাইল ছবি।
বিদ্যালয়ের মিড-ডে মিলের পরিস্থিতি দেখার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিনিধি দল রাজ্যের বিভিন্ন স্কুল পরিদর্শন করেছে। সরকারের কোনও কার্যক্রম সুষ্ঠু ভাবে চালানোর জন্য এমন পরিদর্শন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় সরকারের এই উদ্যোগকে আমি শিক্ষক হিসাবে সাধুবাদ জানাই। প্রশ্ন হল, সরকারি স্কুলে সুষ্ঠু ভাবে মিড-ডে মিল চালানোর জন্য কেন্দ্রীয় টিম ভিজ়িটের যদি গুরুত্ব থাকে, তা হলে পঠনপাঠন দেখার জন্য কেন্দ্র বা রাজ্য টিম কেন পরিদর্শন করে না? বছরের পর বছর বিদ্যালয়গুলোতে কেন পড়াশোনার মান যাচাইয়ের কোনও ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না? শিক্ষকরা কেমন পড়াচ্ছেন, তার মূল্যায়নের ব্যবস্থা, তার সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীরা কতটুকু শিখল,ঘাটতি কোথায় কোথায় আছে, তা চিহ্নিত করা এবং সমাধানের জন্য চেষ্টা করা— এর কোনওটার জন্য রাজ্য কিংবা কেন্দ্র, কোনও সরকারের পক্ষ থেকে এক বারও উদ্যোগ করা হয়নি। অথচ, মিড-ডে মিলের চাইতেও বেশি টাকা তো পড়াশোনার জন্য খরচ করে সরকার। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষা এবং পুষ্টি, শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রে দু’টিই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি স্কুলে পড়াশোনার চেয়ে খাওয়া-দাওয়াই কি বেশি প্রাধান্য পাবে? গরিব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা শুধুমাত্র খাওয়ার জন্য স্কুলে আসবে, আর বছরের শেষে একটা পাশ মার্কশিট পাবে, কী শিখল কী শিখল না, তা আর দেখা হবে না— এই কি সরকার চায়? এর ফলে যাদের টাকা আছে, তারা বেসরকারি স্কুলে পড়ে উন্নত মানের শিক্ষা অর্জন করে কর্মক্ষেত্রের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে টিকে থাকবে, উচ্চপদ দখল করবে, আর গরিব বাড়ির ছেলেমেয়েরা শুধু কিছু মার্কশিট জমাবে।
রাধাপদ দাস, কেশিয়াড়ি, পশ্চিম মেদিনীপুর
নামেই পরিদর্শন
কেন্দ্র থেকে আবাস যোজনা বা মিড-ডে মিল প্রকল্পের হালহকিকত জানতে যাঁরা আসেন, তাঁদের প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, এত ঢাকঢোল পিটিয়ে আসার কী দরকার? যারা দুর্নীতি করছে, তাদের তো সুবিধে করে দেওয়া হচ্ছে আগাম সতর্ক করে দিয়ে। তারা প্রস্তুতি নিয়ে নিচ্ছে নিজেদের দুর্নীতি ঢেকে দেওয়ার। এই দুর্বল কুনাট্যের কি প্রয়োজন আছে? যদি অন্যায় ধরার জন্য তাঁরা সত্যিই সক্রিয় হতেন, তা হলে কখনওই এই ভাবে সিপাই-সান্ত্রি, চিত্রগ্রাহক নিয়ে আসতেন না। নিঃশব্দে এসে আসল চিত্র দেখে রিপোর্ট পেশ করতেন নির্দিষ্ট জায়গায়। এ আসলে পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বোকা বানানোর আর একটি অত্যন্ত স্থূল প্রচেষ্টা। জনসাধারণের অর্থে এই লোক-দেখানো পরিদর্শনে কী লাভ হচ্ছে, জানি না। এ সব করে ভোটের আগে জনগণের মন জয়ের চেষ্টা আর না-ই বা করা হল।
সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা-১০৪
মুরগির খাঁচা
জেনারেশন ওয়াই-এর ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েরা উন্নত ভবিষ্যতের জন্যে ভাল স্কুলে পাঠাচ্ছেন, কিন্তু কী ভাবে পাঠাচ্ছেন? আমার বাড়ির কাছে দুটো স্কুল রয়েছে। শিশুরা যে সব গাড়ি থেকে নেমে আসে, তা দেখে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। যদিও ১৫ বছরের পুরনো গাড়ি আমাদের রাজ্যে বাতিল হয়েছে, তবু ততোধিক পুরনো গাড়ি প্রায় সমতল রিসোল-টায়ারে ভর করে ১০ জনের জায়গায় ১৫ জন শিশু নিয়ে প্রতি দিন চলাফেরা করে। গ্রামাঞ্চলে মোটর ভ্যান খুব চলে। সেই মোটর ভ্যানের উপর লোহার খাঁচা বানিয়ে তাতে শিশুদের বোঝাই করে যখন আসে, তা দেখে মুরগির খাঁচার কথা মনে পড়ে যায়। খাঁচার মুখ বড় করা যাবে না, কারণ তাতে সিটের সংখ্যা কমে যাবে। এই সব শিশুর বাবা-মা বোধ হয় গাড়ির ড্রাইভারের থেকে ভগবানের উপর বেশি ভরসা করেন। মোটর সাইকেলে সওয়ার কোনও শিশুর মাথায় হেলমেট আজ পর্যন্ত চোখে পড়েনি।
অথচ, এই বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ খুবই পরিষ্কার। যে কোনও স্কুল বাস বা গাড়ির আগে বা পিছনে ‘স্কুল বাস’ বা ‘অন ডিউটি স্কুল বাস’ লেখা বাধ্যতামূলক। সেখানে স্কুলের নাম ও ফোন নম্বরও লিখতে হবে। বারো বছরের নীচে শিশু হলে সেই গাড়ির যা আসন সংখ্যা, তার দেড় গুণের বেশি যাত্রী নেওয়া যাবে না। গাড়িতে সিট বেল্ট, জিপিএস, ফার্স্ট এড বক্স ও খাবার জল রাখতেই হবে। সিটের নীচে বড় স্কুল ব্যাগ রাখার জায়গা থাকতে হবে। জানলার গ্রিল এমন থাকবে যাতে শিশুরা বাইরে হাত না বাড়াতে পারে। গাড়িতে কন্ডাক্টর থাকতে হবে। গাড়িতে এক জন বালিকা থাকলেও মহিলা কর্মী আবশ্যক। তিন বছরের নীচে শিশুদের সিট বেল্ট বাঁধতেই হবে। ড্রাইভারের পোশাক নীল বা খাকি হতে হবে। আর বুকে নাম লেখা থাকবে। ড্রাইভারের অন্তত পাঁচ বছরের গাড়ি চালানোর অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। গাড়ির গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটারের বেশি হবে না। প্রতি বছর গাড়ির ‘ফিট সার্টিফিকেট’ পুনর্নবীকরণ হবে।
আমাদের রাজ্যেও ‘মোটর ভেহিকল অ্যাক্ট’ খুব কড়া। কোনও প্রাইভেট গাড়িতে এই ব্যবসা করা যাবে না। স্কুল গাড়ির রং হলুদ হতে হবে। মিনি ভ্যানে ১০ জন ও অটো রিকশায় ৬ জনের বেশি নেওয়া যাবে না। গাড়ির নম্বর ও ড্রাইভারের নম্বর স্থানীয় থানাকে জানিয়ে রাখতে হবে।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, এই নিয়মগুলো কোনও দুর্ঘটনা না হলে আমাদের মনে পড়ে না। অনেক স্কুল কর্তৃপক্ষ জানেন না যে, প্রতি স্কুলে হেডমাস্টার, অভিভাবক ও ড্রাইভারদের নিয়ে একটা করে কমিটি থাকা দরকার। প্রতি বছর অন্তত ১০ জন ছাত্র স্কুলে যাওয়ার পথে দুর্ঘটনায় মারা যায়। এ রাজ্যে অতীতে মালদহে একটা স্কুলবাস জলে পড়ে গিয়েছিল। স্কুল কর্তৃপক্ষ, অভিভাবক, ড্রাইভার ও প্রশাসন, সকলের মধ্যে সমন্বয়, ও সবার সতর্কতাই নিরাপদ স্কুলজীবনের একমাত্র উপায়।
রণজিৎ মুখোপাধ্যায়, মুড়াগাছা, নদিয়া
টিউশনির দাপট
টিউশনির উপর অভিভাবকদের নির্ভরতা সত্যিই আজ চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে (টিউশনি কেন? ৩-২)। সরকারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে কুড়ি বছরের অভিজ্ঞতা থেকে ও অভিভাবকদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতা থেকে কিছু কথা বলতে চাই। টিউশনির রমরমা বিশেষ ভাবে শুরু হয়েছে ২০২০ সাল থেকে, এ হল লকডাউনের অন্যতম ফল। সুদীর্ঘ সময় স্কুল-সহ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। শহরকেন্দ্রিক কিছু সরকারি স্কুলে অনলাইন পড়াশোনা চালু ছিল ঠিকই, কিন্তু সে অতি নগণ্য। বাকিদের জন্য একমাত্র টিউশনির পথই খোলা ছিল। লকডাউন শেষ হলেও বহু মানুষ নিজস্ব বাসস্থানে ফিরে আসতে পারেননি, বা তৈরি করতে পারেননি নিজের নতুন কর্মক্ষেত্র। বহু মানুষ ফিরে পাননি নিজেদের পুরনো চাকরি। তাঁদের সন্তানরা পরিযায়ীর মতো শহর-গ্রাম ঘুরছে। কোনও একটা বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়তো হচ্ছে, কিন্তু যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না। তবু কয়েক জন তো চান তাঁদের সন্তান বাড়িতেও পড়াশোনা করুক। অগত্যা টিউশনি!
তা সত্ত্বেও পড়াশোনার মান তলানিতে। ক্লাস ফাইভের শিশু নিজের নাম ঠিকমতো লিখতে পারছে না। ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া নিজের রোল নম্বর বুঝতে পারছে না। সাধারণ বাংলা বাক্য রিডিং পড়তে আটকাচ্ছে। যারা ভাল, তাদেরও বিষয়ের ধারণা নেই। মুখস্থ বিদ্যে দিয়ে যত দিন চলে।
প্রাথমিক শিক্ষায় একটা বড় গলদ ধরা পড়ছে প্রতিনিয়ত। আজকের সরকারি স্কুলের অধিকাংশ অভিভাবক ছেলেমেয়ের পড়াশোনার মান নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত নন। এই ঘাটতিটা পূরণ করা খুব দরকার। দরকার বিদ্যালয়ের তরফে অভিভাবকদের সচেতন করার ও আস্থা অর্জনের প্রচেষ্টা। বিদ্যালয়গুলিতে নিয়মিত অভিভাবক সপ্তাহ পালিত হোক। অভিভাবকরা আগে নিজেরা স্কুলমুখী হন। এটাই হোক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রথম পদক্ষেপ।
গার্গী মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪