শিক্ষকরা কি তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়ার যোগ্য নন? প্রতীকী ছবি।
রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর স্তরে পদার্থবিদ্যা বিভাগে পড়ানোর জন্য ইউজিসি-যোগ্যতামান সম্পন্ন শিক্ষক চাওয়া হয়েছে, যাঁদের সর্বোচ্চ মাসিক ভাতা হবে ৪,৮০০ টাকা (ক্লাসপিছু ৩০০ টাকায় শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিজ্ঞপ্তিতে বিতর্ক, ২৯-৩)। পাশাপাশি দেখা যেতে পারে, সম্প্রতি রাজ্য সরকারের শ্রম দফতর চাষবাস, বিড়ি পাতা তোলা, হিমঘর, মাছধরা, ধানকল, তাঁতশিল্প, সাফাইকর্ম-সহ ষোলোটি শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকদের ন্যূনতম মাসিক মজুরি নির্ধারণ করেছে ৭,৬৫১ টাকা থেকে ৯,৭৯৪ টাকা। বলা বাহুল্য, আধা-দক্ষ, দক্ষ এবং অতি-দক্ষ শ্রমিকদের মাসমজুরি আরও বেশি। একই বিশ্ববিদ্যালয় মাসতিনেক আগে পাঁচ হাজার টাকা মাসিক ভাতায় সাফাইকর্মী নিয়োগের বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সুতরাং, হবু শিক্ষকরা কি তাঁদের শ্রমের বিনিময়ে নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাওয়ার যোগ্য নন? এই নীতির একটি বিপজ্জনক দিক হল— স্থায়ী পদের অবলুপ্তি ঘটিয়ে সামান্য বেতনে ঠিকা-শিক্ষক নিয়োগ, যার ফলে শিক্ষকরা তাঁদের চাকরিটুকু বজায় রাখার জন্য সর্বদা কর্তৃপক্ষের কৃপাপ্রার্থী হয়ে থাকবেন। আবার, রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেহাল আর্থিক অবস্থার প্রতিও কি এটি ইঙ্গিত করে না?
অন্য দিকে, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি, ২০২০’ রূপায়ণের জন্য রাজ্য সরকারের তৎপরতা চোখে পড়ার মতো (স্নাতকে নয়া ব্যবস্থা চালু করতে কমিটি, সঙ্গী বিতর্ক, ২৮-৩)। এই কমিটি ঠিক কী করতে চায়, তা ভবিষ্যৎই বলবে। কিন্তু, যে দিকে আমরা চলেছি, তাতে আগামী দিনে স্থায়ী বেতনভোগীদের চাকরি, বেতন, অবসর ভাতা কতটা সুরক্ষিত থাকবে?
সৌভিক বন্দ্যোপাধ্যায়, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান
সবাই বাতিল?
‘শিক্ষায় এটা তো দুর্নীতির মহাসমুদ্র: বিচারপতি’ (৩০-৩) শীর্ষক সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে এই পত্র। আমি ২০১৬ সালে টেট পরীক্ষায় শিক্ষকতার চাকরিপ্রাপ্ত এক প্রার্থী। দীর্ঘ ১০ বছর একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্যারাটিচার রূপে নিযুক্ত ছিলাম। এই সময়ে দু’বার টেট পরীক্ষায় কৃতকার্য হই। কিন্তু ইন্টারভিউতে সাফল্য অর্জন করতে পারিনি। ২০১৬ সালের টেট পরীক্ষায় পার্শ্বশিক্ষকদের জন্য ১০ শতাংশ আসন সংরক্ষণের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। আমরা বেশ কয়েক জন পার্শ্বশিক্ষক টেট পাশ করি ও ইন্টারভিউতে কৃতকার্য হয়ে শিক্ষক হিসাবে নানা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কাজ শুরু করি। এর জন্য আমরা পার্শ্বশিক্ষকরা কেউ উৎকোচ দিইনি, কারণ আইন মোতাবেক চাকরি সংরক্ষিত ছিল।
শিক্ষক নিয়োগে যে দুর্নীতি হয়েছে, সেই দুর্নীতি ঢাকতে ওএমআর শিট নষ্ট করার যে অপরাধ হয়েছে, তার জন্য দোষীরা শাস্তি পাক— প্রত্যেক সুনাগরিকের মতো আমাদেরও তাই ইচ্ছা। কিন্তু বিভিন্ন চ্যানেলে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে প্রায় ২০০ দিন ধরে নিরন্তর ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ চলছে। তার ফলে সর্বত্র, যাঁরা চাকরি পাননি তাঁরা ও তাঁদের আত্মীয়রা আক্রোশের সঙ্গে দাবি করছেন, সব শিক্ষকই ভুয়ো। এরই মধ্যে মাননীয় বিচারপতি পুরো প্যানেল বাতিল করে দেওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছেন। ভুয়ো নথি ধরা পড়েছে ২৮৪ জনের। এই ক’জন ভুয়ো প্রার্থীর জন্য ৪২ হাজার শিক্ষককে বরখাস্ত করাটা কি উচিত কাজ হবে? যদি ভুয়ো প্রার্থীর সংখ্যা আরও বেশি হয়, আদালত তাঁদের খুঁজে বার করে দোষীদের উপযুক্ত শাস্তি দিক। এই প্যানেল বাতিল হলে বিরোধী দলের রাজনৈতিক লাভ হবে, সরকারেরও বেতন দেওয়ার বিরাট খরচ কমবে। কিন্তু সকলের দোষের প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও যদি শেষ পর্যন্ত পুরো প্যানেল বাতিল করতে হয়, তা হলে সেটি দুর্বলের উপর অন্যায় উৎপীড়ন হবে।
সুতপা সেন, সাঁতরাগাছি, হাওড়া
শিক্ষাব্রতী
‘বদলি নীতির গোড়ায় গলদ’ (২২-৩) শীর্ষক প্রবন্ধে সরকারি স্কুলে নিয়োগ ও বদলি নীতির গলদ আর অপরিকল্পনা প্রসঙ্গে সীমান্ত গুহঠাকুরতার যুক্তিগুলি অকাট্য। তবে লেখক অন্যান্য সরকারি চাকরির থেকে (যেখানে পদোন্নতি, বিদেশ ভ্রমণ বা আর্নড লিভ-এর মতো সুবিধে আছে) শিক্ষকতাকে আলাদা করে ভাবলেন না, এটা মেনে নেওয়া যায় না। বহু দেশে শিক্ষকদের সমাজ সেবকের মর্যাদা দেওয়া হয়। ফিনল্যান্ড বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশ কলেজ-ইউনিভার্সিটির সেরা ছাত্রদের বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষক হওয়ার জন্য মোটা বেতনের ব্যবস্থা করে। অথচ, এ দেশে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে শিক্ষকদের সম্মান নষ্ট হচ্ছে। এর দায় প্রশাসনের।
আমাদের দেশের জনসংখ্যার বিরাট অংশ সরকারি শিক্ষাব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল। আন্তরিক ভাবে শিক্ষাব্রতী শিক্ষক ছাড়া এই ব্যবস্থা এত দিনে অচল হয়ে যেত। রাজ্যে যথাযথ ও নিয়মিত নিয়োগ হলে শিক্ষাক্ষেত্রে খুব বেশি শূন্যস্থান থাকারই তো কথা নয়, সে গ্রামে হোক বা শহরে। স্কুলগুলোতে লক্ষ লক্ষ শূন্য পদের মাসুল ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষিকা, শিক্ষাকর্মীদেরও গুনতে হয় প্রতি দিন। কোথাও শিক্ষাকর্মীর অভাবে প্রধান শিক্ষককে ঘণ্টাও বাজাতে হয়, আবার কোথাও শিক্ষকের অভাবে অশিক্ষক কর্মচারীকে ক্লাসও নিতে হয়! মিড-ডে মিল, সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ ইত্যাদির সঙ্গে শিক্ষকদের প্রাত্যহিক রুটিন অনুযায়ী ও তার বাইরে অতিরিক্ত ক্লাস, নির্দিষ্ট সময়ে সিলেবাস শেষ করে পরীক্ষার আয়োজন ও রাত জেগে অসংখ্য উত্তরপত্র মূল্যায়ন, সর্বোপরি বিভিন্ন বয়সের ছাত্র-ছাত্রীদের সুচারু পরিচর্যা মোটেও সহজ নয়। তাই শিক্ষকদের পথশ্রম ও মানসিক ক্লান্তি থেকে রেহাই দিতে বিভিন্ন ভাবে বদলির ব্যবস্থা অযৌক্তিক কেন হতে যাবে?
সোমনাথ দে, ডায়মন্ড হারবার, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
পাওনা ও উপরি
‘অনাস্থা’ (৩০-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে বলতে চাই, বিভিন্ন সরকারি দফতরের— বিশেষত থানা পুলিশ, রেজিস্ট্রি অফিস, কর্পোরেশন, ইত্যাদিতে দুর্নীতি যেন আমরা মেনেই নিয়েছি। আবার, বহু কাল আগে রেলের গার্ড সাহেবরা যে বাতিতে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ তেল থেকে কিছুটা বাঁচিয়ে নিয়ে আসতেন, তাকে ঠিক দুর্নীতি আখ্যায়িত করা বোধ হয় যায় না। অন্তত ছোট গল্পের সম্রাট অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের ‘গার্ড সাহেব’ গল্পের সারাংশ সেই অর্থই সূচিত করে। গার্ড সাহেবের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর তেলের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়ার নিখুঁত চিত্রাঙ্কন বোধ করি অচিন্ত্যকুমারের সাবলীল লেখনীতেই সম্ভব। ঘটকবাবুরা এক কালে পাত্রের রোজগারের ক্ষেত্রেও উপরির উল্লেখ করতে দ্বিধা বোধ করতেন না। তবে শিক্ষাক্ষেত্রের দুর্নীতির যে বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে, সেটি অবশ্যই অশুভ সঙ্কেত! সার্ভিস কমিশনগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় তলানিতে! মনে হয় শিক্ষকদের যোগ্যতা নির্ণায়ক ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণের সময় এসেছে।
সুবীর ভদ্র, ডানকুনি, হুগলি
অস্ত্র কেন?
রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে চরম অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা যেন বাৎসরিক প্রাপ্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে (দায় কার, সম্পাদকীয়, ১-৪)। সম্প্রতি এই মিছিলকে কেন্দ্র করে হাওড়ার শিবপুর থানা এলাকায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে যে তাণ্ডব চলল, তার জন্য দায়ী প্রশাসনের ব্যর্থতা। এ রকম উগ্র ধর্মীয় উন্মাদনাকে সঙ্গী করে চলা মিছিলকে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে যেতে দেওয়া হল কেন? অনেকের মতে, পঞ্চায়েত ভোটের আগে এ হল ভোটারদের মেরুকরণের অপপ্রয়াস। তারস্বরে হিন্দি গান, গৈরিক পতাকার উপর ক্রুদ্ধ পবনপুত্রের ছবি বাংলার সংস্কৃতি বলে মেনে নেওয়া যায় না। কোনও ধর্মীয় মিছিল অস্ত্র নিয়ে করা যাবে না, নিয়ম করুক প্রশাসন।
দিলীপকুমার সেনগুপ্ত, কলকাতা-৫১