করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্যালয়-শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের বিপুল ক্ষতি, তা সামাল দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ফাইল ছবি।
‘ভণ্ডামির শিক্ষা’ (১২-৪) সম্পাদকীয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে বলি, একটা নির্বাচিত সরকার কতখানি অবিবেচক হলে, একটা প্রজন্মের শিক্ষা নিয়ে অবলীলায় এমন ছেলেখেলায় মেতে উঠতে পারে। করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘকাল যাবৎ বিদ্যালয়-শিক্ষায় ছাত্রছাত্রীদের যে বিপুল ক্ষতি হয়েছিল, তা সামাল দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের পুনরায় নির্ধারিত মানে ফিরিয়ে নিয়ে আসাটাই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এই বাংলার সারস্বত সমাজ অবাক বিস্ময়ে দেখল, অতিমারি কাটিয়ে ওঠার পরও কী অবলীলায় বিদ্যালয়-শিক্ষাকে সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে, নিয়মিত কার্যসূচিকে হেলায় বানচাল করে, শিক্ষাকেই পঙ্গুত্বের দিকে নিয়ে গেল রাজ্য সরকার। যার বড় উদাহরণ বিদ্যালয়ে ‘দুয়ারে সরকার’-এর আয়োজন। অবশ্য এর আগেও বহু বার সরকারের খামখেয়ালিপনার শিকার হতে হয়েছে নিষ্পাপ ছাত্রছাত্রীদের। তা সে আবহাওয়ার আমূল পরিবর্তন হওয়া সত্ত্বেও গরমের ছুটিকে অহেতুক প্রলম্বিত করার জন্য হোক, কারণে-অকারণে ছুটি ঘোষণার জন্য হোক, কিংবা ক্ষমতার বলে সরকারি কাজে অনৈতিক ভাবে বিদ্যালয় ভবনগুলিকে দখল করার জন্যই হোক, সব ক্ষেত্রেই সরকারের চিন্তাভাবনার দৈন্য প্রকট। আশ্চর্য এই, শিক্ষাক্ষেত্রে এই জাতীয় অনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রীর কণ্ঠস্বর এতটাই ক্ষীণ যে, তাঁর কাছ থেকে ছাত্রসমাজের পক্ষে মঙ্গলদায়ক কিছু আশা করাও বৃথা। যদিও এ বার শিক্ষাঙ্গনে অনৈতিকতার বিরুদ্ধে সামান্য হলেও মাথা তুলেছিলেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। আশ্বাস দিয়েছিলেন, পুরসভার স্কুলগুলিতে কোনও শিবির হবে না। কিন্তু রাজ্যবাসী দেখলেন, অধিকতর দাপটের কাছে তাঁর সেই আশ্বাসবাণীও খড়কুটোর মতো উড়ে গেল। রাজনৈতিক স্বার্থে বিদ্যালয়গুলিতে সরকারি দখলদারি বন্ধ হোক। চোখের সামনে বিদ্যালয় শিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা দেখে নাগরিকরা রাজ্য সরকারের কাছে এই প্রত্যাশা তো করতেই পারেন।
সমীরকুমার ঘোষ, কলকাতা-৬৫
সরকারের ঔদ্ধত্য
‘ভণ্ডামির শিক্ষা’ সম্পাদকীয়ের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকতা জীবনে উপলব্ধ কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে চাই, যাতে এটাই প্রমাণ হবে, সরকারি দফতরগুলি বিদ্যালয়ের পঠনপাঠনকে কতখানি গুরুত্ব দেয়।
বর্ষায় নদীর জল সামান্য স্ফীত হতেই নিচু এলাকায় বসবাসকারী একটি পাড়ার গোটা দশেক পরিবার আশ্রয়চ্যুত হল। অনতিবিলম্বে স্থানীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের মাধ্যমে জেলাশাসকের পত্র পৌঁছে গেল বিদ্যালয়ে, যাতে জানানো হল বন্যাদুর্গতদের আশ্রয় দানের জন্য অনির্দিষ্ট কাল বিদ্যালয় ভবন অধিগ্রহণ করা হল। সন্দেহ নেই, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের পরামর্শেই জেলাশাসকের এই পদক্ষেপ। অথচ, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের কার্যালয়ের চার পাশে প্রায় বিঘে দুয়েক সরকারি ফাঁকা জমিতে অনায়াসেই অস্থায়ী তাঁবু ও শৌচালয় তৈরি করে বন্যাদুর্গতদের আশ্রয় দেওয়া যেত। কিন্তু তার জন্য একটু উদ্যোগ করতে হত। দু’কলম লিখলেই যেখানে সুন্দর পরিকাঠামোযুক্ত ভবন মিলে যাবে, সেখানে কে আর সেই উদ্যোগ করতে যায়! ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের বেশ কিছু দিন আগে স্থানীয় থানার আধিকারিক বিদ্যালয়ে পত্র দিয়ে জানালেন যে, আধা সামরিক বাহিনীর আশ্রয়স্থল হিসাবে বিদ্যালয়ের সাতাশটি কক্ষ অধিগ্রহণ করা হল। আধিকারিক মহোদয় এক বার জানারও প্রয়োজন মনে করলেন না যে, আদৌ বিদ্যালয়ে সাতাশটি কক্ষ আছে কি না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অপারগতার কথা জানালে থানা থেকে এক জন অনুসন্ধানে এসে নির্বিকার চিত্তে প্রস্তাব দিলেন প্রধান শিক্ষকের কক্ষ ও বিজ্ঞান পরীক্ষাগারটি ছেড়ে দিতে। কতখানি ঔদ্ধত্য থাকলে এ রকম একটা প্রস্তাব দেওয়া যায়! বিদ্যালয়ে উচ্চ মাধ্যমিক ব্যবহারিক পরীক্ষা চলাকালীন মাইক বাজিয়ে বিবেক-চেতনা উৎসব চলার বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষীও হতে হয়েছে। এ সব অভিজ্ঞতা থেকে একটা উপলব্ধিই হয়েছে যে, সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিতে সবচেয়ে গুরুত্বহীন বিষয়টি হল সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠদান।
প্রদীপনারায়ণ রায়, শক্তিপুর, মুর্শিদাবাদ
পার্বণেও ছুটি
পড়াশোনার ব্যাপারটা সরকারি প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে গতানুগতিক হয়ে পড়েছে। করোনাকালে ছাত্রছাত্রীদের দু’-তিন বছর বাড়িতে বসেই কেটে যায়। এবং সেই সময় তাদের পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়। অনেক ছাত্রছাত্রী স্কুল থেকে বিদায় নিয়ে দোকানে চায়ের কাপ ধোয়ার কাজে বা হোটেলে থালাবাসন ধোয়ার কাজে নিয়োজিত হয়। স্কুলের মিড-ডে মিলের অভাবে তারা পেট চালানোর জন্য এই সব কাজ করতে বাধ্য হয়। ওদের জীবনের মূল্যবান অধ্যায়টি ওইখানেই সমাপ্ত হয়ে যায়।
এখন নানান অছিলায় বিদ্যালয়গুলিতে ছুটি ঘোষণা করা হয়। ইদানীং ছোট ছোট পালাপার্বণেও ছুটি দেওয়া হয় সব সম্প্রদায়ের মানুষকে খুশি করার জন্য। বর্তমানে দীর্ঘ দিন ধরে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলিতে পড়াশোনা বন্ধ করে নানা সরকারি সুবিধা প্রদানের জন্য এগুলিকে ব্যবহার করা হয়। পড়াশোনা স্বাভাবিক কারণেই বিঘ্নিত হয়। তা ছাড়া, মিড-ডে মিলের জন্য অনেক ছাত্রছাত্রী নিয়মিত বিদ্যালয়ে যোগদান করে। স্কুল বন্ধ থাকলে তাদের খাওয়াদাওয়ার অসুবিধা হবে। সিলেবাসও ঠিক সময়ে শেষ করা যাবে না।
এক তো দীর্ঘ দিন অনেক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অভাব। তার উপর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের নানা কাজে লাগানো হয়। এ ভাবেই সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রছাত্রীরা নিয়মিত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই সংস্কৃতি এ রাজ্যে দশ বছর আগে ছিল না।
স্মৃতি শেখর মিত্র, আসানসোল, পশ্চিম বর্ধমান
শুধুই পরিষেবা?
‘ভণ্ডামির শিক্ষা’ সম্পাদকীয়তে সরকারি প্রকল্পের রূপায়ণে সারা রাজ্যে স্কুলগুলিকে ব্যবহারের ফলে স্কুলশিক্ষা কী ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সরকারি প্রকল্পের সংখ্যা একশোর দোরগোড়ায়। সরকারি কর্মসূচির জন্য আগে মহকুমা উন্নয়ন দফতর, ব্লক উন্নয়ন দফতর, পঞ্চায়েত সমিতির অফিস নেওয়া হত। সেগুলির পরিবর্তে বিগত ১১ বছর ধরে স্কুলগুলিকে ব্যবহার করা হচ্ছে সরকারি প্রকল্প রূপায়ণের মাধ্যম হিসাবে। সাম্প্রতিক নমুনা, শিক্ষা দফতরের নির্দেশিকায় আগেই বলা ছিল ১১ এপ্রিলের মধ্যে পঞ্চমথেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ক্রমিক পরীক্ষার কথা। তা সত্ত্বেও, দুয়ারে সরকার ক্যাম্প চলছে। লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়া এবং পরীক্ষার বিষয়টি উপেক্ষা করে সরকার তড়িঘড়ি ‘দুয়ারে সরকার’ ঘোষণা করল।
এমনিতেই সারা বছর সরকারি প্রকল্পের আওতায় কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রীর বৃত্তি, ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ুয়াদের জন্য পোশাক বিলি করতে গিয়ে পঠনপাঠন ব্যাহত হয়। তার পরও যদি সরকারি কর্মসূচির ক্ষেত্র হিসাবে স্কুলকেই সফ্ট টার্গেট করা হয়, তা হলে পঠনপাঠনের পরিবেশ থাকবে কী ভাবে? তা ছাড়া এর ফলে অনেক কর্মদিবসও নষ্ট হয়। এ বিষয়ে শিক্ষক, অভিভাবকদের অনুরোধেও সরকার কর্ণপাত করেনি। সবচেয়ে বড় কথা, যে পড়ুয়াদের পড়াশোনার উন্নতিকল্পে সরকার বই, খাতা, বৃত্তি, সাইকেল, পোশাক দিচ্ছে বিনামূল্যে, সেই সরকারি কর্মসূচিরই শিকার হয়ে তাদের পঠনপাঠন, পরীক্ষাসূচি উলটপালট হয়ে যাচ্ছে। কেন এই বিপরীতমুখী ভাবনা পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব্যবস্থায়? কেন আজ শিক্ষার অঙ্গন সরকারি পরিষেবা-প্রদান কেন্দ্রে পরিণত? সরকার দায় এড়িয়ে চুপ থাকতে পারে কি?
অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩