—প্রতীকী ছবি।
তূর্য বাইন তাঁর ‘নামে তারকা, কিন্তু কাজে?’ (২৯-৫) প্রবন্ধে প্রশ্ন করেছেন, নানা অভিযোগে বিদ্ধ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চেয়ে সমাজের নানা পরিসরের কৃতী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষ আইনসভায় গেলে দেশ ও দশের পক্ষে মঙ্গলজনক— এই ধারণা কি সর্বাংশে সত্যি? অবশ্যই নয়। তারকাদের জনপ্রিয়তাকে ঢাল করা নির্বাচন জেতার একটা কৌশল মাত্র, তাঁরা দেশের বা দশের কাজ করবেন বলে নয়। অপটু তারকারা এলাকা উন্নয়নের তহবিল কী ভাবে খরচ করবেন, তা বলে দেওয়ার জন্য দলের কেষ্টু-বিষ্টুরা আছেন। বাকিটা না বললেও চলে।
প্রবন্ধকার তথ্য উল্লেখ করে লিখছেন, সপ্তদশ লোকসভায় মোট ২৭৪টি বৈঠক হয়েছে, যেখানে তারকা সাংসদদের উপস্থিতি গড় হার ৫৬.৭%। বাঙালি অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়ের ছিল ৮৮% উপস্থিতি। সাংসদের গড় হাজিরার চাইতে বেশি উপস্থিত ছিল আরও দুই তারকার— অভিনেতা মনোজ তিওয়ারি (৮৫%) এবং অলিম্পিক পদকজয়ী রাজ্যবর্ধন রাঠৌর (৮০%)। এর পর তিন বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রীর উপস্থিতির হার ছিল ১২%, ২১% ও ৩৯%। শাসকের রোষানল এড়াতেই কি ওই তিন অভিনেতা-অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ করা গেল না?
সাংসদরা মোটা বেতনের সঙ্গে যে অভাবনীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, তা এক কথায় দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে জনগণের সম্পদকে লুট করার শামিল। অথচ বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল, এমনকি সিপিএম-ও কোনও দিন সাংসদদের জনসেবার নামে এই ভোগবিলাস বন্ধে সংসদে সরব হল না। ক্ষমতা দখলের স্বার্থে দলগুলির ভিন্ন পথ থাকলেও, ক্ষমতা ভোগের প্রশ্নে এঁদের নীতি এক এবং অভিন্ন। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্যবাদ, মানুষের অধিকার, ইত্যাদি রক্ষার নামে দলগুলি মাঠে ময়দানে প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। দেশ সেবায় যে ত্যাগ প্রয়োজন, তার ছিটেফোঁটাও এঁদের রাজনৈতিক দর্শনে খুজে পাওয়া যায় না। স্বাধীনতার পর থেকে যে ভাবে সরকারি স্বীকৃতিতে দেশের সম্পদ লুট ও শোষণ হচ্ছে জনপ্রতিনিধিত্বের নামে, তার জন্য এখনই একটা দেশব্যাপী আন্দোলন হওয়া উচিত।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
কপালে সানগ্লাস
তূর্য বাইনের প্রবন্ধটি খুবই প্রাসঙ্গিক। এটা ঠিকই যে, বর্তমান রাজনীতিতে শিল্প, সংস্কৃতি, ক্রীড়া-সহ নানা ক্ষেত্রের তারকাদের রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচনী ময়দানে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের অনেকেরই রাজনীতির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই। তাঁদের জনপ্রিয়তা ও খ্যাতিকে কাজে লাগিয়ে যেন তেন প্রকারেণ নির্বাচনে জয়লাভ করাটাই রাজনৈতিক দলগুলির মূল লক্ষ্য। নির্বাচনে জয়ের পর চিত্রতারকাদের অনেকের সঙ্গে জনগণের সে রকম সম্পর্ক থাকে না। অথচ, নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি তো লক্ষ লক্ষ জনগণের প্রতিনিধি নিযুক্ত হলেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় জনসংযোগ গড়ে তুলে উন্নয়নের কাজে নিজেকে শামিল করা তাঁর কর্তব্য। শুধুমাত্র মাঝে মাঝে মাথার উপর সানগ্লাস তুলে গাড়িতে করে এলাকা ঘুরে এলেই দায়িত্ব পালন করা হয় না।
জনগণ তারকা প্রার্থীকে ভোট দেন বোধ হয় এ কথা ভেবেই যে, যে-রকম চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন তা যখন ভাল, তখন সে মানুষটিও তেমনই হবেন। তিনি নিশ্চয়ই এলাকার উন্নয়নে কাজ করবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, বেশির ভাগ তারকা বিধায়ক বা সাংসদ হওয়ার পরেও নিজেদের পেশায় নিযুক্ত থাকেন। ফলে তিনি তাঁর এলাকায় নিয়মিত যান না। সেখানকার মানুষের সুবিধা-অসুবিধার কথা তাঁর অজানা থেকে যায়। এলাকার জনগণ তারকা সাংসদদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগ করেন যে, সাংসদ এলাকা পরিদর্শন করতে যান না, সেখানকার মানুষের ভাল-মন্দ, রাস্তাঘাট, বিদ্যালয় বা চিকিৎসা ব্যবস্থার কথা জানতে চান না।
যে সমস্ত রাজনৈতিক দলের প্রধান এমন তারকাদের মনোনয়ন দেন, তাঁদের উদ্দেশ্য থাকে শুধুমাত্র নির্বাচনে জয় লাভ। এলাকার উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা কী হবে, সে ভাবনাটা গৌণ হয়ে যায়। যে তারকা সাংসদরা দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে উদাসীন এবং ব্যর্থ, তাঁদের সংসদে উপস্থিতি এবং পারফরম্যান্স দেখে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া উচিত। প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন যে, সাংসদ হিসাবে ন্যূনতম দায়িত্ব পালন না করেই আজীবন বিপুল সরকারি সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ এক প্রকার অপরাধের শামিল।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
বেলতলা
নির্বাচনী লড়াইয়ে তারকাদের আগমন নতুন কিছু নয়। রাজনৈতিক দলগুলি দলীয় স্বার্থরক্ষায় এঁদের মনোনয়ন দেয়। রাজনীতির সঙ্গে যোগ না থাকাটা বিচার্য হয় না। বরং দেখা হয়, ভবিষ্যতে এঁরা দলের প্রতি কতটা অনুগত থাকবেন। আমাদের রাজ্যে এমন তারকা প্রার্থীর তালিকা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে। ভোটারদের বৃহৎ অংশ অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে নির্দ্বিধায় এঁদের ভোট দেন বলেই, অনেকে আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার পেয়ে যান। এঁরা কেউ কেউ নির্বাচিত হয়ে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে উদাসীন থাকেন। অথচ, নিজেদের পাওনা বুঝে নিতে ছাড়েন না। এ নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। দলের পোড়খাওয়া নেতারা যখন বুঝতে পারেন, দায়িত্বহীন তারকা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ধূমায়িত হচ্ছে, তখন সেই প্রার্থীদের সরিয়ে দিতে কালবিলম্ব করেন না। ভোটের ময়দানে এগিয়ে দেওয়া হয় নতুন তারকা প্রার্থীদের। ভোটাররা ফের গ্ল্যামারে ভুলে ভোট দিতে দ্বিধা করেন না। এই ধরনের গ্ল্যামার-সর্বস্ব তারকা প্রার্থীদের কর্মকাণ্ড সংসদে হাত তুলে সমর্থন জানানো, বা বিরোধিতা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। জনগণ যথেষ্ট সচেতন না হলে এমন দৃষ্টান্ত ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ বার বার ‘বেলতলা’য় গেলে, সুযোগসন্ধানীরা তো সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবেনই। আইনসভা গণতন্ত্রের পবিত্রতম স্থান। এই স্থানটির গৌরব বৃদ্ধি ও মর্যাদা রক্ষায় প্রতিটি সাংসদেরই কিছু দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। সেই দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের জন্যই জনগণের করের টাকায় তাঁদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি এতটা নজর দেওয়া হয়। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, যাঁরা নিজেদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ঐকান্তিক হলেন না, তাঁরা কেন সাংসদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা পূর্ণমাত্রায় ভোগ করবেন?
রতন রায়চৌধুরী, পানিহাটি, উত্তর ২৪ পরগনা
সময়ের দাম
‘নামে তারকা কিন্তু কাজে?’ প্রবন্ধটি সময়োপযোগী। সপ্তদশ লোকসভায় প্রায় সব দলে তারকা সাংসদ ছিলেন। এ বারও তার ব্যতিক্রম নয়। গত লোকসভার অধিবেশনগুলিতে তারকাদের উপস্থিতি, বিল উত্থাপন, বিতর্কে অংশগ্রহণ বিষয়ে ১৯ জনকে নিয়ে একটি অসরকারি সংস্থা যে তথ্য সরবরাহ করেছে, তাতে চোখ ছানাবড়া। সপ্তদশ লোকসভার কার্যকালে সাংসদদের গড় উপস্থিতি ৭৯ শতাংশ হলেও, তারকাদের উপস্থিতি অনেক কম। উপস্থিতির তালিকায় শেষের দিক থেকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং চতুর্থ স্থানে আছেন তিন বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী। ভাবা দরকার, রাজনৈতিক দলগুলির লক্ষ্য কী? ‘মারি অরি পারি যে কৌশলে’ নীতি নিয়ে ক্ষমতা দখল, বা ক্ষমতায় টিকে থাকা। তার জন্য কৃতী, স্বচ্ছ, শিক্ষিত, রাজনীতি-সচেতন ভাবমূর্তির চেয়ে ‘টাকার কুমির’ দাঁড় করাতে বেশি আগ্রহী দলগুলি। সর্বোপরি কেন্দ্রীয় সরকারের সাংসদ তহবিলে প্রাপ্ত টাকা কোন তহবিলে পড়বে, তা শুধুই নির্দেশের অপেক্ষা। ফলে সংসদের অধিবেশনে তারকাদের উপস্থিতি গৌণ হতে বাধ্য। যদিও, ভারতের কোটি কোটি মানুষ যেখানে অপুষ্টিতে দিন কাটান, সেখানে সংসদে বৈঠকে প্রতি মিনিটে খরচ হয় প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা— এটাও ভাবার বিষয়।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪