Bengali Song

সম্পাদক সমীপেষু: হারানো সুর

শিল্পী শচীন গুপ্ত পঞ্চাশের দশকের গায়ক। তাঁর গাওয়া ‘অশোক বনে বন্দিনী গো’ গানটি মৃণাল চক্রবর্তীর সুরে বেশ উপভোগ্য হয়েছিল।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২২ ০৪:৫৭
Share:

‘স্মৃতির ছায়ালীন’ (রবিবাসরীয়, ১৯-৬) শীর্ষক নিবন্ধে অলক রায়চৌধুরী অনেক বিস্মৃত কণ্ঠশিল্পীদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সত্যিই কিছু শিল্পী যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে গেলেন। প্রথমেই বলি বাণী ঘোষালের নাম। পঞ্চাশের দশকের শুরুতে অন্নদাশঙ্কর রায়ের ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর পরে রাগ করো’ গানটি গেয়ে জনপ্রিয় হন। পরে বহু বিখ্যাত সুরকারদের সুরে রেকর্ড করেন। যেমন— সলিল চৌধুরীর সুরে ‘শোনো ভাই ইস্কাবনের দেশে’, শ্যামল মিত্রের সুরে ‘ফুলকুঁড়ি গো ফুলকুঁড়ি’-র সঙ্গে গেয়েছেন ‘গীতালি গীতাঞ্জলি’, ‘কুয়াশায় ঘেরা নীলপাহাড়ে’ প্রভৃতি গানও। হঠাৎ তিনি গানের জগৎ থেকে বিদায় নেন। লেখক ঠিকই বলেছেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় অতল জলের আহ্বান ছবিতে সুজাতা চক্রবর্তীকে দিয়ে ‘ভুল সবই ভুল’ গানটি গাইয়েছিলেন এবং রাতারাতি এই শিল্পী জনপ্রিয় হন।

Advertisement

শিল্পী শচীন গুপ্ত পঞ্চাশের দশকের গায়ক। তাঁর গাওয়া ‘অশোক বনে বন্দিনী গো’ গানটি মৃণাল চক্রবর্তীর সুরে বেশ উপভোগ্য হয়েছিল। তবে তিনি সাড়া জাগিয়েছিলেন ‘জল নেই জল নেই’ গানটি গেয়ে। গানটি সরিৎ সেন শর্মার রচনা। তিনিও অকালে চলে গেলেন। সত্য চৌধুরীকে এখনও শ্রোতারা মনে রেখেছেন একটি গানে— ‘পৃথিবী আমারে চায়’।

তবে দু’জন শিল্পীর নাম না বললে প্রসঙ্গটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, মলয় মুখোপাধ্যায় ও দীপক মৈত্র। মলয়ের গান ষাটের দশকে শুনেছি। গানটি ছিল অপরেশ লাহিড়ীর ‘লাইন লাগাও’। সমবেত শ্রোতাদের মাত করে দিয়েছিলেন, কিন্তু কিছু দিন পরেই মোটর দুর্ঘটনায় তিনি প্রাণ হারান। দীপক মৈত্র ছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ছাত্র। জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় তাঁর বইতে লিখেছেন, দীপককে একটি জলসায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে বলা হয়। তিনি উদ্যোক্তাদের বলেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনি করেন না। কিন্তু উদ্যোক্তারা নাছোড়বান্দা। গম্ভীর মুখে দীপক সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘যদি আসে কভু বিস্মরণের বেলা’ গানটি গেয়ে দর্শকদের প্রশংসা কুড়িয়ে মঞ্চ ত্যাগ করেন। এমনই কৌতুকপ্রিয় শিল্পী ছিলেন দীপক মৈত্র।

Advertisement

সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের সুরে দু’টি গানে (‘এ তো নয় শুধু গান’ আর ‘কত কথা হল বলা’) তিনি তাঁর অভিমান ব্যক্ত করে গিয়েছেন। দীপক মৈত্রের অকালপ্রয়াণে সতীনাথ মুখোপাধ্যায় অত্যন্ত দুঃখ পেয়েছিলেন। এই সব বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানাই।

পরাগ রঞ্জন ঘোষ, কলকাতা-৯১

রবিবাবুর রেকর্ড

রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচার ও জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে গ্রামোফোন রেকর্ডের কিছু কৃতিত্ব অবশ্যই আছে। তাই গ্রামোফোনে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রকাশের ইতিহাসের প্রতি রবীন্দ্রানুরাগীদের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক। গ্রামোফোন রেকর্ডের প্রাথমিক পর্যায়ে রেকর্ডে গীতিকার বা সুরকারের নাম লেখা হত না। লেবেলে শিল্পীর নাম, বিষয়, গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি, যে রাগের উপর ভিত্তি করে গানটি রচিত সে রাগের নাম, এবং কখনও কখনও তালের নামও উল্লেখ থাকত। তাই ‘রবিবাবুর গানের রেকর্ড’ বহুলপ্রচারিত হলেও, গানটি যে তাঁর লেখা, সে স্বীকৃতি তখন জুটত না। তাঁর সলিসিটর খগেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ১০ মার্চ, ১৯১৫ কবির রচিত গানের রয়্যালটি দাবি করে গ্রামোফোন কোম্পানির কাছে চিঠি লেখেন। গ্রামোফোন কোম্পানি রবীন্দ্রনাথের গানের উপর তাঁর স্বত্ব মেনে নেয়। ৫ অক্টোবর, ১৯২৬ গ্রামোফোন কোম্পানির সঙ্গে কবির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই চুক্তি অনুযায়ী রেকর্ড কোম্পানি রয়্যালটির বিনিময়ে কবির গান রেকর্ড করার অনুমতি পেয়েছিল। যত দূর জানা যায়, ভারতে গীতিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথই প্রথম রয়্যালটি অর্জন করেন। ১৯৩৫ সালের জানুয়ারি মাসে কনক দাসের রেকর্ড (পি ১১৭৯২) প্রকাশিত হয়। গান দু’টি ছিল যথাক্রমে ‘মনে রবে কি না রবে আমারে’ এবং ‘কাছে যবে ছিল পাশে হল না যাওয়া’। সর্বপ্রথম এই রেকর্ডটিতেই ‘শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ লেখা ছিল। ১৯৪০ সালের মার্চ এবং জুলাই মাসে প্রকাশিত দু’টি রেকর্ডে ‘রবীন্দ্রগীতি’ লেখা ছিল। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা ১৯৪৩ সালের পরে প্রকাশিত রেকর্ডে অবশ্য ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ কথাটির ব্যবহার দেখতে পাই।

অন্য শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান প্রথম রেকর্ড হয় ১৯০৪ সালে, শিল্পী ছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ বাগচী (‘কেন যামিনী না যেতে জাগালে না’)। রবীন্দ্রনাথের নিজের কণ্ঠে তাঁর গান প্রথম ধরা হয় ১৯০৬ সালে, ফোনোগ্রাফ বা সিলিন্ডার রেকর্ডে। ভারতে রেকর্ডিং শিল্পের জনক হেমেন্দ্রমোহন বসুর সংস্থার নাম ছিল ‘দ্য টকিং মেশিন হল’। তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বকণ্ঠের গানের রেকর্ড সিলিন্ডার রেকর্ডে প্রকাশ করেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, লালচাঁদ বড়াল, গওহরজান প্রমুখ শিল্পীর গাওয়া গানও সিলিন্ড্রিক্যাল রেকর্ডে প্রকাশিত হয়। এগুলির একটিও রক্ষা পায়নি। তবে হেমেন্দ্রমোহন তাঁর করা সিলিন্ড্রিক্যাল রেকর্ড ফ্রান্সের প্যাতি কোম্পানির কাছ থেকে ডিস্ক রেকর্ডে ছেপে এনেছিলেন; যেগুলি ‘প্যাতি-এইচ বোস’ নামে প্রকাশিত হয়েছিল। সেই প্যাতি-এইচ বোস রেকর্ডে ১৯০৮ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে আবৃত্তি, এক পিঠে ‘সোনার তরী’ এবং অপর পিঠে ‘বন্দেমাতরম্’ ছাপা হয়েছিল। ১৯০৮-১৯১২ সালের মধ্যে প্যাতি-এইচ বোস কোম্পানি থেকে আরও চার জন শিল্পীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁরা হলেন কেশবচন্দ্র সেন, রাণীসুন্দরী, সুরেন্দ্রমোহন মৈত্র এবং মানদাসুন্দরী দাসী। এর পরে গোকুলচন্দ্র শ্রীচন্দন, ননীলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, বেদানা দাসী, বলাইদাস শীল, ভবসিন্ধু দত্ত, পূর্ণকুমারী দাসী, কৃষ্ণাভামিনী, ব্রজেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, হরেন্দ্রনাথ দত্ত এবং আরও অনেকে রেকর্ডে রবীন্দ্রনাথের গান পরিবেশন করলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রে গানের মুদ্রিত বাণী ও স্বরলিপি সহজলভ্য না হওয়ায় শিল্পীরা যে ভাবে গানটি শুনতেন, তার সঙ্গে রাগ-রাগিনীর প্রয়োগ করে নিজস্ব ঢঙে গাইতেন।

রবীন্দ্রনাথের কাছে সরাসরি গান শিখে যাঁরা তাঁর গান রেকর্ড করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন— সুরেন্দ্রমোহন মৈত্র, অমলা দাস, সাহানা দেবী, মিস নীহারবালা, দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কনক দাস। উল্লেখ্য, রেকর্ডে বা রেকর্ড কোম্পানির তালিকায় অমলা দাসের নাম ‘মিস দাস (অ্যামেচার)’ লেখা থাকত। কারণ, তখনকার দিনে ভদ্রসমাজের কোনও মহিলার রেকর্ডে বা প্রকাশ্য কোনও অনুষ্ঠানে গান গাইবার কথা ভাবাই যেত না। চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশ ছিলেন ঠাকুর পরিবারের আপনজন। রবীন্দ্রনাথের সস্নেহ সমর্থনে তিনি গান রেকর্ড করেন। ১৯১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর প্রথম রেকর্ডের দু’টি গান ছিল ‘চিরসখা হে, ছেড়ো না’ এবং ‘একি আকুলতা ভুবনে’।

১৯২৫ সালে স্টার থিয়েটারে রবীন্দ্রনাথের চিরকুমার সভা মঞ্চস্থ হয়। সেখানে সঙ্গীতশিক্ষার দায়িত্বে থাকা দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেখানো গানগুলি নীহারবালার কণ্ঠে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯২৬ সালের জুলাই মাসে গ্রামোফোন রেকর্ডে ‘জয়যাত্রায় যাও’ এবং ‘অলকে কুসুম না দিয়ো’ গান দু’টি প্রকাশিত হয়। গ্রামোফোন কোম্পানির প্রচারপুস্তিকায় লেখা হয়, “কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমারসভা’র অভিনয়ে শ্রীমতী নীহারবালার এই গান দুইখানি শুনিবার জন্য সকলে উৎসুক হইয়া থাকেন। একে রবীন্দ্রনাথের রচনা তাহাতে শ্রীযুক্ত দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়ের শিক্ষা এবং সর্বোপরি গায়িকার মধুর কণ্ঠস্বর ও শ্রোতাদের মোহিত করিবার ক্ষমতা। কাজেই এই জনপ্রিয় গান দুইখানি সর্বাঙ্গসুন্দর হইয়াছে।” ১৯২৬-এ দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠের প্রথম রেকর্ড (‘মেঘের পরে মেঘ জমেছে’ এবং ‘আমার পরাণ যাহা চায়’) প্রকাশ পায়।

কোনও কিছুর ভিত গড়ে তোলার সময়ে কখনও কখনও ভাঙাগড়ার আশ্রয় নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথের গানের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। তাঁর লেখা গানের ভাঙাগড়ার ইতিহাস জানতে সেই রেকর্ডগুলির ভূমিকাকে ছোট করে দেখা যায় না।

ইকবাল মতিন, রাজশাহী, বাংলাদেশ

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement