Migrant Workers

সম্পাদক সমীপেষু: এ কার লজ্জা

দেশের মানুষকে চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল লকডাউনে বাড়ি ফেরার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২৪ ০৬:০১
Share:

—ফাইল চিত্র।

‘যেন ভুলে না যাই’ (১১-৫), হৃদয়বিদারক মানবনিধনের অধ্যায়কে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীকে ধন্যবাদ। ভুলতে আমরা চাই না, রাষ্ট্র আমাদের ভুলিয়ে দেয়। লকডাউনের অমানবিকতা আর ক্ষমতাসীন দলগুলির নির্লজ্জ দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ওই পর্বকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। লকডাউনে কাজহারা পরিযায়ী শ্রমিক বারো বছরের জনজাতি সম্প্রদায়ের মেয়ে জামলো মকদমকে আমরা ভুলতে পারি না। বারো বছরের মেয়ে গ্রামের অন্যান্যের সঙ্গে তেলঙ্গানার লঙ্কাখেত থেকে নিজের বাড়ি ছত্তীসগঢ়ের দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। তিন দিনে ১৪০ কিলোমিটার হাঁটার পর তৃষ্ণার্ত, বিধ্বস্ত মেয়েটি নিজের বাড়ি থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে পথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। ভুলে যাওয়া উচিত হবে না বিমলেশ জায়সওয়ালের কথা। মহারাষ্ট্রের পানভেন থেকে মধ্যপ্রদেশের রেওয়া পর্যন্ত ১২০০ কিলোমিটার স্ত্রী ও তিন বছরের শিশুকন্যাকে নিয়ে গিয়ারবিহীন স্কুটারে রওনা হয়েছিলেন।

Advertisement

দেশের মানুষকে চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল লকডাউনে বাড়ি ফেরার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য। বিবেকহীন সরকার বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করল ক্ষুধার্ত যাত্রীদের কাছ থেকে পুরো ভাড়া নিয়ে, তা-ও মাঝপথে বন্ধ হল। ততোধিক অমানবিকতার পরিচয় দেখা গেল উত্তরপ্রদেশে। সেখানে পরিযায়ী শ্রমিকদের উপরে স্যানিটাইজ়েশন-এর নামে কীটনাশক ছড়ানো হল। নানা রাজ্যে অন্তঃসত্ত্বা মা পথেই জন্ম দিলেন সন্তানের। কয়েক ঘণ্টা পর সদ্যোজাতকে নিয়ে হাঁটছেন তিনি— এ ছবি দেখে সারা দেশ বেদনায়, লজ্জায় মুখ ঢাকে। এ কার লজ্জা? যাঁরা কাজ হারিয়েছিলেন, সেই ১৪ কোটি পরিযায়ী শ্রমিককে বেতন পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হল না। আর বাসস্থান? ২০ মার্চ, ২০২০ থেকে মে, ২০২২ পর্যন্ত পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় (শহরে) মাত্র ৮৩,৫৩০টি আবাসন হস্তান্তরিত হল। যা লক্ষ্যের ৬.৫৫ শতাংশ।

পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবন সুরক্ষার জন্য আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন (১৯৭৯) তৈরি করা হয়েছিল। ২২ মার্চ, ২০২০ লকডাউনের সময় ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ কথাটি সংবাদপত্রের দৌলতে মানুষ জানতে পারে। পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের ঘটনা আইনকে বড়ই বিদ্রুপ করে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টেলিভিশনের পর্দায় করোনা তাড়াতে নাগরিকদের থালা-বাটি বাজাতে বলেছিলেন, প্রদীপ জ্বালাতে বলেছিলেন, করোনা-যুদ্ধে প্রথম শ্রেণির সৈনিকদের জন্য পুষ্পবৃষ্টি করতে বলেছিলেন। পঞ্চম ভাষণে এসে ‘পরিযায়ী শ্রমিক’ শব্দটি ব্যবহার করলেন। নির্বাচনের সময়ে এ দেশের নাগরিকরা কি তা ভুলে গিয়েছিলেন?

Advertisement

মঙ্গল কুমার নায়ক, নাড়াজোল, পশ্চিম মেদিনীপুর

নীরব রাজনীতি

পুনর্জিৎ রায়চৌধুরীর বক্তব্য সঠিক। কেন্দ্রীয় সরকার হঠাৎ লকডাউন ঘোষণা করায় পরিযায়ী শ্রমিকরা যে নিদারুণ অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন, তা নিয়ে শাসক দলকে ক্ষমা চাইতে দেখা গেল না। করোনা কালে গোটা দেশ যখন স্তব্ধ, পরিযায়ী শ্রমিকরা তখন হেঁটেছেন। কিছু পাওয়ার আশায় নয়, বরং মরিয়া হয়ে। বহু মানুষ পায়ে হেঁটেই ছ’শো-সাতশো কিলোমিটার দূরে নিজের গ্রামে যাওয়ার জন্য রওনা হয়েছেন স্ত্রী, সন্তানের হাত ধরে। এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, এই সময় দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক কর্মহীন হয়েছেন, যাঁরা কাজ হারাননি তাঁদের বেতন প্রায় অর্ধেকের বেশি কমেছে। আশি শতাংশ শ্রমিক পূর্বের থেকে কম পরিমাণ খাবার খেতে বাধ্য হয়েছেন অর্থের অভাবে। শহরাঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ শ্রমিক, রাজ্য অথবা কেন্দ্রীয় সরকার থেকে কোনও অর্থসাহায্য পাননি। এই পরিস্থিতিতে পরিযায়ী শ্রমিকরা বাড়ি ফিরে যেতে চাইবেন, তাতে আশ্চর্যের কী আছে? কিছু ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, শুকনো খাবার, রুটি, বিস্কুট নিয়ে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন। পরিতাপের বিষয়, আত্মনির্ভর ভারত এই অসহায় পরিযায়ী শ্রমিকদের দিকে কোনও রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়নি।

আশ্চর্যের বিষয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে আলোচনা দূরে থাক, কোনও রাজনৈতিক দলকেই পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশা নিয়ে সরব হতে দেখা গেল না। যদিও পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই অতিমারি কালে কাজ হারিয়েছেন, এবং আর্থিক অনটন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এখনও খুঁজছেন। দেশের ৫০ কোটি শ্রমশক্তির তিন-চতুর্থাংশই স্বনিয়োজিত, অথবা অনিয়মিত খুচরো শ্রমিক। তাঁদের কোনও সুনিশ্চিত আয় নেই, কর্মসংস্থানের নিরাপত্তা নেই। পরিযায়ী শ্রমিকরা মোট শ্রমশক্তির এক-পঞ্চমাংশ, অর্থাৎ প্রায় ১০ কোটি। দেশের শহরাঞ্চলের অনিয়মিত শ্রমিকরা মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ। লকডাউন চলাকালীন ঘরে ফিরে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যে কষ্ট ভোগ করলেন, তাঁদের কথা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তরা ভুলে গেলেও, মানুষের সেবা করতে যাঁরা রাজনীতির ময়দানে নেমেছেন, তাঁদের কি ভুলে যাওয়া উচিত?

রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

স্মৃতির কৃষ্ণগহ্বর

‘যেন ভুলে না যাই’ প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন, লকডাউনের সেই ভয়াবহ দিনগুলোকে কি আমরা সত্যিই বেমালুম ভুলে গেলাম? বিজ্ঞানশাস্ত্র অনুসারে আমরা জানি, মানবজীবনের যে ঘটনাগুলিকে আমরা স্বেচ্ছায় ভুলে যেতে চাই, সেগুলোই তাড়াতাড়ি স্মৃতির কোষ থেকে মুছে যায়। তাই বোধ হয় ভয়াবহ দিনগুলোকে ভুলতে চেয়েই আমরা সেই সব অন্ধকার সময়ের স্মৃতি মন থেকে মুছে দিতে চেয়েছি। তবুও সনিয়া কুমারীর পাশাপাশি মনে পড়ে যায় জামলো মকদমের কথা (‘৩ দিন হেঁটে পথেই মৃত্যু ছত্তীসগঢ়ের বালিকার’, ২২-৪-২০২০)। ওই বালিকা অপরিকল্পিত লকডাউনের শিকার হয়েছিল। ভোটের আগে নেতানেত্রীদের গালভরা প্রতিশ্রুতির মাঝে আমরা কি কেউ জামলো মকদমের মুখটা মনে রেখেছি?

৯ মে ২০২০, এই সংবাদপত্রের শিরোনাম ছিল, ‘ঘরের পথে মৃত্যু ক্লান্ত শ্রমিকদের’। রেলপথে শুয়ে থাকা ক্লান্ত-শ্রান্ত শরীরগুলো লোহার চাকার তলায় ছিন্নভিন্ন হয়ে চিরদিনের ঘুমের দেশে চলে গিয়েছিল। কত শ্রমিক জাতীয় সড়কে ট্রাকের তলায় পিষ্ট হয়েছিলেন। না, সেই চলে যাওয়াগুলো এই বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতিতে আজ আর আমাদের মনে পড়ে না। সেই সময় যেন এক কৃষ্ণগহ্বর। আলোর শেষ বিন্দুটুকুও শুষে নিয়ে সেই দিনগুলো যেন সভ্যতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠেছিল। ডায়েরির পাতায় দেখি ৪ অগস্ট ২০২০ লিখেছিলাম, “জীবনস্মৃতি গ্রন্থে ‘মৃত্যুশোক’ নিবন্ধে কবি বলেছেন, ‘চারিদিকে গাছপালা মাটি জল চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা তেমনই নিশ্চিত সত্যেরই মতো বিরাজ করিতেছে। অথচ তাহাদেরই মাঝখানে তাহাদেরই মতো যাহা নিশ্চিত সত্য ছিল, এমন-কি দেহ, প্রাণ, হৃদয় মনের সহস্রবিধ স্পর্শের দ্বারা যাহাকে তাহাদের সকলের চেয়েই বেশি সত্য করিয়াই অনুভব করিতাম সেই নিকটে মানুষ যখন এত সহজে একনিমেষে স্বপ্নের মতো মিলাইয়া গেল তখন সমস্ত জগতের দিকে চাহিয়া মনে হইতে লাগিল, এ কী অদ্ভুত আত্মখণ্ডন। যাহা আছে এবং যাহা রহিল না, এই উভয়ের মধ্যে কোনও মতে মিল করিব কেমন করিয়া।... জগৎকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্বের প্রয়োজন, মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়েছিল...।”

ভুবনভরা দুঃসময়ে কবির প্রয়াণ দিবসের স্মরণে স্মৃতিচারণা সেই সময়ের ভারাক্রান্ত মনকে খানিক স্বস্তি দিয়েছিল। তার পর স্মৃতির সরণিতে সব কিছুই ফিকে হয়ে গেল। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দেখা গেল, তা একদম চাপা পড়েই গেছে। সেখানে জায়গা করে নিয়েছে রামমন্দির, সিএএ, নির্বাচনী বন্ড, সন্দেশখালি, শিক্ষক নিয়োগের অনৈতিকতা।

সঞ্জয় রায়, দানেশ শেখ লেন, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement