Bengali Tradition

সম্পাদক সমীপেষু: অতীত বিলাস

বাঙালি চিরকালই অতীত বিলাসী। অতীতে বাঙালি সংস্কৃতির শিখরে আরোহণ করেছিল, এখন শিল্পসাহিত্য সব লাটে উঠেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৩ ০৪:১৩
Share:

শিল্পচর্চার একটি পূর্বশর্ত হল আর্থিক সচ্ছলতা, তাই ‘সংস্কৃতি’ নামক জিনিসটি একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির কুক্ষিগত হয়েই রয়েছে। ফাইল ছবি।

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের (যাহা পায় তাহা খায়, ১৬-৪) প্রবন্ধটির পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। সমস্যা হচ্ছে ‘বাঙালি কী ছিল আর কী হইয়াছে’ সুলভ আলোচনার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, তা কেবল সমসাময়িক কালে সীমাবদ্ধ নেই, উনিশ শতকের পণ্ডিত জনের লেখাতেও একই তিরস্কারের সুর ধ্বনিত হয়েছে। বাঙালি বাংলা ভাষার প্রতি উদাসীন— এই বলে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র আজ থেকে দেড়শো বছর আগে বঙ্গদর্শন-এর পাতায় আক্ষেপ করেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বঙ্কিম শঙ্কা প্রকাশ করছেন যে, হয়তো ভবিষ্যতে দুর্গোৎসবের মন্ত্র ইংরেজিতে পড়া হবে। কেউ যদি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি-র প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাখানি পড়ে দেখেন, তা হলে দেখবেন রবীন্দ্রনাথ বিলাপ করছেন আজকালকার কচি-কাঁচারা স্বদেশি লোকগাথার ভান্ডার ভুলে বিলিতি ‘ফেয়ারি টেল’ পড়ে। ১৮৭৪ সালে রচিত রাজনারায়ণ বসুর লেখা সেকাল আর একাল থেকে শুরু করে বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মচরিত হয়ে হাল-আমলের এই প্রবন্ধটি পড়লে মনে হবে, বাঙালির অবক্ষয় নিরবচ্ছিন্ন কাল ধরে চলা একটি প্রবহমান প্রক্রিয়া। সমসাময়িক বাঙালি তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অধঃপতিত বলে তাকে কাঠগড়ায় যেমন উনিশ শতকে তোলা হয়েছে, তেমন আজও তোলা হচ্ছে।

Advertisement

অর্থাৎ, বাঙালি চিরকালই অতীত বিলাসী। অতীতে বাঙালি সংস্কৃতির শিখরে আরোহণ করেছিল, এখন শিল্পসাহিত্য সব লাটে উঠেছে— এই যুক্তি আসলে একটি জটিল বহুস্তরীয় বিষয়ের অতিসরলীকৃত রূপ। একটি জাতির গরিষ্ঠ অংশ ফ্রয়েড-চার্বাকে মন দেবে, এমনটা আশা করাও হাস্যকর। শিল্পচর্চার একটি পূর্বশর্ত হল আর্থিক সচ্ছলতা, তাই ‘সংস্কৃতি’ নামক জিনিসটি একটি বিশেষ সুবিধাভোগী শ্রেণির কুক্ষিগত হয়েই রয়েছে। প্রশ্ন হল, পরিশীলিত পরিবেশে বেড়ে ওঠা সংস্কৃতিমান বাঙালি কি সারা জীবন সাংস্কৃতিক কৌলীন্যহীন জনগণকে অবজ্ঞার চোখেই দেখবে, তাদের শিল্পরুচি নিয়ে খোঁটা দেবে, না কি তাদের সুখ-দুঃখের শরিক হবে? বর্তমান-বিমুখ হয়ে কেবল স্মৃতিরোমন্থন বুদ্ধদেব বসুর ভাষায় ‘অকৃতির লক্ষণ’।

সৌরনীল ঘোষ, দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান

Advertisement

খাদের কিনারে

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায় বর্তমান বাঙালির দুরবস্থার সঠিক জায়গা নির্দেশ করেছেন। সমাজ জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে এতখানি নিম্নগামিতা এর আগে কখনও হয়নি। সাহিত্য, নাটক, সিনেমা, সঙ্গীত, যাত্রাপালা, খেলাধুলো, রাজনীতি— সমস্ত ক্ষেত্রে একেবারে শেষ সারিতে বাঙালির অবস্থান। অথচ, কিছু স্বঘোষিত সেলেব্রিটি টিভিতে বা স্টেজে উঠে মুখ গম্ভীর করে এমন ভাবে ভাষণ দেন, যেন শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটা বাঁধাই ছিল, দয়া করে নেননি। সাধারণ বাঙালির আরও ভয়ঙ্কর অবস্থা। তাগা, তাবিজ, মাদুলি, জলপড়া, শনিপুজো, ঘেঁটুপুজো নিয়ে ডুবে আছে, আর দার্শনিক ভঙ্গিতে বলছে ‘এই সব কিছুর পিছনে বিজ্ঞান আছে’।

বাঙালি সেই যে বাবা তারকনাথকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল ‘আজ তোমার পরীক্ষা’ বলে, এখন জগতের সবাই বাঙালিকেই চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে আর বাঙালি সব পরীক্ষাতেই বেমালুম ফেল করে যাচ্ছে। কে বোঝাবে, এত সমৃদ্ধ বাংলা গানের সম্ভার থাকতে বাংলা সিরিয়ালে হিন্দি গান ঢোকানোর দরকার নেই। এত সুমধুর ভাষা, সাহিত্য থাকতে হিন্দির দাসত্ব করার কোনও দরকার হয় না। শত চেষ্টাতেও বোঝানো যাচ্ছে না যে, তাগা, তাবিজ, মাদুলি, জলপড়া আশ্রয় করে থাকলে, এদের উপর নির্ভরতা বাড়ালে যে সব মহাপুরুষ আমাদের উন্নতির জন্য জীবন উৎসর্গ করলেন, তাঁদের অশ্রদ্ধা করা হয়।

সমগ্র ভারতবর্ষে সর্বজনমান্য, শ্রদ্ধেয় বাঙালির সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। কূপমণ্ডূকতা, উপর-চালাকি, আত্মম্ভরিতা এবং সুশিক্ষার অভাব বাঙালিকে খাদের কিনারে নিয়ে ফেলেছে।

সুরজিত কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি

সমাজভাবনা

সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রবন্ধে এমন এক অসামান্য প্রতিভাধরের উল্লেখ আছে, যিনি জীবদ্দশাতেই একটি প্রজন্মের মুখপাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তিনি ঋত্বিক ঘটক। গণনাট্য যুগ সম্পর্কে তাঁর স্বীকারোক্তি হল: “তখনকার দিনে ব্যক্তিগত ব্যাপার বলে কিছু ছিল না।” অর্থাৎ, ব্যক্তিগত মত যা-ই থাক, মানুষকে জাগাতে হবে এবং সে কারণেই গণনাট্যের আদর্শকে শিরোধার্য করে চলতে হবে— এ চেতনার কারণেই সে দিন ব্যক্তিগত লাভ নয়, তাবড় লেখক-শিল্পীদের কাছে সমাজভাবনা বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল। দার্শনিক আলথুজ়ারের মতে, মনের চেতন স্তরে ‘আইডিয়োলজি’র প্রভাব সামান্য হলেও নির্জ্ঞান স্তরে মতাদর্শের প্রভাব যথেষ্ট। গণনাট্য আন্দোলনে ঋত্বিক ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, দেবব্রত বিশ্বাস, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র প্রমুখ কমিউনিস্ট মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বিরোধ-বিতর্ক সত্ত্বেও কমিউনিস্ট মতাদর্শকে তাঁরা মনের গভীরে লালন করতেন। নয়তো পার্টির মতাদর্শ বুঝতে গুণী শিল্পীদের অনেকে তৎকালীন সিপিআই নেতা ভবানী সেনের কাছে ছুটে যাবেন কেন? এমন আদর্শগভীর চেতনাই তাঁদের শিল্পচেতনাকে বলিষ্ঠ করে তুলেছিল। ঋত্বিক ঘটকের অপর একটি কথাও স্মরণ করা দরকার। চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরও কিছু বইতে তিনি লিখেছেন— “...আমরা মানুষকে তীব্রভাবে ‘ভালোবাসা’র একটা ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম এবং সেই ‘ভালোবাসা’ কথাটা সরবে দাঁড়িয়ে বলার ব্যাকুলতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে দেখা দিত, তাই আমাদের নাটক করার লক্ষ্য ছিল।”

এই ভালবাসা আর ব্যাকুলতার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা যে ‘ঋত্বিকীয় প্যাশন’, তাকে আমল না দিয়েই যদি উচ্চমার্গীয় শিল্প গড়ার বাসনা জাগে, তা আঁতলামো-পুজোয় পর্যবসিত হতে বাধ্য।

এটা অবক্ষয়ের যুগ, কৃত্রিমতার যুগও বটে। অর্থলোলুপতা এ সময়ের মানুষের এক জঘন্য প্রবণতা, এ কথা ঠিক। যদিও এ রাজ্যের তুমুল প্রতিভাবান লেখক-শিল্পীদের কেউ কেউ আজও আশ্চর্য রকমের শিল্পকর্মে বিভোর হয়ে আছেন। মেকি সংস্কৃতির তাণ্ডব যেমন আছে, তেমনই অন্য দিকে যোগেন চৌধুরীর মতো দক্ষ চিত্রশিল্পীর ছবি আঁকা থামেনি, কবীর সুমনের মতো গায়ক জীবনমুখী গানের সম্পদ বৃদ্ধি করেই চলেছেন। নবারুণ ভট্টাচার্য-র লেখা কিছু কিছু লাইন তো যুবক-যুবতীদের মুখে মুখে ফেরে। তবুও যে আজ শিল্পজগতে ব্যাপক উদ্দীপনা জাগছে না, সমাজটা গণ-সংস্কৃতির জোয়ারে আন্দোলিত হচ্ছে না, তার কারণ খোঁজা দরকার।

এটা দ্বিধাগ্রস্ত রাজনীতির যুগ। তদুপরি রাজনীতি এখন অকিঞ্চিৎকর, রসালো এবং সর্বনেশে ভাবের এক উদ্ভট মিশ্রণ বলা যায়। মতাদর্শহীন এমন সাড়ে-বত্রিশ-ভাজা মার্কা রাজনীতি কি কখনও উচ্চমার্গীয় সংস্কৃতিকে ধারণ করতে পারে? এটা ‘কার্নিভাল সেন্স’-এর যুগ। আচরণ, ভঙ্গিমা, বাচন— যা কিছু অযাচিত তথা বিদঘুটে বলে ভাবা হয়, মানবপ্রকৃৃতির সে নিগূঢ় দিকগুলোর নিরন্তর প্রকাশ ঘটে চলেছে। বিসদৃশ চরিত্রের মানুষদের ভিড় বাড়ছে। এখন সুস্থ সংস্কৃতির কথা ভাবার অবকাশ কোথায়? এ যুগে বহুমূল্যে অর্জিত সংস্কার বিপথচালিত হওয়ারই সম্ভাবনা। প্রবল দুর্নীতি, অবিশ্বাস আর সন্দেহের বাতাবরণই যখন শক্তিশালী, বাঙালির জাতিগত সত্তাও তখন সঙ্কটাপন্ন হতে বাধ্য। এমন পরিস্থিতিতে ‘ঢেউ উঠছে,কারা টুটছে’ ধরনের গান লিখে বা গেয়ে জনজোয়ার গড়ে তোলাযায় না।

শিবাশিস দত্ত, কলকাতা-৮৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement