Elections

সম্পাদক সমীপেষু: ভোটের স্মৃতি

কঠোর নিরাপত্তায় ডিসি-আরসি কেন্দ্র থেকে ভোটকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, আর ভোটদান পর্ব মিটলে সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ মে ২০২৪ ০৫:২০
Share:

—প্রতীকী ছবি।

ঋকসুন্দর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভোটকর্মীর ডায়েরি’ (রবিবাসরীয়, ২৮-৪) প্রবন্ধটি এই সদ্যপ্রাক্তন ভোটকর্মীর কলমকে একটু সচল করে তুলল। প্রবন্ধকার যথার্থই ব্যক্ত করেছেন তাঁদের সেই সময়ের অনুভূতি, “যুদ্ধে যাওয়ার আগে... ভোটকর্মীদের অনেকে নিজেদের সে ভাবে দেখতে শুরু করেন। আর ক’দিন পরেই যেতে হবে অজানা, অচেনা যুদ্ধক্ষেত্রে...।” এই মুক্ত বিহঙ্গ তাই এখন সখেদে স্মরণ করে কর্মজীবনের ‘ওই’ বিশেষ দিনগুলোর কথা। ভোটরঙ্গমঞ্চে কুশীলবদের তাঁদের ইচ্ছামতো সময়ে ক্ষুধানিবৃত্তির অধিকার আছে। সেই অধিকার নেই শুধু ‘আইনি পথ’-এ সকাল সাতটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত বুথের ভোটকর্মীর, কারণ নির্বাচন কমিশনের নির্দেশিকায় টিফিন বিরতির কোনও কথা নেই। অনেক অজ পল্লিগ্রামের বুথে শৌচাগারের খোঁজ মেলে না। যেমন নেই ভোটের আগের রাতে মশককুলকে পরাভূত করে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমের নিশ্চয়তা।

Advertisement

কঠোর নিরাপত্তায় ডিসি-আরসি কেন্দ্র থেকে ভোটকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, আর ভোটদান পর্ব মিটলে সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ, যত ক্ষণ তাঁর কাছে ভোটের বাক্স বা ইভিএম থাকে, তত ক্ষণ ভোটকর্মীর জীবনের দাম অনেক। ইভিএম আর আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র জমা পড়ার পরে আর কর্মীর নিরাপদে বাড়ি ফেরানোয় কারও দায় নেই। ভোটদান পর্বে কোনও গোলমাল বাধলে তাই রাতে ঘরে ফেরার সময়টার কথা ভেবে ভোটকর্মী শিহরিত হন।

কলকাতার এক বুথে ভোটদানের অভিজ্ঞতা বলি। দেখেছি শুরু থেকেই বুথের মধ্যে বুকে বিবিধ দলের ব্যাজ আঁটা, কিন্তু কোনও জাদুবলে তাঁরা যেন সব এক দলীয় প্রতিনিধি, তথা অভিন্ন পোলিং এজেন্ট। বুঝতে পারছিলাম, তাঁদেরই আনুকূল্যে জনাকয়েক দিয়ে যাচ্ছে অন্যদের হয়ে ভোট। নিয়ম বলে, এ ক্ষেত্রে কোনও এজেন্টের প্রতিবাদ না এলে কিছু করার নেই। ভোটার লিস্টে চোখ বুলিয়ে ১৪-১৫ বছরের এক কিশোরকে বললাম, “ভাইপো, তোর বয়স কত রে?” ভাইপো উত্তর দিল, “বত্রিশ।” অভিন্ন পোলিং এজেন্টদের এক জন বলল, “কাকু, ছোটবেলায় কী একটা কঠিন রোগে ভুগে আজ ওর এই অবস্থা, ওকে অনেক বাচ্চা মনে হয়।” মুহূর্তে বুথের অভ্যন্তরে সারা দিনের পরিশ্রান্ত মুখগুলোতে তীব্র হাসির ঢেউ খেলে যায়।

Advertisement

মধুসূদন দাশঘোষ, হরিপাল, হুগলি

‘কিছু দেখেননি’

শুধুমাত্র প্রিসাইডিং অফিসার নন, প্রতিবাদী ভোটকর্মীরাও প্রতিটি নির্বাচনে হেনস্থার শিকার হন। অধিকাংশ খবরই থাকে অপ্রকাশিত। প্রত্যেক নির্বাচনে শয়ে শয়ে কোম্পানি সেনা পা ফেলেন এ বঙ্গের মাটিতে। নির্বাচন কমিশনও বিধিনিষেধের শৃঙ্খলে বেঁধে ফেলতে চান সমস্ত নির্বাচন প্রক্রিয়াকে। কিন্তু বাস্তবে কী দেখি? সমস্তটাই যেন পুতুল-পুতুল খেলা। এই শয়ে শয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী কেমন নিষ্কর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের বুথকে ঘিরে, কেমন করে লুট হয়ে যায় একের পর এক বুথ, নির্বাচন কমিশন যেন দেখতে পায় না। এর কোনও প্রমাণই থাকে না, কারণ সিসিটিভিই তো জীবন্ত থাকে না। তার পর থাকে ডিসি-আরসি’তে স্থানীয় আধিকারিকদের চাপ— “আপনি কিছু দেখেননি, মাস্টারমশাই।” শুধু হাওয়াতেই ভেসে বেড়ায় ‘বুথ জ্যাম’, ‘ভোট চুরি’।

নির্বাচন কমিশনের কি দায়িত্ব থাকে না নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে এই জাতীয় ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলির সুনির্দিষ্ট ভাবে তদন্ত করা? না কি ভোট কোনও ভাবে শেষ হয়ে যাওয়া মানেই তাঁদের দায়-দায়িত্ব শেষ হয়ে গেল। এর ফলেই তো দুর্বৃত্তদের (দলীয় মানবসম্পদ) দৌরাত্ম্য ক্রমশ বেড়েই চলে।

শয়ে শয়ে সরকারি, আধা সরকারি কর্মী নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে। তবুও দৈহিক ভাবে অক্ষম, অপারগ কর্মীকেও আইনের দোহাই দিয়ে বলপূর্বক ব্যবহার করে নির্বাচন কমিশন। ডিসি-আরসি’তে যে সমস্ত আধিকারিক থাকেন, যাঁরা একে অপরের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কর্ম পরিচালনা করেন, তাঁদের পদ্ধতি সব দিনই দায়সারা গোছের। শুনেছি ভোটকেন্দ্রকে সুন্দর রাখা ও সেখানে ন্যূনতম পরিষেবা দেওয়ার জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকে। অথচ, ভোটকেন্দ্র অর্থাৎ বুথ এবং শৌচাগার প্রায়শই ব্যবহারের অযোগ্য থাকে। আপত্তি জানালে বিনীত ভাবে উত্তর আসে, “একটু চালিয়ে নিন।” অথবা, “আমার কিছু করার নেই।” আজ বাইশ-তেইশ বছর ধরে ভোটকর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুবাদে বলতে পারি, খুব কম সময়েই দায়িত্ববান আধিকারিকের অধীনে কাজ করেছি।

এ রকম হবে কেন? আমাদের তো নির্বাচনে যোগ দিতে কোনও আপত্তি নেই। কেন বুথকর্মীদের অসুবিধাগুলি লিপিবদ্ধ হবে না, এবং পরবর্তী নির্বাচনে সেগুলি সমাধান হবে না, এ প্রশ্ন থেকেই যায়।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা-১৫২

অপশব্দ

পশ্চিমবঙ্গে প্রথম চার দফা লোকসভা ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া ইতিমধ্যেই অতিক্রান্ত। বাকি দফাগুলিতে ভোটগ্রহণ রক্তপাতহীন, শান্তিপূর্ণ হোক— এটা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গবাসীর একান্ত কামনা। কিন্তু এই কামনা বাস্তবায়িত করতে যাঁদের একেবারে পুরোভাগে থেকে উদ্যোগ করা উচিত, তাঁদের ব্যবহার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে। সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিন মিডিয়া খুলে আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছি, নেতাদের একটা সুবৃহৎ অংশ পরস্পরের প্রতি অসম্মানজনক ও উস্কানিমূলক কটূক্তি প্রয়োগ করে চলেছেন। তা অন্তত পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতিফলন নয়। এমনকি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও এর ব্যতিক্রম নন। এই সমস্ত ঘটনা পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। টেলিভিশনের বিভিন্ন চ্যানেলে, ও সমাজমাধ্যমের ব্লগারদের মধ্যে এ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠতে দেখেছি। কিন্তু, ঘটনা-পরবর্তী সময়ে প্রায়শই কোনও সংবাদপত্র এই নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোকপাত না করায় বিস্মিত হয়েছি। এর কারণ আমার অজ্ঞাত। এ ছাড়াও, আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারপতি, ডাক্তার ইত্যাদি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যাঁরা লোকসভার ভোটে প্রার্থী হয়েছেন, তাঁরাও তাঁদের নিজস্ব পেশাদারি ক্ষেত্রের কথা বিস্মৃত হয়ে, পরস্পরের প্রতি যে রকম অশ্রদ্ধাজনক কটুবাক্য প্রয়োগ ও কাদা ছোড়াছুড়িতে লিপ্ত হয়েছেন, তা তাঁদের নিম্নরুচির পরিচয় বহন করে। পরস্পরকে ‘তুই’ সম্বোধন, পশুদের সঙ্গে তুলনা করা, বিরোধীদের মৃত্যু কামনা করা, আরও কত কিছু দেখা যাচ্ছে।

এই সব অনভিপ্রেত ঘটনা রাজ্যের রাজনৈতিক সাম্য ও শান্তি রক্ষার পক্ষেও ক্ষতিকর। প্রশ্ন থেকে যায়, নেতারাই যদি এই ভুল পথের প্রদর্শক হন, তা হলে তাঁদের দ্বারা প্রভাবিত আমজনতার মধ্যে রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেলে তার দায়ভার এই নেতারা গ্রহণ করবেন তো?

অতীতে আমরা রাজ্যের রাজনৈতিক বিশিষ্টজনদের মধ্যে প্রতিযোগিতা, রেষারেষি অনেক দেখেছি, কিন্তু বিরোধী দলনেতাকে আক্রমণ করার আগে ভাষা বা বাক্য চয়নের ব্যাপারে তাঁরা সতর্কতার পরিচয় দিতেন। বাক্‌যুদ্ধ করতে গিয়ে পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পেত না। কিন্তু এখনকার নেতাদের মধ্যে অপশব্দ প্রয়োগের যে ভয়াবহ প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তা রাজনীতির মানকে নিম্নমুখী করে দিচ্ছে। তাঁদের সরাসরি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় যে, রাজনীতি করছেন করুন, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের যে সম্মান ও ঐতিহ্য আছে, তা ধূলিসাৎ করার অধিকার আপনাদের কে দিল? আপনারা কি জানেন না যে, নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসারেও ব্যক্তিগত আক্রমণ বা বিদ্বেষমূলক প্রচার নিষিদ্ধ? আপনাদের এই অনৈতিক ও রুচিহীন আচরণ নব প্রজন্মের কাছে কী বার্তা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে? এটুকু পরিমিতি বোধের পরিচয় যদি দিতে না পারেন, তা হলে অসামাজিক দুষ্কৃতীদের থেকে নেতাদের পার্থক্য রইল কোথায়?

শান্তনু ঘোষ, শিবপুর, হাওড়া

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement