— ফাইল চিত্র।
অবশেষে ঝুলি থেকে সিএএ নামের বেড়ালছানা বার হয়েই গেল। সঙ্ঘ পরিবারের লক্ষ্যগুলির অন্যতম সিএএ তৈরি, এবং সারা দেশে তা চালু করা। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাঁধে চেপে আরও দু’একটা আইনের সঙ্গে সঙ্গে সিএএ-ও পাশ করিয়ে নেয়। দেশ জুড়ে চলতে থাকা প্রতিবাদে এর প্রয়োগ থমকে গেলেও বাতিল যে হয়নি, সেটা আজ প্রমাণিত। এই আইনের অন্যতম দাবিদার মতুয়া সম্প্রদায়ের লোকজন। ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য সমস্ত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও নাগরিকত্ব বিষয়ে হয়তো তাঁদের একাংশের একটা অবিশ্বাস রয়েছে। সেই বোধটাকে জাগিয়ে রাখার জন্য একটা অংশের প্রবল প্রচেষ্টাও আছে। এ বার সিএএ আইনের ফলে তাঁদের কতটা সুবিধা হয় দেখা যাক।
গত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে ব্যাপক সাফল্য, তাতে মতুয়া সমাজের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। সম্প্রতি বিভিন্ন নির্বাচনে সেই আনুগত্যে একটু টান পড়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছিল। এই আইনের প্রয়োগ সেই আনুগত্য ফেরত আনবে, এটাই বিজেপির আশা।
ইতিমধ্যে অসমের মানুষদের মধ্যে সিএএ নিয়ে স্পষ্ট বিরূপতা টের পাওয়া গেছে। তাঁদের মনে এই সন্দেহ সর্বদা খেলা করে যে, পূর্ববঙ্গ থেকে আগত বাঙালিরা অসমের মানুষদের তাঁদের নিজেদের ভূমিতে সংখ্যালঘু করে দিচ্ছেন। তাঁদের সংস্কৃতি বিপন্ন হয়ে পড়ছে। অসমে বিজেপির রাজ্য সরকার, যার নেতৃত্বে হিমন্তবিশ্ব শর্মা— এমন এক মুখ্যমন্ত্রী, যিনি গোটা দেশে গেরুয়া শিবিরে প্রবল জনপ্রিয়। তাঁর সরকার বিষয়টা কী ভাবে সামলায়, তার অনেকটাই প্রভাব পড়বে এই দেশের বুকে সিএএ-র রূপায়ণে।
পার্থ নন্দী, শেওড়াফুলি, হুগলি
ফাঁদ
লোকসভা ভোটের মুখে দেশ জুড়ে কার্যকর হল সিএএ তথা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। বিজেপি নেতারা বলছেন, এ আইন নাগরিকত্ব দেওয়ার আইন, নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার আইন নয়। এ কথা কি বিশ্বাসযোগ্য? তা হলে তো সবাইকে নাগরিক হিসাবে গণ্য করলে ল্যাঠা চুকে যেত। তবে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রশ্ন যেখানে উঠেছে সেখানে এটা কার্যত স্বীকার করে নেওয়া হচ্ছে যে, এত দিন এ দেশের ভোটারদের একাংশ নাগরিক ছিলেন না। সেই অর্থে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে, এই সরকার নাগরিক এবং অনাগরিকদের ভোটে নির্বাচিত সরকার। স্বভাবতই একটা মৌলিক প্রশ্ন উঠবে যে, তা হলে এই সরকার কি বৈধ? যদি বৈধ সরকার না হয়, তবে কি সে সরকার সিএএ বা কোনও আইন পাশ করতে পারে?
‘দ্য রিপ্রেজ়েন্টেশন অব দ্য পিপলস অ্যাক্ট, ১৯৫০’-এর ১৬ ধারায় পরিষ্কার বলা হয়েছে, যাঁরা নাগরিক নন, তাঁরা নির্বাচক হিসাবে ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন না। এ দিকে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বলছেন, সব ভোটারকে নাগরিক হিসাবে গণ্য করা যাবে না। বর্তমান ভোটাররা সকলে তা হলে নাগরিক নন— তাঁর মতে, পকেটে ভোটার কার্ড বা আধার কার্ড যা-ই থাকুক, তা প্রমাণ করবে না এক জন এ দেশের নাগরিক। দেশের প্রচলিত আইনে কিন্তু উল্টোটাই বলা আছে। তা হলে বিজেপির প্রকৃত বক্তব্য ঠিক কী?
এ হল ভোট-রাজনীতিতে শাসক দলের ভোট তোলার ফাঁদ। বেকারত্ব, দারিদ্র, মূল্যবৃদ্ধি সমস্যার সমাধানকে দূরে সরিয়ে রেখে জনগণের মধ্যে বিদ্বেষ এবং বিভাজন সৃষ্টি করে ভোট ধরার ফাঁদ পাতা হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)-এর মাধ্যমে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী, সিএএ অনুযায়ী নাগরিকত্ব প্রদানের কাজ শুরু হওয়ার সম্ভাবনা পশ্চিমবঙ্গ থেকে। ইতিমধ্যে অসমে যে ভাবে এনআরসি তালিকা তৈরির চেষ্টা হয়েছে, তাতে সিএএ নিয়ে আতঙ্ক খুবই স্বাভাবিক। সম্ভবত কোনও ‘ভোটকুশলী’-র পরামর্শে এই আতঙ্ককেই শাসক দল ভোট রাজনীতির পুঁজি করতে চাইছে।
২০১৯ সালের সংশোধিত এই আইন অনুযায়ী ‘ধর্মীয় উৎপীড়ন’-এর কারণে যে সমস্ত হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টান ‘অনুপ্রবেশকারী’ এ দেশে চলে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব প্রদানের প্রশ্নে মুসলিমদের থেকে আলাদা করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-সহ বিজেপি নেতারা বলছেন, কোনও কাগজপত্র লাগবে না, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের আগে পাকিস্তান, বাংলাদেশ বা আফগানিস্তান থেকে এসে থাকলে, আর পাঁচ বছর এ দেশে বাস করলেই ছ’টি অমুসলিম ধর্মীয় গোষ্ঠীর শরণার্থীরা ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কিন্তু সে কথা বলছে না, বলছে উল্টো কথা। প্রয়োজনীয় সমস্ত শর্ত পূরণ না করলে কোনও শরণার্থীই ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন না। কষ্টে জোগাড় করা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র-সহ দরখাস্ত প্রথম জমা পড়বে জেলা শাসক দফতরে। সেখান থেকে রাজ্য সরকার ঘুরে তা যাবে কেন্দ্রীয় দফতরে— যা এক দীর্ঘ জটিল প্রক্রিয়া। সরকারি দলের ছত্রছায়ায় না থাকলে এই প্রক্রিয়ায় উত্তীর্ণ হওয়া সহজ নয়। সেই অনুযায়ী, সীমান্ত-পেরোনো মতুয়ারাও সহজে নাগরিকত্ব পাবেন না।
এ সব আলোচনা বিস্তারিত না করেও বলা যায়, শাসক দলের উদ্দেশ্য সম্ভবত মুসলিম-বিদ্বেষকে কাজে লাগানো। এতে যে মেরুকরণ হবে, তা ভোট রাজনীতিতে নিশ্চয়ই হিন্দুত্ববাদীদের সাহায্য করবে।
গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর
সন্ত্রাসের রাজ্য
‘শিরোপার গ্লানি’ (৭-৩) শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রসঙ্গে কিছু কথা। পশ্চিমবঙ্গবাসী হিসাবে আমরা লজ্জিত যে, আন্তর্জাতিক সমাজবিজ্ঞান ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান মঞ্চে পশ্চিমবঙ্গের হিংসা এখন ‘কেস-স্টাডি’র বিষয়। এটাও লজ্জা যে, ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার অনেক আগে থেকে রাজ্যে রেকর্ডসংখ্যক কেন্দ্রীয় বাহিনী ঢুকে বেশ কিছু শিক্ষাঙ্গনে আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে বিদ্যালয়গুলির শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হতে বাধ্য। রাজ্যের নির্বাচনপর্বে হিংসার পরিবেশ রুখতে সরকার এবং পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করাটা কি অসমীচীন! অবাক লাগে, শাসক দলের কিছু প্রতিনিধি আত্মপক্ষ সমর্থন করার ছলে কথায় কথায় অন্য রাজ্যের উদাহরণ টেনে আনেন। ঠিক যেমন পূর্বের শাসক দলের মুখ্যমন্ত্রী কেবল বিহার, উত্তরপ্রদেশের প্রসঙ্গ তুলে ধরতেন।
ভোট-সংক্রান্ত হিংসার পরিমাণে এই রাজ্য দেশের মধ্যে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ার কারণ নানাবিধ। বিরোধী দলের চক্রান্তও এর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন নিরপেক্ষ ভাবে দায়িত্ব পালন করলে সমস্যা ব্যাপকতর হতে পারে না। ভোট মানেই বেশ কিছু জায়গায় অশান্তি, বোমাবাজি ও ভয়-দেখানো। ‘গণতান্ত্রিক উৎসব’-এ অন্য কোনও রাজ্যে পঞ্চায়েত ও পুরভোটে এই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয় কি? বামফ্রন্ট রেকর্ড সময় ক্ষমতায় থেকেও বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছে। তা হলে বর্তমান শাসক কেন ভুলে যাচ্ছে যে, তাদেরও ক্ষমতা হারাতে হবে অনিবার্য নিয়মে? জোরাজুরি করে গণতান্ত্রিক প্রহসন চালিয়ে যাওয়া কি নিজেদের মুখে চুনকালি লেপন নয়?
সম্পাদকীয়তে যে সত্যটি উপস্থাপিত হয়েছে তা হল, রাজ্যের বর্তমান বিরোধী দল যথেষ্ট সুপরিকল্পিত ভাবে, কার্যত সারা বছর ধরে একটা সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরি করে রাজ্যকে নাজেহাল করতে বদ্ধপরিকর। রাজ্য যদি বিষয়টি বুঝেও পাল্টা সুপরিকল্পনার মাধ্যমে বিরোধীদের দাঁত-নখ ভেঙে না-দিতে পারে, তবে তাদের ক্ষমতায় থাকার দরকার কি? পশ্চিমবঙ্গ তো একটা অঙ্গরাজ্য মাত্র। জনগণ কি আদৌ বুঝতে পারছে না, কেন্দ্রের শাসক দল কতটা সুখে রাখতে পারছে তাদের? ভবিষ্যতে জনগণই বুঝে নিক মূল সমস্যা কোথায়? আর যদি ঠিক পূর্ব জমানার মতো ঔদ্ধত্য-সহ ‘সায়েন্টিফিক রিগিং’ চালিয়ে গদি আঁকড়ে থাকার বাসনা পরিত্যাগ না-করা হয়, তবে তার উত্তরও রাজ্যবাসীর থেকে মিলবে।
শক্তিশঙ্কর সামন্ত, ধাড়সা, হাওড়া