— প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
‘কার থেকে রক্ষা?’ (১১-১) সম্পাদকীয়তে প্রশাসনের নানা রাজনৈতিক ছলচাতুরির পাশাপাশি শিক্ষিত সচেতন নাগরিক সমাজের অখণ্ড নীরবতার দিকে আঙুল দিয়ে দেখানো হয়েছে। বিলকিস বানো ধর্ষণকাণ্ডে অপরাধীদের পুনরায় জেলে ঢোকানোর নির্দেশ দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট জনমানসে নতুন ভরসা, আস্থা জাগিয়ে তুলেছে। এক দিকে নারীর চূড়ান্ত অবমাননা, অপর দিকে একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি তীব্র ঘৃণা, সম্মিলিত হত্যালীলা। অপরাধের জন্য বিন্দুমাত্র লজ্জিত বা কুণ্ঠিত না হয়ে নির্যাতনকারীরা যে বীরত্বের আত্মপ্রসাদ অনুভব করেছিল, তা-ও এই নির্যাতনকে ‘বিরলতম’ গোত্রে ফেলে। অপরাধ প্রমাণের পর ধর্ষকদের শাস্তি হয়েছিল। অথচ, গুজরাতের প্রশাসন নির্লজ্জতার চূড়ান্ত নিদর্শন রেখে বার বার অপরাধীদের প্যারোলে মুক্তি দিয়েছে, শেষে ‘ভাল আচরণ’-এর সার্টিফিকেট দিয়ে চাতুরি প্রয়োগ করে তাদের মুক্তি দিয়েছিল। আরও নির্লজ্জ কাজ দেখা গেল— যারা ওই পৈশাচিক পরিবেশে মা-মেয়ে নির্বিশেষে নারীদের, এমনকি গর্ভবতী নারীকে উৎপীড়ন করে, শিশুকে আছড়ে মারে, তাদেরই ‘বীরের মর্যাদা’ দিয়ে ফুলমালায় সংবর্ধনা দেওয়া হয়। মহামান্য আদালত এর তীব্র নিন্দা করেছে, গুজরাত সরকার তথ্যগোপন-সহ এক্তিয়ার বহির্ভূত যে ছলচাতুরি করেছে, তার নিন্দা করেছে, এবং জেলমুক্তি বাতিল করে অপরাধীদের ১৫ দিনের মধ্যে আত্মসমর্পণ করার আদেশ দিয়েছে।
এখন প্রশ্ন হল, গুজরাত সরকার অন্যায় করেছে, সুপ্রিম কোর্টে ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়েছে, এক্তিয়ার বহির্ভূত কাজ করেছে, এটা সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ। তার জন্য যাঁরা দায়ী, তাঁরা কি অপরাধী নন? অপরাধ করে থাকলে তাঁর সাজা হবে না? যে আধিকারিকগণ এক্তিয়ার বহির্ভূত আইনি প্রক্রিয়ার সুপারিশ করেছেন, তদারকি করেছেন, আদালতকে বিভ্রান্ত করেছেন, তাঁদের শাস্তি হবে না? যদি না হয় তা হলে পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব আর রইল কি?
যাদের ধর্ষণ ও হত্যার অপরাধ আদালতে প্রমাণিত, সেই বিরলতম অপরাধের অপরাধীদের মুক্তির পরে একটি বৃহৎ সংগঠন মালা পরিয়ে স্বাগত জানাল, বীরের সম্মান দিল। তার জন্যও কি ভর্ৎসনা প্রাপ্য ছিল না? ধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধকে প্রকাশ্য সমাজে বীরত্বের স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে, দেশ জুড়ে তাদের প্রতি সম্মান জ্ঞাপনের পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে, এটা কি অপরাধ প্রবণতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা নয়? সংবিধান প্রণেতাগণ কি এ রকম প্রচেষ্টাকে প্রতিরোধ করার জন্য, অপরাধ হিসাবে গণ্য করার জন্য কোনও আইনি ব্যবস্থা রাখেননি? সুপ্রিম কোর্ট যদি এ বিষয়ে কোনও পর্যবেক্ষণ করত, তা হলে কিছুটা ভরসা মিলত।
প্রশ্ন ওঠে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা নিয়েও। সর্বত্র খবরের শিরোনাম চোখে পড়ে— ‘বিলকিস বিচার পেলেন’। এই অপরাধে কি শুধু বিলকিসের ক্ষতি হয়েছে? সারা দেশের ক্ষতি হয়নি? নারীজাতির তথা মানবিকতার ক্ষতি হয়নি? এই রায়ে শুধু বিলকিস খুশি হয়েছেন, আমজনতা খুশি হয়নি? মামলায় বিলকিস কি একমাত্র ফরিয়াদি? ধর্ষণ বা হত্যার মতো জঘন্য অপরাধ তো একটি ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয় না, সমাজ তথা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ বলে তাকে গণ্য করতে হবে। সেই জন্যই তো ফৌজদারি মামলার বাদীপক্ষ রাষ্ট্র। তা হলে মিডিয়ার ভাষা এ রকম হবে কেন?
ইনাস উদ্দীন, কলকাতা-৩৭
বিষময়
সংবিধানের ৫১এ ধারাতে যে মৌলিক কর্তব্যের উল্লেখ আছে, তাতে সংবিধান মেনে চলার পাশাপাশি নিজস্ব বা যৌথ কার্যক্রমের উপর শ্রদ্ধাশীল থাকার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতির বিষে সবাই যুক্তরাষ্ট্রীয় সংসদীয় কাঠামো ভেঙে নিজেকে বা নিজেদের বড় করাটা কর্তব্য বলে মনে করছে, এবং এটাকেই ভোট প্রচারের হাতিয়ার করছে। ক্ষমতার লোভ থাকলে সংবিধান থাকবে না। লোভকে সংবরণ করতে সংবিধান রাষ্ট্রকে শিক্ষা প্রদান করতে বলেছে (৪৫ নম্বর ধারা)। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষা গ্রহণ করাটা নাগরিক অধিকার (২১এ ধারা)। যদিও সংবিধান প্রণেতারা জানতেন, শুধু শিক্ষা দিয়ে সামাজিক পরিবর্তন আসবে না। তাই সংবিধানে রাষ্ট্রকে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্য স্থাপনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বর্তমানে শিক্ষা থেকে প্রশাসন— সব ক্ষেত্রে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থকে। মিথ্যা প্রচারের জেরে গণমাধ্যমের উপর ক্রমশ বীতশ্রদ্ধ মানুষ। সঞ্জয় নারায়ণ মামলায় আদালত গণমাধ্যমকে সতর্ক করে বলেছিল, খবর পরিবেশন করার আগে তথ্য সঠিক হওয়া দরকার। ভুল তথ্য দেওয়া চলবে না। আদালতের রায়ে অবশ্য পরিস্থিতির কোনও পরিবর্তন হয়নি।
জনপ্রতিনিধিরা সংসদ বয়কট করেছেন দিনের পর দিন। অভিযোগ, সংসদে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না। তথ্য বলছে, লোকসভা রাজ্যসভার আলোচনার সময় অনেকটা কমেছে। মন্ত্রীরাও গরহাজির থাকেন। তাঁদের কাছে দলীয় কাজই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দুর্ভাগ্যের এটাই, এক দিকে আইন প্রণয়ন করে সংবিধানের আদর্শকে খুন করা হচ্ছে, বিরোধীরাও আলোচনা থেকে বিরত থাকছেন। অন্য দিকে, রাজ্য-রাজ্যপালের তরজাতে সন্ধের টক-শো জমে উঠেছে। রাজ্যপালকে নানা কুরুচিপূর্ণ কটাক্ষ করছেন মন্ত্রীরা। সংবিধানের লজ্জা!
জনগণের কথা সংবিধানের প্রস্তাবনাতে উল্লেখ থাকলেও চুপ থাকা ছাড়া আমাদের আর কোনও বিকল্প নেই। জোর করে সংবিধান মানাতে বাধ্য করার বোধ হয় কোনও আইন নেই। থাকলে হয়তো বিবেকের চোরাবালিতে সংবিধানের আদর্শ হারিয়ে যেত না। রাষ্ট্র যদি সত্যিই সংবিধানের প্রতি যত্নবান হত, তা হলে ৩৯ নম্বর ধারার স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হত, যা অধ্যাপক অমর্ত্য সেন বার বার বলেছেন— নারী পুরুষের সমান বেতন, জীবনধারণের অধিকার, শিশুবিকাশ, স্বাস্থ্য সচেতনতা।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই রাজনীতি!
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
অস্বচ্ছ বঙ্গ
‘স্বচ্ছ সর্বেক্ষণ ২০২৩’-এর রিপোর্টে দেখা গিয়েছে যে, সমগ্র দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান বেশ খারাপ। বস্তুত, এই রিপোর্ট নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতোর যা-ই থাকুক না কেন, এক জন নাগরিক হিসাবে এটা দুঃখের। সে ক্ষেত্রে নাগরিক হিসাবে আমাদের ভূমিকা আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। নাগরিকদের জঞ্জাল সম্পর্কে সচেতনতার যথেষ্ট অভাব আছে। যত ক্ষণ পর্যন্ত আমরা নিজেদের পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন না হব, তত ক্ষণ আমাদের এই রকম রিপোর্টই আসতে থাকবে। বর্তমানে, আমরা নিজেদের ঘর ছাড়া কোনও কিছুকেই নিজের মনে করি না। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা বড় বড় আবাসনের বাসিন্দাদের একাংশের মধ্যে রাস্তায় বেরিয়ে পুরসভার গাড়িতে আবর্জনা ফেলার ব্যাপারে বড়ই অনীহা দেখা যায়। অনেকেই যেখানে একটু জনসমাগম কম দেখেন, সেখানেই জঞ্জাল ফেলে দায়মুক্ত হন। নাগরিকদের সচেতনতার পাশাপাশি প্রশাসনেরও এ ক্ষেত্রে কঠোর পদক্ষেপ করার প্রয়োজন আছে।
কলকাতা পুরসভা-সহ রাজ্যের অনেক পুরসভাই গৃহস্থালির আবর্জনা ফেলার জন্য দু’টি পাত্র প্রত্যেক বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করেছিল। একটি পাত্র শুকনো আবর্জনার জন্য এবং অন্যটি ভেজা আবর্জনার জন্য। উদ্দেশ্য ছিল প্লাস্টিক দূষণ কমানো। উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। কিন্তু অধিকাংশ বাড়িতেই সেটা হয় চাল, আটা কিংবা জল রাখার পাত্রে পরিণত হয়েছে। পুরসভাগুলি মাঝে মাঝেই প্রচার করে একটি নির্দিষ্ট মাইক্রনের নীচের পলিথিনের ব্যবহার করা যাবে না এবং সেটি ধরা পড়লেই জরিমানা করা হবে ক্রেতা এবং বিক্রেতা উভয়কেই। প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হল না। যে শহর এক সময় ভারতের নির্মল শহরের মর্যাদা পেয়েছিল, সে কিনা এখন ভারতের দূষিত শহরগুলির মধ্যে স্থান পাচ্ছে।
চন্দ্র মোহন নন্দী, কলকাতা-৭৮