Text Books

সম্পাদক সমীপেষু: পাঠকহীন পাঠ্যবই

এই প্রবণতা এক দিনে তৈরি হয়নি। এর জন্য দায়ী, বহু বছর ধরে চলতে থাকা বেশ কয়েকটি প্রকাশক কর্তৃক নোটবই বিপণনের রমরমা।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২১ ০৫:৫৯
Share:

সন্দীপন নন্দীর ‘পাঠ্যবইরা কি জাদুঘরে থাকবে’ (১২-৩) লেখাটির সঙ্গে কিছু কথা যোগ করতে চাই। কলকাতার অনতিদূরে বাংলামাধ্যম একটি স্কুলে দশ বছরেরও বেশি শিক্ষকতার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই পড়ার পরিবর্তে নোটবই কিংবা বিভিন্ন কোচিং সেন্টার-প্রদত্ত নোটস পড়ার প্রতি বেশি ঝোঁক। পড়াতে গিয়ে ম্যাপ, ছবি, নানা রকমের ‘টিচিং-লার্নিং মেটেরিয়াল’-সহ ব্ল্যাকবোর্ড ব্যবহারের মাধ্যমে পাঠদান আকর্ষক করা সত্ত্বেও এক শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসে পাঠ্যবই নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রবল অনীহা দেখা গিয়েছে। প্রতি দিনই গোয়েন্দাগিরি করতে হয় পাঠ্যবই নিয়ে এসেছে কি না জানতে। নোটবই, নোটস, সাজেশন-ভিত্তিক পড়ার ফলে পাঠ্যবই ভাল করে পড়া, কিংবা পাঠ্যসূচির সঙ্গে সম্পর্ক-যুক্ত ‘সমধর্মী’ বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ নেই বললেই চলে।

Advertisement

অবশ্য, এই প্রবণতা এক দিনে তৈরি হয়নি। এর জন্য দায়ী, বহু বছর ধরে চলতে থাকা বেশ কয়েকটি প্রকাশক কর্তৃক নোটবই বিপণনের রমরমা। কেউ বলছেন ‘সায়েন্টিফিক সাজেশন’, কারও নোটবই ‘ভ্যাকসিন’ হিসেবে বিজ্ঞাপিত হচ্ছে। কোনও নোটবই ৯০ শতাংশ সাফল্য দাবি করছে। বিভিন্ন প্রকাশনীর বিজ্ঞাপনের মুখ সিনেমার তারকা, ক্রিকেট অধিনায়ক, বিগত বছরের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় স্থানাধিকারী ছাত্রছাত্রীও। এঁরা কি বোঝেন, এই সব নোটবই পড়তে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের কী ক্ষতি হচ্ছে? ছাত্রছাত্রীরা দিনভর টিভিতে এই সব ‘সেকেন্ডারি টেক্সট বই’-এর বিজ্ঞাপন দেখছে, আর কিনছে। পড়ার টেবিলে মূল পাঠ্যবই নোটবইয়ের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ, প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করে সরকার পাঠ্যবই বিলি করে। স্কুলে ‘বুক ডে’ পালিত হয়।

অরুণ মালাকার, কলকাতা-১০৩

Advertisement

প্রশ্নও তেমন

‘পাঠ্যব‌ইরা কি জাদুঘরে থাকবে’ প্রসঙ্গে বলতে চাই, পাঠ্যব‌ইয়ের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের অনীহার মূল কারণ হল পাঠ্যব‌ই স্বয়ং। প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যব‌ইগুলো এমন ভাবে রচিত হয়েছে, যাতে মূল বিষয় জানতে ঘুরিয়ে নাক দেখানোর পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। এ দিকে শিক্ষার্থীর ঘাড়ের কাছে সব সময় পরীক্ষার নিশ্বাস। চটজলদি পরীক্ষা বৈতরণি পার হতে গেলে পাঠ্যব‌ইকে একমাত্র সম্বল করলে এখন ঠকতে হয়।

আর একটি কারণ, প্রশ্নপত্রের ধরন। প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিক পর্যায়ে এমন ভাবে প্রশ্নপত্র সাজানো হয়েছে, তাতে তৈরি-করা উত্তর লেখা ভিন্ন উপায় থাকে না। উচ্চ প্রাথমিক শ্রেণিগুলির জন্য পরিষদ-নির্দেশিত কোনও অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক নেই। যে সব কোম্পানি বা প্রকাশনী পাঠ্যপুস্তক ছাপে, তাদের নির্দিষ্ট সহায়িকা ব‌ইও আছে। ফলে পাঠ্যপুস্তকের পাতায় এ ধরনের নির্দেশ‌ও লেখা থাকে— অমুক প্রকাশনীর সহায়িকায় এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে।

কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা আলাদা। বিশেষ করে ভাষা সাহিত্যে। বেশ মনে পড়ে, অনার্সের প্রথম বর্ষে আমাদের অন্নদামঙ্গল, কাব্যজিজ্ঞাসা পড়াতেন বিশিষ্ট কবি অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়। কেউ কেউ পাঠ্যব‌ই না নিয়েই ক্লাসে চলে আসত। স্যর কিন্তু মূল টেক্সট ব‌ই ছাড়া কাউকে ক্লাস করার অনুমতি দিতেন না।

শঙ্খ অধিকারী, সাবড়াকোন, বাঁকুড়া

কেন রমরমা

সন্দীপন নন্দীর পর্যবেক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ এবং সময়োপযোগী। মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিক করতে গিয়ে উপেক্ষিত হয়েছে সৃজনশীলতার চর্চা। শিক্ষার্থীদের নিজস্বতা বা মৌলিকতা প্রকাশের পরিসর প্রায় কোথাও নেই। পাঠ্যবইগুলি এমন ভাবে রচিত হয়েছে যে, তথ্য ও ব্যাখ্যার প্রয়োজনে সহায়িকা প্রায় অপরিহার্য। করোনার প্রভাবে দীর্ঘ ১১ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় সহায়িকা বইয়ের উপর ছাত্রছাত্রীদের নির্ভরতা অনেক গুণ বেড়েছে।

পাঠ্যবই এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য শিক্ষকদের যে ভূমিকা, দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকায় সেখানে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। প্রকাশনা সংস্থাগুলি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অবিরত বিজ্ঞাপন ও কৌশলী প্রচার করছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে এই ভাবনা দৃঢ় করে তোলা হয়েছে যে, সহায়িকা বইগুলিই হল আসল। শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং আদর্শ সম্বন্ধে কারও মাথাব্যথা নেই।

অপূর্ব সৎপতি, সীতারামপুর হাইস্কুল, বাঁকুড়া

টুকেও ফেল

সন্দীপন নন্দী নোটসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার চিত্র তুলে ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে মুক্ত বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সম্পর্কে দু’টি অভিজ্ঞতা জানাই। এক, আমার পরিচিত এক ছাত্র স্কুলে পাশ করতে না পেরে মুক্ত বিদ্যালয়ের আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে নোট দেখে উত্তর লেখার সুযোগ আছে জেনে সে পড়াশোনা করেনি। পরীক্ষার হলে যথারীতি হাতে-লেখা ছোট ছোট চিরকুট দেওয়া হয়েছিল। সেখান থেকে উত্তর খুঁজে লিখতে বলা হয়। কিন্তু সে হস্তাক্ষর ঠিক পড়তে পারেনি এবং সঠিক উত্তর খুঁজে পায়নি। তাই দেখে লিখেও সে পাশ করেনি।

দুই, এক ছাত্র উচ্চ মাধ্যমিকের পর কলেজে ভর্তি হয়ে পড়া মনে রাখতে না পেরে মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু গ্র্যাজুয়েট হওয়ার বাসনায় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি কেনার আশায় সম্প্রতি কলেজের পাঠ শুরু করেছে। ছেলেটির বাবার বক্তব্য, নোটস জ়েরক্স করে দিয়ে দিচ্ছে ঠিকই, কিন্তু তাঁর ছেলে যে রকম সাদাসিধে, তাতে সেই নোটস পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখে ঠিকঠাক লিখতে পারবে কি? আরও অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে মাধ্যমিক বোর্ডের পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে মুক্ত বিদ্যালয় থেকে পাশের সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করেছে পরীক্ষার্থী। সব জেনেও মুক্ত বিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি কেনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে কেন? এদের অনুমোদন বাতিল করা হোক।

প্রদ্যোৎ পালুই, বিষ্ণুপুর, বাঁকুড়া

কোচিং-রাজ

‘পাঠ্যবইরা কি জাদুঘরে থাকবে’— এ প্রশ্ন বহু দিন ধরেই প্রাসঙ্গিক। বাজারচলতি নোটবই ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যপুস্তক-বিমুখতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চটজলদি সাফল্যের মোহে তাদের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান একেবারেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কোচিংয়ের শিক্ষকরাও উপদেশ দিচ্ছেন, অমুক প্রকাশনীর তমুক বইটা কিনলে তোমরা পরীক্ষায় এত শতাংশ ‘কমন’ পাবে। পাড়ার দোকানে নোটবই কেনার হিড়িক পড়ে যাচ্ছে। নোটবই প্রকাশকের তরফে নির্দিষ্ট শতাংশ কমিশন ঢুকে যাচ্ছে সেই কোচিংয়ের শিক্ষকদের পকেটে।

সায়ন তালুকদার, বরাহনগর, উত্তর ২৪ পরগনা

বিষফোড়া

ছোটবেলা থেকে জানি, অঙ্ক আর বিজ্ঞানে যারা দুর্বল, ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি না পড়াই শ্রেয়। অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন-এর (এআইসিটিই) শিক্ষা-বিশেষজ্ঞদের অভিমত কাগজে দেখে অবাক হতে হল, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্যে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে অঙ্ক আর পদার্থবিদ্যার পাঠ নেওয়া বাধ্যতামূলক থাকছে না (‘পদার্থবিদ্যা ও অঙ্ক না-পড়েই ইঞ্জিনিয়ারিং!’, ১৩-৩)। অঙ্কের জন্যে একটি ব্রিজ কোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছে, এবং তা শুধুমাত্র অঙ্কে দুর্বলদের জন্য। কী অদ্ভুত যুক্তি! যে সব ছাত্রছাত্রী দুর্বল, তারা ওই ব্রিজ কোর্স করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বে? এটা বিশ্বাসযোগ্য? শিক্ষাকে কোন অবনমনের দিকে টেনে নামানো হচ্ছে! এমনিতেই গোবর আর গোমূত্রের দাপটে শিক্ষাক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য। তার উপর এই বিধান যেন গোদের উপর বিষফোড়া।

সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা-১০৪

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement