যুক্তিনির্ভর মানুষের সংখ্যা কুসংস্কার মেনে চলা মানুষের চেয়ে চিরকালই কম।
সোমক রায়চৌধুরীর প্রবন্ধের (‘সূর্য-চাঁদের মায়াবী খেলা’, ৭-১২) জন্য ধন্যবাদ। কার্য-কারণ যুক্তিনির্ভর মানুষের সংখ্যা কুসংস্কার মেনে চলা মানুষের চেয়ে চিরকালই কম। তবু দু’টি বিষয় এখানে তুলে ধরতে চাই। এক, আমাদের দেশে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোত্তম প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিদেরও আমরা দেবতার দুয়ারে মাথা ঠুকতে দেখি। তাঁরা ব্যক্তিজীবনে ঈশ্বরবিশ্বাসী হতেই পারেন। কিন্তু তাঁরা যে পদে আসীন, সেই পদের মানুষের কোনও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কাছে মাথা নোয়ানোকে সাধারণ বিশ্বাসী মানুষ তাঁদের নিজের মতো ব্যাখ্যা করেন। বিশ্বাসীরা তাঁদের সন্তান, সংসারের মঙ্গল কামনায় যে চূড়ান্ত অযৌক্তিক কাজগুলি বছরের পর বছর ধরে করে আসছেন, যেমন গ্রহণের সময় খাবার ফেলে দেওয়া বা তাতে তুলসীপাতা দিয়ে রাখা ইত্যাদি সেই সংস্কারে ইন্ধন জোগায়। তাই আমাদের দেশের বিজ্ঞানী, গবেষকদের একটু চিন্তাভাবনা করা উচিত।
দ্বিতীয়ত, যে গুরুর উল্লেখ প্রবন্ধকার তাঁর লেখায় করেছেন, তিনি অত্যন্ত সুবক্তা এবং বুদ্ধিমান। এই গুরুর দল আজকাল কৌশল বদল করেছেন। তাঁরা বুঝে গিয়েছেন যে, সম্পূর্ণ সমর্পণ ভক্তদের থেকে আশা করা মুশকিল। দু’-এক দিন পর তাদের মোহভঙ্গ হবে। তাই এঁদের গুরুবাণীর মধ্যে বিজ্ঞানের ভেক ধরে অপবিজ্ঞান, যুক্তির ভেক ধরে অযুক্তি ঢুকে পড়ে। যেমন, শিবরাত্রির মহা আয়োজনে সেই গুরু উপস্থাপন করেন, পূর্ণিমা-অমাবস্যায় সমুদ্রের জল উথালপাথাল করে। আমাদের শরীর তো সত্তর শতাংশ জল দিয়েই তৈরি। শরীরও তাই ওই দিনগুলিতে মহাজাগতিক টান অনুভব করতে বাধ্য। আমরা টের পাই না, সে শুধু আমাদের অজ্ঞতামাত্র। এই ব্যাখ্যা শুনে ভক্তকুল আপ্লুত। কিন্তু, একটা পুকুর বা বড় দিঘিতে তো একশো শতাংশই জল। কই, সেখানে আমরা জোয়ার তো দূরের কথা, আলাদা করে একটা ঢেউও দেখতে পাই না— এই প্রশ্ন কেউ তোলে না।
আমরা ছেলেমেয়েদের বড় বাধ্য করে মানুষ করি। অপ্রিয় প্রশ্ন করতে শেখাই না। এই অল্পবয়সিরাই কিন্তু কুসংস্কারের বেড়াজাল উপড়ে ফেলতে পারে। তবে তা হতে বোধ হয় আরও একশো বছর লাগবে।
তন্ময় মুখোপাধ্যায়, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
মহাজাগতিক
চোখের সামনে মুষ্টিবদ্ধ হাত হিমালয়কেও ঢেকে দিতে পারে। কিন্তু তাতে হিমালয়ের মহিমা খর্ব হয় না। একই রকম ভাবে কুসংস্কারে আবিষ্ট হয়ে আমরা যদি প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ না করি, তাতে আমাদেরই জ্ঞানভান্ডারের ক্ষতি হবে। কিছু বিরল পূর্ণ কিংবা খণ্ডগ্রাস গ্রহণের দৃশ্য যা আমাদের গোটা জীবনে এক বা দু’বার কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখার সুযোগ ঘটে, আমরা তার থেকে সারা জীবনের জন্য বঞ্চিত হব। পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের সময় যখন চাঁদ তার চাকতি দিয়ে সূর্যকে আচ্ছাদিত করে ফেলে, তখন বিশেষ প্লেট বা চশমার মধ্যে দিয়ে দেখলে অতি অল্প সময়ের জন্য ধরা পড়ে সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা অপূর্ব মায়াবী ছটা। দিবালোকে নেমে আসে জাফরি কাটা ঝুরো আঁধার, দেখা দেয় মুক্তোর মালা, পাখিদের অসময়ে বাসায় ফেরার তাড়না, আরও কত দৃশ্য। কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা যায় হিরের আংটি। কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে এই মহাজাগতিক দৃশ্য দেখবে না সাধারণ মানুষ!
কুসংস্কারাচ্ছন্ন ব্যক্তিরা অনেকে গ্রহণের পুরো সময়কালটিকেই অশুভ পর্যায় বলে মনে করেন। রান্নাবান্না, খাওয়াদাওয়া, পূজার্চনা, এমনকি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার মতো স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপও সাময়িক ভাবে বন্ধ রাখেন। তুলসীপাতা, গঙ্গাজল, গঙ্গাস্নান, কীর্তন এ সব তো আছেই। অথচ, দীর্ঘকাল থেকেই আমাদের শিশু-কিশোর পাঠ্যে অতি সহজ ও প্রাঞ্জল ভাবে সূর্য-চন্দ্র গ্রহণের, জোয়ার ভাটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তবু কেন আমরা আজও চেতনাগত দিকে ভাববাদ থেকে বস্তুবাদী দর্শনে উন্নীত হতে পারলাম না, সেটা ভাবার বিষয় বটে। সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের কাছে আবেদন, শুধুমাত্র নিজেদের আলোকিত করলে হবে না, কুসংস্কারের আঁধারে আজও যাঁরা নিমজ্জিত, তাঁদেরকেও নিয়ে আসতে হবে বিজ্ঞানবোধের এই আলোকবৃত্তে।
বিশ্বদীপ ভট্টাচার্য, অশোকনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
অপবিজ্ঞান
সোমক রায়চৌধুরীর লেখাটি যথাযথ। আগে অজ্ঞতাই ছিল মূলত কুসংস্কারের উৎস। গ্রহণের মতো ঘটনাগুলোর কারণ জানা না থাকায় একটা মনগড়া কারণ ফাঁদা হত, যা সামাজিক ও ধর্মীয় অনুমোদন পেয়ে যেত এবং নানা রকম আচার, বিধিনিষেধ আরোপে সংস্কারে পরিণত হত। তবে এই সব কুসংস্কারের মধ্যে সব সময় ব্যক্তিস্বার্থ জড়িয়ে থাকত না। এখন স্বার্থ থেকেই কুসংস্কারের উদ্ভব। অপবিজ্ঞান ও কুযুক্তির সমাহারে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা হয় এবং মানুষ ঠকানোর কাজে লাগানো হয়।
প্রাচীনকাল থেকে কিছু কুসংস্কার দীর্ঘকাল ধরে লালিত হওয়ার সুবাদে মানুষের এমনই আত্তীকরণ হয়ে গিয়েছে যে, মানুষ যুক্তি দিয়ে তার অসারতা, এমনকি অপকারিতা বুঝেও তাকে ফেলতে পারছে না। প্রাচীন জ্ঞানকে অনেক সময় উচ্চতর বিজ্ঞানের শামিল বলে তুলে ধরে সেই কুসংস্কারের পক্ষে সওয়ালও করা হয়— লেখক তেমনটাই বলেছেন। ক্ষমতাবান মানুষ এক দিকে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে, অন্য দিকে অধিক ক্ষমতা লাভের লোভে দেবদেবীকে হাতে রাখতে চান। ক্ষমতার অপব্যবহার করতেও তাঁরা দেবদেবীর সাহায্য চান। সৃষ্টি করেন কিছু অপসংস্কৃতি। মাদুলি, কবচ, দশ আঙুলে নানাবিধ আংটি শোভা পায়। বিত্তশালী, ক্ষমতাবান মানুষ যখন এই সমস্ত অপসংস্কৃতিকে মান্য করেন, তখন সাধারণ মানুষ অবজ্ঞা করতে সাহসও পান না। শিক্ষার প্রসার সত্ত্বেও দৈবের দোহাই দিয়ে বুজরুকি দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। আগে গণেশকে ভোগ নিবেদন করে তা মানুষ খেত। শিক্ষিত সমাজে গণেশ নিজেই খেয়ে ফেলছে দুধ। কিছু মানুষের মনে এর প্রভাব পড়ছেই। আজকের দিনে যখন গোমাতার মাহাত্ম্য বাড়ানোর জন্য কোভিডের মতো মারণরোগেও ভ্যাকসিনের পরিবর্তে গোময় গোমূত্র সেবনে উদ্বুদ্ধ করে মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, বহু শিক্ষিত মানুষও একে মেনে নিচ্ছেন, তখন মনে হয় কোথায় যাই!
কৃষিপ্রধান ভারতে গরুর প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিসীম। গরুকে তাই দেবতার মতো পুজোও করা হত। আজ গরুর প্রয়োজনীয়তা কমেছে। অথচ, গুরুত্ব বেড়ে গিয়েছে। তাকেই দেবতা মানা হয়। তাই আজকের দিনে গরুর রচনা লেখা বোধ হয় ছাত্রদের কাছে কঠিন কাজ।
দুর্গেশ কুমার পান্ডা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
গ্রহণের স্মৃতি
সোমক রায়চৌধুরী সূর্যগ্রহণ চন্দ্রগ্রহণ ইত্যাদি মহাজাগতিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে সমাজের নানা কুসংস্কারের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে বাল্যস্মৃতি জেগে উঠল। মাত্র চার দশক আগেও ১৯৮০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি যে পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ হয়েছিল, সে দিন মানুষ যাতে রাস্তাঘাটে না বেরোন, সে জন্য দূরদর্শনের পর্দায় পথের পাঁচালী ছবিটি দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মাঝেমাঝে দূরদর্শনের পর্দাতেই সূর্যগ্রহণ দেখানো হচ্ছিল। সঙ্গে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের প্রাসঙ্গিক আলোচনা। কিন্তু মাত্র পনেরো বছর পর ২৪ অক্টোবর, ১৯৯৫ সালে আর একটি পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণের বেলায় সংস্কারমুক্তির একেবারে অন্য ছবি দেখেছি। তত দিনে প্রশাসন ও মানুষের ভয় কেটেছে। দলে দলে তাঁরা ছুটে গিয়েছিলেন ডায়মন্ড হারবার অঞ্চলে স্বচক্ষে পূর্ণগ্রাস দেখার অভিপ্রায়ে। পরবর্তী পূর্ণগ্রাস ২০০৯-এর বেলাতেও এই নির্ভয় জনস্রোত দেখেছি। কিন্তু সমগ্র সমাজের সংস্কারমুক্তির জন্য হয়তো আরও অপেক্ষা করতে হবে।
সুগত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা-৫৬