—প্রতীকী চিত্র।
‘অ-নিয়মের পাহাড়’ (১-৯) শীর্ষক প্রবন্ধে পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায় বিশৃঙ্খল উন্নয়ন ও বেহিসাবি আচরণকে বিপর্যয়ের কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। উন্নয়নের তাড়নার নেপথ্যে পুঁজি ও বাণিজ্য। পাহাড় থেকে সমতল, গ্রাম থেকে মহানগর, পরিবার থেকে সমাজ— কোথাও, কিছু, কেউ বিচ্যুত হতে রাজি নয় ‘উন্নয়ন’ থেকে। জীবনযাপনে আয়েশি হয়ে ওঠাই যেন উন্নয়ন। মিতচারী জীবনযাপন, পরিবেশ, প্রান্তিক জনের অধিকার অবান্তর, বাণিজ্যেরই অগ্রাধিকার। উন্নয়ন প্রয়োজন, কিন্তু বাহ্যিক উন্নতির ভারসাম্য রক্ষা পায় মানসিক উত্তরণে। চেতনার উন্নতি বাদ দিয়ে রাষ্ট্র বা তার আমুদে নাগরিকদের কাছ থেকে বাঁধের বিপদ, মাটির ভঙ্গুরতা, জলবিদ্যুতের বিপদ, পর্যটক সংখ্যার নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিভিন্ন সঙ্কট বিষয়ে চিন্তাভাবনা প্রত্যাশা করা এক অলীক চাহিদা বইকি।
উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কু মহারাজ প্রমুখের লেখা আশ মিটিয়েছে অগণিত ভ্রমণপিপাসুর, যাঁরা মনে করতেন এ পথ কষ্ট স্বীকারের, ত্যাগ-তিতিক্ষার। সেগুলি যাঁরা মানতে পারবেন না, এই সব পথ তাঁদের জন্য নয়। সব পথ সব পথিকের জন্য নয়— এই বিনম্রতা, মান্যতা, অনুভবী উত্তরণ চার দশক আগেও ছিল। তাই এই সব যাত্রায় থাকতেন না আমুদে, বিলাসব্যসনে অভ্যস্ত জনতা। ছিল নির্জনতা, অন্বেষণ। প্রয়োজন ছিল না নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, এবং বিদ্যুৎ-নির্ভর আরামদায়ক যন্ত্রসমূহের, রিসর্টের।
কিন্তু সব পথে সবাইকে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে এসে গেল পর্যটন শিল্প, ট্র্যাভল এজেন্সি। হোল্ড-অল, স্টোভ, রসদের রেশন নিয়ে দীর্ঘ পদযাত্রা বাতিল হল। তীর্থযাত্রী নয়, বিলাসী পর্যটকদের টানতে যত্রতত্র গড়ে উঠল হোটেল, রিসর্ট। পিছু হটে যেতে থাকল চটি, ধর্মশালা, সরাইখানা। এশিয়ার উচ্চতম ও দীর্ঘতম চার ধাম প্রকল্পের ঝাঁ-চকচকে রাস্তায় পিলপিল করে উঠে আসতে লাগল টুরিস্ট। কাঁধে ঝোলা, কাঁখে পুঁটলি নয়; চড়াই, উতরাই, পাকদণ্ডী বেয়ে হাঁপ ধরে চটিতে জিরিয়ে আর নয়। চাই মাখন-মসৃণ রাজপথ। প্রবল বিস্ফোরণে তাই ধস নামিয়ে তৈরি হয়েছে চারধামের তকতকে রাস্তা, উত্তরাখণ্ডের আদিমতাকে খণ্ড-বিখণ্ড করে। চলছে দু’চাকা, চার-চাকার গাড়ি। এই নব্য রুচির চাহিদায় গভীর রাত পর্যন্ত জেগে থাকতে হবে পাহাড়কে। চাই নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা। অতএব চাই অপর্যাপ্ত বিদ্যুৎ। সুতরাং, মাটির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বিবিধ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। মাইন ফাটিয়ে বিস্ফোরণ। এবং এই পরিণাম।
এই তালিকায় ক্রমশ আরও জুড়ে যাবে দুর্গম হিমালয়ের বুকে একদা লুকিয়ে থাকা নিভৃত তীর্থক্ষেত্ররাজি। স্বখাতসলিলে জনপদ, জনপ্রাণ ধ্বংস তাই অবধারিত। হিমালয়কে রক্ষা করতে চাইলে হিমালয়ের জঙ্গল, নদী, নিভৃতিকে রক্ষা করতে হবে। মেনে চলতে হবে, সব পথে সব পথিকের অধিকার নেই।
মানস দেব, কলকাতা-৩৬
দারিদ্রমুক্তি
অচিন চক্রবর্তীর ‘সাড়ে ১৩ কোটির মুক্তি?’ (৫-৯) শীর্ষক প্রবন্ধের শিরোনামের মর্মার্থের সঙ্গে আমি একমত। অর্থনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণ করা হয় সংগৃহীত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে। বেশির ভাগ তথ্য মিলেছে আবার নমুনা সমীক্ষার মাধ্যমে। অনেক সময় রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের জন্য ‘তৈরি করা’ তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ফলে তথ্যগুলি অনেকাংশই বিকৃত হতে পারে, যা বাস্তবের প্রতিফলন নয়। ওই বেঠিক তথ্য নিয়ে তৈরি তত্ত্বের উপর দিয়ে যে ছবিটা হবে, তা কতটা যথাযথ হবে, সেটা বেশ সন্দেহজনক।
মাথাপিছু ব্যয় কমলে বা বাড়লে দারিদ্রসীমা কতটা হেরফের হবে, সেটা তার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত হতেও পারে, না-ও পারে। কারণ, এই মাথাপিছু বিষয়টাই গোলমেলে। সেই সমস্যা থেকে বাঁচতেই বহুমাত্রিক দারিদ্রসূচক গ্রহণ করা হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের তত্ত্ব সে ক্ষেত্রে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য। কিন্তু অর্থনীতি চলমান সমাজবিজ্ঞান। সে জন্য আবার নতুন তত্ত্ব হাজির হয়, নতুন মাত্রা সংযোজিত হয় যথাসম্ভব নির্ভুল গণনা করতে। প্রতিবন্ধকতাগুলি যথাসম্ভব কম করার জন্য।
লেখক বলেছেন, “শিক্ষা স্বাস্থ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা।” ঠিক কথা। অপুষ্টির কারণ হিসাবে এই দুই মাত্রা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। মাথাপিছু আয় বা ব্যয় এক থাকলেও এই দুই মাত্রার জন্য অপুষ্টি বাড়তে পারে। শিক্ষার সঙ্গে মেয়েদের বিবাহের বয়স সমানুপাতিক সম্পর্কযুক্ত। এখনও অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হয়, তবে তা প্রধানত দরিদ্র পরিবারেই। ‘ধনীতম’ বাড়িতে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে প্রায় হয় না বললেই চলে। অপুষ্টির পরিমাণ ধনী পরিবারে কম হবেই। পশ্চিমবঙ্গ আর গুজরাতের সমাজব্যবস্থা, অর্থনৈতিক পরিকাঠামো, তাদের বাজেটে সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যয়ের ভিন্নতা, দু’টি আলাদা চিত্র তুলে ধরে। নানা অনুদানের মাধ্যমে দারিদ্রের স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। স্বল্পকালে ক্রয়ক্ষমতা বেশি হয়। সেই মাত্রার নিরিখে দারিদ্রসূচক ভাল ফল দেখায়। কিন্তু ভবিষ্যতের চিত্র আলাদা হবে। অর্থনীতির তত্ত্বগুলোর পিছনে কতকগুলি ‘ধরে নেওয়া’ বিষয় থাকে। সেগুলো নড়াচড়া করলে ফলেও হেরফের হবে।
শেষে বলি, অর্থনীতিকে বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণ করে রাজনীতি। অনেক সময় তাদের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য তৈরি হয়। বিশেষ করে ভোট সামনে এলে। কিছু কিছু মাত্রাকে চাপা দিয়ে খিচুড়ি তৈরি করে জনগণকে খাওয়ানো হয়। একই বিষয়ের ফলকে এক জন ভুল বলে তো এক জন ঠিক। সব যুক্তি কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আর এ ক্ষেত্রে, এই বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে পাওয়া ফল যার পক্ষে যাবে, সে নিজের ঢাক পেটাতে তাকে ব্যবহার করবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখতে হবে ভবিষ্যতের জনসমীক্ষা কী বলে। সেখানে খোলা চোখে দেখাটা জরুরি।
শুভেন্দু মন্ডল, বগুলা, নদিয়া
বিজ্ঞানের পুঁজি
রূপালী গঙ্গোপাধ্যায় ‘চন্দ্রযান ও ঘোর অমাবস্যা’ (২-৯) শীর্ষক লেখায় সরকারি বরাদ্দের কথা উল্লেখ করেছেন। আমি সংযোজন করতে চাই, শুধু সরকারি কেন, বেসরকারি বরাদ্দও কম। আইপিএল-এ যে পরিমাণ বরাদ্দ থাকে, বিজ্ঞান ও গবেষণায় তার এক শতাংশও থাকে না। আর সরকারি-বেসরকারি যৌথ সাহায্য না থাকলে গবেষণায় প্রগতি আসবে না। ভারতে গবেষণার ক্ষেত্রে বেসরকারি অবদান মাত্র ৩৫ শতাংশ, যেখানে ইজ়রায়েলের ৮৮ শতাংশ। আক্ষেপ আরও দু’টি। প্রথমত, ১৯৮০ সালে ভারত আর দক্ষিণ কোরিয়া এক স্থানে ছিল। আজ তাদের পথ দুটো ভিন্ন দিকে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, রাজনীতিবিদরাই অভিযোগ করছেন, যাঁরা গবেষণার কাজে যুক্ত তাঁরা নিয়মিত বেতন পান না। তবু আশা থেকে যায়, সময় হয়তো পাল্টাবে।
তন্ময় কবিরাজ, রসুলপুর, পূর্ব বর্ধমান
ডাক শুনে চেনা
গ্ৰামবাংলার পশু-পাখির বিভিন্ন ডাক নানা সময়কে নির্দেশ করে। ডাক শুনে সময়টা বুঝে নেওয়া যায়। অন্তত যাঁরা গ্ৰামে থাকেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন সেই সময়। যেমন বলা হয়, কাকডাকা ভোর বা কাকভোর। বেশ প্রচলিত এই সব কথা। তেমনই শোনা যায় ঘুঘু ডাকা দুপুর। ঘুঘু মূলত কোলাহল-মুক্ত নির্জন জায়গায় থাকতে পছন্দ করে। আর দুপুর মানেই নির্জনতা। আবার শোনা যায় ‘বসন্তের কোকিল’। একটা নির্দিষ্ট ঋতুতে তার আগমন জানান দেওয়ার উদ্যোগ। শেয়ালের ডাক সারা রাতে তিন বার সমস্বরে শোনা যায়। সন্ধের পর, মাঝরাত ও ভোরবেলা। সময়ের সঙ্গে সেই ঝোপঝাড়, জলাজঙ্গল যেমন কমছে, তেমনই কমছে বন্যপ্রাণী ও পাখপাখালি। তাই তাদের বাসস্থান সংরক্ষণ জরুরি। নিশ্চিত করতে হবে নিরাপত্তা এবং খাদ্যের বিষয়টিও।
সনৎ ঘোষ, বাগনান, হাওড়া