সাভারকর।
বিদ্যুৎ চক্রবর্তী তাঁর নিবন্ধে (‘সাভারকরের ভাবাদর্শ’, ১০-১০) সাভারকরের সেলুলার জেল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মুচলেকাকে ‘কৌশল’ বলেছেন। মুক্ত হয়ে দেশের জন্য কাজ করতে চেয়েছেন, তাই তিনি ব্রিটিশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের অঙ্গীকার করেছিলেন। এই ব্যাখ্যা আজকাল অনেক ‘বিশিষ্ট’ ব্যক্তির মুখে শোনা যায়। কিন্তু ১৯২০ সালে শর্তসাপেক্ষে কারামুক্ত হওয়ার পর সাভারকর দেশের কী মঙ্গলসাধন করেছিলেন, অন্যান্যদের মতো বিদ্যুৎবাবুও স্পষ্ট করতে পারলেন না। তিনি ‘সুকৌশলী চিন্তাবিদ’ সাভারকরের ১৯২০-পরবর্তী এক বিকল্প ভাবাদর্শের উল্লেখ করেছেন, ‘যা পুরোপুরি গাঁধী-বিরোধী রাজনীতি’ নয়। সেটা ঠিক কী, বিদ্যুৎবাবু পরিষ্কার করেননি। শুধু বললেন, সাভারকর ‘‘সাংবিধানিক পদ্ধতির মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নিয়ে যেতে চান।’’ কী সেই পদ্ধতি, জানা গেল না।
অতঃপর তিনি ঘোষণা করলেন, সাভারকর প্রথম ভারতীয় চিন্তাবিদ হিসেবে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য হিন্দু-মুসলমানকে এক ছাতার তলায় আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ১৮৫৭ সালকে সাভারকর এক ‘ধর্মযুদ্ধ’ হিসেবে দেখেছিলেন। ইংরেজ খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে ভারতীয় হিন্দু-মুসলিমের সম্মিলিত লড়াই। হিন্দু-মুসলিমকে এক ছাতার নীচে আনার একটা নমুনা পেশ করা যাক। ১৮৯৪-৯৫ সালে, মাত্র ১২ বছরের এক স্কুলছাত্র হিসেবে সাভারকর তাঁর সহপাঠীদের সঙ্গে একটি মসজিদ আক্রমণ করেন। এর বিবরণ দিতে গিয়ে পরে তিনি লিখলেন, ‘‘আমরা ইচ্ছেমতো মসজিদ ভাঙচুর করে আমাদের সাহসের নিশান উড়িয়ে দিই। আমরা পুরোপুরি শিবাজির যুদ্ধকৌশল অনুসরণ করে, আমাদের কাজ শেষ হলেই ঘটনাস্থল থেকে ছুটে পালাই।’’ (হিন্দুত্ব: এক্সপ্লোরিং দি আইডিয়া অব হিন্দু ন্যাশনালিজ়ম, জ্যোতির্ময় শর্মা, পৃ ১২৮)। এ কেবল হিমশৈলের চূড়ামাত্র। অ-হিন্দুদের সাভারকর কোন চোখে দেখেছেন, তা জানতে গেলে পড়তে হবে এসেনশিয়ালস অব হিন্দুত্ব (১৯২৩), যা পরে হিন্দুত্ব: হু ইজ় আ হিন্দু (১৯২৮) নামে প্রকাশিত হয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সচেষ্ট গাঁধী প্রাণ দিয়েছিলেন সাভারকরের ভাবশিষ্য গডসের গুলিতে। এর পরেও সাভারকরের এক ছাতার নীচে হিন্দু-মুসলিমকে আনার তত্ত্ব, বা তাঁর নীতি পুরোপুরি ‘গাঁধীবিরোধী নয়’ বলে তাঁকে গাঁধীর কাছাকাছি আনার চেষ্টা কেবল অনৈতিহাসিকই নয়, তা ইতিহাস বদহজমের শামিল।
স্বস্তিক মল্লিক, উত্তরপাড়া, হুগলি
‘পুণ্যভূ’
সাভারকরের দি ইন্ডিয়ান ওয়ার অব ইন্ডিপেন্ডেন্স নিয়ে বিদ্যুৎবাবু বিশদ ব্যাখ্যা করলেন, কিন্তু তাঁর পরবর্তী রচনা এসেনশিয়ালস অব হিন্দুত্ব সম্পর্কে নীরব রইলেন। এটা একটু আশ্চর্যের, বিশেষত বর্তমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে যখন হিন্দুত্বের ধারণা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ কথা ঠিক যে, প্রথম বইটিতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের প্রশংসা সাভারকর করেছিলেন। কিন্তু ১৯২১-২২, যে সময়ে তিনি হিন্দুত্ব রচনা করেন, তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাসের আমূল পরিবর্তন ঘটে। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৬৬ সালে, তাঁর মৃত্যুর কিছু আগে রচিত সিক্স গ্লোরিয়াস ইপকস অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি থেকে। বইটিতে তিনি ছত্রপতি শিবাজি আর চিমাজি আপ্পাকে ধিক্কার জানাচ্ছেন। কারণ তাঁরা, যথাক্রমে, কল্যাণের মুসলমান রাজ্যপাল আর বাসেইনের পর্তুগিজ রাজ্যপ্রধানের স্ত্রীদের হাতে পেয়েও ধর্ষণ না করে রেহাই দিয়েছেন।
এসেনশিয়ালস অব হিন্দুত্ব বইটি একটি বিচিত্র ধর্মীয়-রাজনৈতিক ইস্তাহার। সাভারকর দাবি করছেন, যেহেতু বিদেশিরা হিমালয় থেকে মহাসাগর, এই সমগ্র অঞ্চলের বাসিন্দাদের সিন্ধু, বা অপভ্রংশে ‘হিন্দু’ বলেই জানে, সেহেতু এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল ‘হিন্দুদেশ’ বলেই চিহ্নিত করা উচিত। ‘হিন্দু’ সেই জাতি বা সম্প্রদায়, যাঁরা এই হিন্দুদেশকে ‘পিতৃভূ’ আর ‘পুণ্যভূ’ মনে করেন। ‘মাতৃভূমি’ নয়, ‘পিতৃভূ’। ‘ভূমি’ না বলে ‘ভূ’ বলছেন, অর্থাৎ পুংলিঙ্গ। নাৎসিদের ‘ফাদারল্যান্ড’-এর সঙ্গে মিলটা ধরিয়ে দিতে হয় না।
এ দেশ কাদের পুণ্যভূ? যাঁদের তীর্থস্থান ভারতে অবস্থিত। এই অদ্ভুত সংজ্ঞার হেতু? ‘বিদেশি’ বলে বিশেষ কোনও সম্প্রদায়কে চিহ্নিত করা। মুসলমানদের নাগরিকত্বের ওপর কোনও দাবি নেই, কারণ তাঁদের মহাতীর্থ মক্কা, মদিনা। এই বিচারে ইহুদি বা খ্রিস্টানদেরও নাগরিকত্বের দাবি থাকা উচিত নয়। ‘পুণ্যভূ’র মধ্যেই নাগরিকপঞ্জির যুক্তি নিহিত।
শুভ্রনীল দত্ত, মাসুন্দি, পূর্ব বর্ধমান
অনৈতিহাসিক
বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর লেখা থেকে বোঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ আগামী দিনে সাভারকরকে তিনটি পর্যায়ে তুলে ধরবে। প্রথম পর্যায়, তারা সাভারকরকে জাতীয় আন্দোলনের তাত্ত্বিক ভিত্তির নির্মাতা বলে দেখাতে চাইবে। প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের (১৮৫৭) ভিতর দিয়ে জাতীয়তাবাদের আদর্শগত ভিত্তি যে সাভারকরই প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এই অনৈতিহাসিক উপস্থাপনা চায় আরএসএস।
দ্বিতীয় পর্যায়, আন্দামানের জেলে বন্দিদশার সময়ে একাধিক ক্ষমাপ্রার্থনার চিঠিতে স্বাধীনতা আন্দোলনকে কার্যত পিছন থেকে ছুরি মারার যে অঙ্গীকার সাভারকর করেছিলেন, তা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটা ‘কৌশল’ ছিল— এমন আজগুবি তত্ত্বের অবতারণা করতে চায়। তৃতীয় পর্যায়, মহাত্মা গাঁধীকে হত্যার সঙ্গে সাভারকরের সম্পর্ক, যা হিন্দুত্ববাদীরা চিরকালই অস্বীকার করে, তার প্রতিষ্ঠা। আইনের মারপ্যাঁচে গাঁধীহত্যার দায়ে অভিযুক্ত হননি সাভারকর। তা বলে গাঁধীহত্যার ষড়যন্ত্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল না, এটা অবিশ্বাস্য।
গৌতম রায়, ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
ঐক্য চাননি
ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যে ধর্মভিত্তিক পৃথক দেশের ধারণা প্রথম এনেছিলেন হিন্দু মহাসভার নেতা ভি ডি সাভারকরই। হিন্দুত্ব (১৯২৩) গ্রন্থে সাভারকর ভারতে হিন্দু এবং মুসলিম দু’টি পৃথক জাতি বলে তত্ত্ব পেশ করেন। মুসলিম লিগের প্রতিষ্ঠা ১৯০৬ সালে হলেও ৩৪ বছর পর, ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহৌরে লিগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে তারা পৃথক দেশের দাবি প্রথম তোলে। ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক পথে ভারত বিভাগের ধারণাটির উদ্ভাবনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী হল হিন্দু মহাসভা।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘মুসলিম লিগ সাভারকরের এই তত্ত্বকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করেছিল।’’
হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়ের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এক জাতি হিসেবে গড়ে ওঠাকে আরএসএস অস্বীকার করে এসেছে। সাভারকররা হিন্দুত্বই জাতীয়ত্ব বলে নির্ধারণ করেন, এবং ব্রিটিশের পরিবর্তে মুসলমানরাই তাদের প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়ে যায়। আরএসএসের তাত্ত্বিক নেতা গোলওয়ালকরের বক্তব্য, ‘‘ব্রিটিশ বিরোধিতাকে ভাবা হচ্ছে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের সমার্থক। এই প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সমগ্র স্বাধীনতা আন্দোলন, তার নেতৃবর্গ ও সাধারণ মানুষের উপর ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলেছিল’’ (চিন্তাচয়ন, প্রথম খণ্ড, পৃ ১২৫)। বিবেকানন্দ এর সম্পূর্ণ বিপরীত মত প্রকাশ করে বলেছেন, ‘‘কোনও সভ্যতা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে গড়িয়া উঠিয়াছে, এরূপ দৃষ্টান্ত একটিও পাওয়া যায় না। একটি সুসভ্য জাতি আসিয়া কোনও জাতির সহিত মিশিয়া যাওয়া ছাড়াই যে জাতি সভ্য হইয়া উঠিয়াছে– এরূপ একটি জাতিও জগতে নাই।’’ (রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, পৃ ৩৪২)। হিন্দুত্ববাদীদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের চিন্তা ভারতে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের মারাত্মক ক্ষতি করেছে, এবং আজও একই রকম ভাবে করে চলেছে।
সমুদ্র গুপ্ত, কলকাতা-৬
চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা
সম্পাদক সমীপেষু,
৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা-৭০০০০১।
ইমেল: letters@abp.in
যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।