‘কাজ করে চলার স্বধর্ম’ (১-৫) প্রবন্ধে রোচনা মজুমদার উল্লেখ করেছেন চিদানন্দ দাশগুপ্তের উক্তি, “যে কলকাতায় ট্রাম জ্বলে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, উদ্বাস্তুরা ভিড় করেন; বেকারত্ব, মূল্যবৃদ্ধি বা খাদ্যসঙ্কটের মতো সমস্যা যে শহরের প্রাত্যহিক বাস্তব— সত্যজিতের ছবিতে সেই কলকাতার অস্তিত্ব নেই। যদিও তিনি এই শহরেই থাকেন, কিন্তু গত দশ বছরে যে বিপন্নতার মহাকাব্য এই শহরের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে, তার সঙ্গে তাঁর কোনও যোগাযোগই নেই।” চিদানন্দবাবুর মতো প্রাজ্ঞ চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এ জাতীয় মন্তব্য অপ্রত্যাশিত। ‘বিপন্নতার মহাকাব্য’ বাধ্যতামূলক ভাবে কোনও চলচ্চিত্রকারকে রূপায়িত করতে হবে তাঁর সৃষ্টিতে, এ ধারণার মূলে কী ভিত্তি আছে জানা নেই। তা হলে তো বলতে হয় ১৯৯৯-২০০০ সাল নাগাদ যাঁরা ছবি তৈরি করেছেন, কার্গিল যুদ্ধকে তাঁদের ছবির বিষয়বস্তু হিসেবে গ্রহণ করা উচিত ছিল, যে হেতু ওটাই তখন দেশের সর্বাধিক বিপন্নতা তৈরি করেছিল। একই রকম ভাবে গোধরা গণহত্যা কাণ্ডের পরে প্রত্যেক চলচ্চিত্রকারের একটা করে ‘গোধরা-ফিল্ম’ বানানো অবশ্য-প্রয়োজন ছিল। যেমন, এখন যদি কেউ ফিল্ম তৈরি করেন, তাঁকে একটা ‘কোভিড-ফিল্ম’ নামাতেই হবে।
সত্যজিৎবাবু বাঙালি, কলকাতাবাসী, তাই তাঁর কর্তব্য কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গের সমস্যাবলি নিয়ে ছবি তৈরি করা— এ রকম একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হয়তো করেছেন চিদানন্দবাবু। কিন্তু এ-কথা কি খুব যুক্তিযুক্ত? আমরা সবাই তো জানি, শিল্পীর কোনও জাত হয় না। সে ক্ষেত্রে এ রকম মন্তব্য তো এক প্রকার প্রাদেশিক মানসিকতার পরিচয়বাহী হয়ে গেল।
সুগত ত্রিপাঠী
মুগবেড়িয়া, পূর্ব মেদিনীপুর
দেখার শিল্প
সত্যজিৎ রায়ের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে শিলাদিত্য সেনের ‘দর্শককেও তৈরি হয়ে উঠতে হয়’ (১-৫) শীর্ষক নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। লেখক সংক্ষিপ্ত পরিসরে জরুরি কিছু প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। তিনি যথার্থই বলেছেন, সত্যজিৎ প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যিনি দর্শককে সিনেমার শিল্পরূপ চিনিয়েছিলেন, এবং সিনেমার মধ্যে দিয়ে নিজের দেশকে, দেশের মানুষকে নতুন করে খুঁজতে শিখিয়েছিলেন। সত্যজিতের ফিল্ম-বিষয়ক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করে মনে করিয়ে দিতে চেয়েছেন তাঁর ছবির সঙ্গে পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের গঠনশৈলীর মিল কোথায় ও কতখানি “... পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের স্থাপত্য (তার নাটকীয়তা বা সময়ের প্রতি দায়বদ্ধতা) কী ভাবে সিনেমার সংগঠনের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে যায়, দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। সিনেমার সাঙ্গীতিক কাঠামোর এই জটিল সমগ্রতা যদি কোনও ছবি-করিয়ে অনুভব করতে না পারেন, তার পক্ষে শিল্পসৃষ্টি অসম্ভব।” সত্যজিৎ রায়ের ছবি সম্পর্কে শঙ্খ ঘোষের কিছু মোক্ষম পর্যবেক্ষণের ব্যবহার করে লেখক মনে করিয়ে দিয়েছেন, পথের পাঁচালী মুক্তির এত বছর পরে আজও আমরা কী ভাবে আটকে রয়েছি ফিল্ম বিষয়টিকে গ্রহণ করার কিছু পুরনো অভ্যাসে, কাটিয়ে উঠতে পারিনি দৃষ্টিশক্তিহীন গল্প-নির্ভরতার মন। সত্যিই তো, সিনেমা কেন সাহিত্যের প্রকাশভঙ্গির বশ্যতা স্বীকার করবে, সে তো চাইবেই তার নিজের ভাষায় কথা বলতে, আর সেটা যে হেতু ‘ভিসুয়াল আর্ট’, তাই তার জন্য প্রস্তুত করতে হবে এক নিজস্ব ‘ইডিয়ম’। নিছক ঘটনা, সংলাপের বহুলতা থেকে বেরিয়ে এসে নির্ভরতা স্থাপন করতে হবে এক স্বতন্ত্র চিত্রভাষার উপর। পঞ্চাশের দশকে সত্যজিৎ তাঁর পথের পাঁচালী বা অপরাজিত পর্বে সেই তাগিদ থেকেই তৈরি করেছিলেন চোখ-নির্ভর বলার এক নিজস্ব ভঙ্গি, যেখানে সিনেমা হয়ে উঠছে প্রায় একটি দেখার শিল্প। সিনেমা দেখা শেষে মনে হওয়া প্রায় অবশ্যম্ভাবী যে, আমরা চোখ থাকতেও ঠিকমতো দেখি না। তিনি নিজে যে হেতু ছিলেন এক প্রশিক্ষিত চিত্রশিল্পী, তাই ছোট ছোট দেখা, পুঙ্খানুপুঙ্খ ডিটেলিং-এর দিকে প্রগাঢ় মনোযোগ, দৃশ্য-শব্দ-নিঃশব্দের পারম্পরিকতায় তৈরি কিছু অসামান্য মুহূর্ত নির্মাণের মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমাকে উপহার দিয়েছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা এক কথনভঙ্গি। কিন্তু তার পর থেকে সেই ধারাটি বাংলা ছবিতে আর রইল কোথায়? যে হেতু নিজের পুনরাবৃত্তি করতে চাননি, তাই হয়তো পরবর্তী অনেক ছবিতে এনেছেন অপরাপর নানা ভঙ্গিমা। কিন্তু কোথায় গেল পথের পাঁচালী বা অপরাজিত পর্বের সেই বিশুদ্ধ দেখার আনন্দ, দু’চোখ মেলে চেয়ে থাকার মুগ্ধতা, দর্শনসুখ। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের ছবিতে কি মরে গেল সেই প্রবণতা, যোগ্য ছবি-করিয়ের অভাবে নষ্ট হয়ে গেল, নাকি চাহিদার কাছে হার মেনে জয় হল সেই গল্প-নির্ভরতা, সংলাপের বহুল ব্যবহারধর্মী চলচ্চিত্রের?
তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়
কৃষ্ণনগর, নদিয়া
টক-মিষ্টি
শৈবাল বসুর নিবন্ধ (‘শুধু হিন্দু বাঙালির রান্নাঘর নয়’, ৫-৫) পড়ে নির্ভেজাল আনন্দ পেলাম। গ্রামবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের রান্নার স্বাদ আলাদা আলাদা, তেমনই সুস্বাদু সে সব রান্না। লেখক ঠিকই বলেছেন, হিন্দু বাড়ির রান্না এক ধরনের, মুসলিম পরিবারের রান্নার আর এক ধরন। আবার আদিবাসী পরিবারের রান্নাও মনকাড়া। একই পদ নানা জেলায় নানা ভাবে তৈরি হয়। যেমন— বাঁকুড়া-পুরুলিয়া জেলাতে ‘টক’ হয়, তাতে কিন্তু একটুও চিনি দেওয়া হয় না। কুমড়ো, মুলো, তেঁতুল দিয়ে তৈরি হয় টক, আবার কাঁচা মাছের টক হয়। কিন্তু বর্ধমান জেলার ‘টক’ বলতে বোঝায় চাটনি, যাতে চিনি থাকবেই। বাঙালি বাড়ির সুগৃহিণী পড়ে-থাকা বেগুন, কুমড়োর টুকরো, একটু পুঁই শাক দিয়ে যে ‘চচ্চড়ি’ নামক উপাদেয় বস্তুটি বানান, তা যে কোনও পাঁচতারা হোটেলের রান্নাকে পরাস্ত করবে। কিসের সঙ্গে কোন খাবার জমে ভাল, সেই গুপ্তমন্ত্র বাঙালি মেয়েরা পেয়েছে মা-ঠাকুমার থেকে! বাংলাদেশের মানুষ ঝাল খেতে ভালবাসেন, আবার ঘটিরা সব কিছুতেই একটু মিষ্টি পছন্দ করেন।
আর খাবারের মেলামেশা তো কবেই হয়ে গিয়েছে। যেমন— বিরিয়ানি খেতে কে না ভালবাসে, কিন্তু এটি মোগলাই খানা। এই প্রসঙ্গে রবি ঠাকুরের মজার দু’টি লাইন মনে পড়ছে, “যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া, এস দাড়ি নাড়ি কলিমদ্দি মিঞা।” এই এমন একটা ক্ষেত্র, যেখানে সব ধর্মের একটু একটু মেলামেশা সংঘটিত হয়েছে। সর্বোপরি, বাঙালি মহিলারা মনে করেন, রান্না শুধু উদরপূর্তির জন্য নয়, এ একটি শিল্প।
সর্বানী গুপ্ত
বড়জোড়া, বাঁকুড়া
রক্তের অভাব
রাজ্যের প্রায় সমস্ত ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের দুর্ভিক্ষ চলছে। বিপাকে পড়েছেন অস্ত্রোপচারের রোগী, ক্যানসার ও থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তরা। এই অভাব প্রতি গ্রীষ্মে হয়। মাসাধিক কালব্যাপী নির্বাচন ও করোনা পরিস্থিতি তাকে আরও তীব্র করেছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের হ্যাটট্রিক উদ্যাপন করতে বিজয় উৎসব হোক রক্তের ভাঁড়ার পূর্ণ করার অঙ্গীকারে। প্রতি বিধানসভা ক্ষেত্রে এক হাজার ইউনিট রক্ত সংগ্রহ শক্ত নয়, দরকার ঐকান্তিক ইচ্ছার।
স্বপন কুমার মণ্ডল
সোনাখালি, পশ্চিম মেদিনীপুর
মরণফাঁদ
নির্বাচন উপলক্ষে শহর ও গ্রামের রাস্তায় দলীয় ফ্লেক্স, ফেস্টুন, হোর্ডিং, ব্যানার যেন মরণফাঁদ। কালবৈশাখীর তাণ্ডবে বিজ্ঞাপনগুলো উড়ে গিয়ে যেমন বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটাতে পারে, তেমনই নিকাশি নালাগুলোর মুখ আটকে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গির জীবাণুবাহী মশার জন্মের অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারে। তাই প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলকে বিজ্ঞাপন সরাতে হবে, দেওয়াল লিখন মুছে ফেলতে হবে। নইলে করোনা অতিমারির পরে নতুন কোনও বিপদ হয়তো রাজ্যবাসীর কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে যাবে।
বিশ্বরূপ দাস
শ্রীপল্লি, পূর্ব বর্ধমান