Teaching

সম্পাদক সমীপেষু: পড়ানোর অধিকার

শিক্ষার অধিকার আইনে উল্লিখিত আছে যে, কোনও সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলের শিক্ষক গৃহশিক্ষকতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারবেন না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২২ ০৪:৪৫
Share:

শিক্ষার অধিকার আইনের ২৮ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত আছে যে, কোনও সরকারি বা সরকার-পোষিত স্কুলের শিক্ষক গৃহশিক্ষকতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রাখতে পারবেন না। এই প্রসঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলার বিদ্যালয় পরিদর্শক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের উদ্দেশে নির্দেশিকা জারি করেছেন। বেকার যুবকদের তৈরি বিভিন্ন গৃহশিক্ষকদের সংগঠনও স্কুলশিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন বন্ধ করার জন্য যথেষ্ট তৎপর হয়ে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকের অফিসে ডেপুটেশন দিয়েছে এবং আদালত পর্যন্ত কোনও কোনও ক্ষেত্রে বিষয়টি গড়িয়েছে।

Advertisement

সত্যিই কি শিক্ষার অধিকার আইনে এ ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের অধিকার সুরক্ষিত হল? এক জন ব্যাঙ্ক কর্মচারী, এলআইসি কর্মী, গৃহশিক্ষকতা করতে পারবেন, কিন্তু শিক্ষক পড়াতে পারবেন না? বিচিত্র এই নিয়ম। কোনও পড়ুয়া যদি মনে করে, স্কুলের সময়ের বাইরে সে কোনও শিক্ষকের কাছে আলাদা ভাবে পড়বে, সেটা সে করতে পারবে না? তাকে কোনও শিক্ষিত বেকার যুবক বা যুবতীর কাছেই যেতে হবে পাঠ নেওয়ার জন্য? একই রকম ভাবে কেউ অসুস্থ হলে তিনি উপযুক্ত ফি দিয়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার দেখাতে পারবেন না? সেই রোগীকেও কি যেতে হবে কোনও শিক্ষিত যুবকের কাছে, যে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়ে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পায়নি?

সাধারণ ভাবে দেখা যায়, একটা স্কুলের শিক্ষক সংখ্যার খুব কম জনই প্রাইভেট টিউশনের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁরা গ্রামের স্কুলে শিক্ষকতা করেন, কিন্তু থাকেন শহরে। সেখানকার ছেলেমেয়েদেরই পড়ান। ফলে তাঁদের কোনও সুযোগই নেই যে, প্র্যাক্টিক্যাল বা প্রজেক্টের নম্বর কম দেওয়ার ভয় দেখিয়ে নিজের কাছে পড়তে আসতে বাধ্য করবেন। আবার অনেক বাংলা মাধ্যম স্কুলের শিক্ষক ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের পড়ান, সেখানেও পড়ানোর উৎকর্ষই হয় মূল বিচার্য। এই উৎকর্ষই হওয়া উচিত এক জন শিক্ষকের মানদণ্ড, তা তিনি সরকারি স্কুলের শিক্ষকই হোন, বা শিক্ষিত বেকার যুবক। স্কুলের সময়ে কোনও শিক্ষক যদি সঠিক ভাবে শিক্ষাদান না করেন বা প্রাইভেট টিউশন নিতে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহিত করেন, তা হলে সেটি অবশ্যই শাস্তিযোগ্য হওয়া উচিত। কিন্তু স্কুলের সময়ের বাইরে এক জন শিক্ষকের যেমন পড়ানোর অধিকার থাকা উচিত, তেমনই শিক্ষার্থীরও তার শিক্ষক বাছাই করার অধিকার থাকা উচিত।

Advertisement

শীর্ষেন্দু দত্ত, সুভাষপল্লি, পূর্ব বর্ধমান

শিক্ষার ব্যবসা

‘সমস্যার মূল’ (৮-৭) শীর্ষক সম্পাদকীয়টিতে যথার্থই বলা হয়েছে যে, স্কুলে ঠিকমতো তথা সুষ্ঠু ভাবে পড়াশোনা হলে গৃহশিক্ষকতা এবং কোচিং-সর্বস্বতার প্রাবল্য কমবে।

অনস্বীকার্য যে, অতিরিক্ত কিছু সুবিধা পাওয়ার আশায় অভিভাবকগণ সাধারণত গৃহশিক্ষক হিসেবে স্কুলের শিক্ষকের শরণাপন্ন হন! এই ধরনের প্রবণতাকে আঁকড়ে এক শ্রেণির স্কুলশিক্ষক গৃহশিক্ষকতাকে একেবারে রমরমে ব্যবসায় পরিণত করেছেন! ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই শুরু হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের নিয়ে তৈরি ব্যাচ পদ্ধতিতে আয়করবিহীন টিউশন। সকাল থেকে পড়ানোয় ক্লান্ত হয়ে স্কুলে গিয়ে গুরুমশাইরা সে ভাবে আর তৎপর হতে পারেন না!

আরও একটি ব্যাপার হল, গৃহশিক্ষক হিসেবে স্কুলের শিক্ষকগণকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে অনেক যোগ্য বেকার শিক্ষিত যুবক/যুবতী বঞ্চিত হন। তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিক্ষা দফতরের এই নির্দেশিকা কঠোর ভাবে তথা সততার সঙ্গে পালন করা হলেই ভাল!

বিশ্বজিৎ কর, গড়িয়া, কলকাতা

নজরদারি চাই

‘সমস্যার মূল’ সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। রাজ্য সরকারের শিক্ষা দফতর সরকারি, সরকার-পোষিত বা সরকারি-সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ করার যে নির্দেশিকা ঘোষণা করেছে, তা নতুন নয়। এর আগেও অনেক দফায় এই নির্দেশিকা জারি হয়েছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। সমস্যাটা ঠিক কোথায়? আমরা কেউ কি কখনও ভেবে দেখেছি, কেন গৃহশিক্ষকতা এত রমরমিয়ে চলছে? স্কুলে কি শিক্ষকরা ঠিকঠাক শিক্ষাদান করছেন না, না কি আরও অর্থ উপার্জনের তাগিদ অনুভব করছেন বলে শ্রেণিকক্ষে নামমাত্র পড়াচ্ছেন। পরিসংখ্যান বলছে, দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে গৃহশিক্ষকতার হার সবচেয়ে বেশি। আমি এক জন বেকার গৃহশিক্ষক। অথচ, আমার কাছে ছাত্রছাত্রীরা ভিড় করে না কারণ আমি স্কুলশিক্ষক নই। যারা আসে, তাদের অধিকাংশই আলোচনা করে, স্কুলের শিক্ষকের কাছে না পড়লে তিনি রাগ করে নম্বর কমিয়ে দেবেন।

তাই আমার মতে, শুধু এই নির্দেশিকা জারি করেই সমস্যার সমাধান হতে পারে না। তার জন্য চাই সরকারের পক্ষ থেকে আরও কঠোর সতর্কতা। প্রতিটি ক্লাসে পড়ানোর মান যাচাই করতে হবে, প্রত্যেক শিক্ষার্থী সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে। সমস্যার গভীরে গিয়ে স্ব-সৃষ্ট এই সমস্যার সমাধান করতে হবে। এবং বাইরের কোনও গৃহশিক্ষকের কাছে পড়লে যেন তার উপর অবিচার করা না হয়, সে দিকে লক্ষ রাখতে হবে কঠোর ভাবে। এর ফলে শিক্ষাদান এবং গ্রহণ— দুই-ই হবে যথাযথ। অতিমারিতে যে ভাবে শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অনলাইনে ক্লাস করে যে ভাবে শিক্ষক-সংস্পর্শ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, এখন বিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতিকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় করে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরলে সম্ভবত গৃহশিক্ষকতা কমবে। কিন্তু এর জন্য শিক্ষকদেরও কিছু স্বার্থ ত্যাগ করা প্রয়োজন। তাঁদের মনে রাখা উচিত যে, তাঁরা দেশের ভবিষ্যৎ গড়ছেন। বিদ্যালয়ে পাঠদান ছাড়া গৃহশিক্ষকতা তাঁদের পক্ষে অনুচিত।

কুহু দাস, দশগ্রাম, পশ্চিম মেদিনীপুর

বোধোদয় হবে?

শিশুদের অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদান সম্পর্কিত ‘শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯’-এর ২৮ নম্বর ধারাকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, এক শ্রেণির স্কুলশিক্ষক বছরের পর বছর চুটিয়ে গৃহশিক্ষকতা চালিয়ে গিয়েছেন। বিষয়টিতে শিক্ষকদের দায় অনস্বীকার্য। তবে এ বিষয়ে অভিভাবকদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই, সে কথা ভাবলে কিন্তু ভুল হবে। একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। করোনাকালে স্কুল বন্ধের দীর্ঘ বিরতিতে, এমনকি লকডাউন পর্বেও, আমার নিকট আত্মীয়ের নবম শ্রেণিতে পাঠরত ছেলেকে বাড়িতে এসে শিক্ষাদান করার জন্য বিষয়ভিত্তিক একাধিক গৃহশিক্ষক নিযুক্ত ছিলেন। যাঁদের মধ্যে চার জন ছিলেন স্কুলশিক্ষক। সাধারণ ভাবে গৃহশিক্ষকতার পেশায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের তুলনায় ওই স্কুলশিক্ষকদের মাসিক দক্ষিণার পরিমাণও ছিল উল্লেখযোগ্য ভাবে বেশি।

সেই আত্মীয়ের বক্তব্য অনুযায়ী, গৃহশিক্ষকতার বিষয়ে স্কুলশিক্ষকেরা নাকি অন্যদের থেকে বেশি দায়িত্বশীল, অভিজ্ঞ এবং পারদর্শী। এই মতামতকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যতিক্রম বলে ভাবলে ভুল হবে। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, পশ্চিমবঙ্গ স্কুল শিক্ষা অধিদফতর গত ২৭ জুন স্কুলশিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। প্রয়োজনে ‘শিক্ষার অধিকার আইন ২০০৯’ অনুসরণ করে বিদ্যালয়ের প্রধানদের এ বিষয়ে আইনানুগ পদক্ষেপ করতেও বলা হয়েছে।

অতএব, অতিরিক্ত আয়ের হাতছানি উপেক্ষা করে গৃহশিক্ষকতায় অভ্যস্ত স্কুলশিক্ষকরা নিশ্চয়ই এ বিষয় থেকে বিরত থাকবেন। অভিভাবক মহলও স্কুলশিক্ষকদের দিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর বিষয়ে মোহমুক্ত হয়ে বিকল্প পথ বেছে নেবেন। উভয় পক্ষের সেই বোধোদয়ের আশায় রইলাম।

অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement