অপরাজিতা দাশগুপ্তের ‘এখনও রাতের স্বপ্নে হানা দাও তুমি’ (রবিবাসরীয়, ৮-১১) নিবন্ধে কিছু সংযোজন করতে চাই। গাঁধীজির সঙ্গে সরলা দেবী চৌধুরাণীর প্রথম পরিচয়ের কথা জানা যায় সরলা দেবী চৌধুরাণীর আত্মজীবনী জীবনের ঝরাপাতা গ্রন্থে। কংগ্রেসের অক্লান্ত কর্মী, জেনারেল সেক্রেটারির কন্যা হিসেবেই সরলাকে গাঁধীজির প্রথম দেখা। আর সরলা তখন ভারতী পত্রিকার সম্পাদক। সেই ‘মৃগয়াপরায়ণ’ চোখে গাঁধীকে দেখেছিলেন। মনে করেছিলেন, “ইনি ভারতীয়দের হয়ে বিদেশে কাজ করায় নামকরা একটি সিংহ হয়েছেন, এঁর কাছ থেকে একটা লেখা আদায় করতে পারলে বেশ হয়।”
রাজমোহন গাঁধী তাঁর মোহনদাস: আ ট্রু স্টোরি অব আ ম্যান, হিজ় পিপল অ্যান্ড অ্যান এম্পায়ার বইতে লিখেছেন, ১৯১৯ সালের ২৪ অক্টোবর গাঁধীজি লাহৌরে যান। সরলা দেবীর স্বামী রামভুজ দত্তচৌধুরী, যিনি নিজেও এক জন স্বাধীনতা সংগ্রামী, তখন জেলে। তাঁর বাড়িতেই আশ্রয় নেন, এবং নতুন করে সরলা দেবীর সঙ্গে গাঁধীজির সম্পর্কের শুরু। গাঁধী তখন ৪৭, সরলা ২৯। সে সময়ে লেখা একটি চিঠিতে গাঁধী বলেন, “সরলাদেবীর সান্নিধ্যে আমি আপ্লুত। উনি আমার দারুণ সেবা করেছেন।” এর পরের কিছু মাস নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে সম্পর্ক। গাঁধী একটি চিঠিতে এই ‘স্পিরিচুয়াল ম্যারেজ’-এর ব্যাখ্যা দিয়ে লিখেছেন, “আমাদের দু’জনের বন্ধন এমন একটা বন্ধন যা কোনও যৌন এবং শারীরিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে। এটা সম্ভবত দুই ব্রহ্মচারীর মধ্যেই হতে পারে যাদের ভাবনা, চিন্তা, লেখাপত্র সব কিছুই একে অপরের সঙ্গে মিলে যায়।”
মার্টিন গ্রিন তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে বিশদ গবেষণা করেছেন। তাঁর বইতে তিনি লিখেছেন,“একটা অসাধারণ রাজনৈতিক গাঁটবন্ধন দেখতে পাচ্ছিলাম। দু’জনে মিলে নিজেদের সম্পর্কের মতোই এক নতুন ভারত তৈরির ছবি এঁকে ফেলেছিলেন।”
সায়ন তালুকদার
কলকাতা-৯০
আপত্তিকর
‘এখনও রাতের স্বপ্নে হানা দাও তুমি’ পড়ে দুঃখিত ও ব্যথিত হলাম। এই লেখায় ছত্রে ছত্রে জাতির জনক মহাত্মা গাঁধীকে এক জন কামুক এবং নারীসঙ্গলোলুপ মানুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। সরলা দেবী চৌধুরাণীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক ছাড়াও অন্য মহিলাদের প্রতি গাঁধীজির আসক্তি ও কামুকতার বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। তাঁকে আমরা ‘জাতির জনক’ এবং ‘মহাত্মা’ বলে সম্বোধন করি। সেই শ্রদ্ধাপূর্ণ মনোভাব অবমানিত হয়েছে। ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে এমন লেখা প্রকাশ করা অনুচিত।
তপন কুমার রায়
কলকাতা-৭৫
কঠিন সত্য
অপরাজিতা দাশগুপ্তের নিবন্ধে গাঁধীজির আত্মবিশ্লেষণ মেলে। এ বড় কঠিন সত্য, এ সত্য সহ্য করার জন্যও ক্ষমতার দরকার। আমরা ভারতীয়রা যাঁকে আদর্শের আসনে বসাই, তাঁর যে কোনও রকম দুর্বলতা থাকতে পারে, তা মানতে চাই না। এইখানেই গাঁধীজির মাহাত্ম্য যে, তিনি নিজের দুর্বলতা সর্বসমক্ষে স্বীকার করেছেন। নিজের দুর্বলতার জন্য কষ্ট পেয়েছেন, বিরক্ত হয়েছেন, কিন্তু অস্বীকার করেননি। লেখিকাকে অজস্র ধন্যবাদ যে তিনি সাহস করে এই রকম একটি লেখা উপহার দিয়েছেন, সত্যকে আবরণ সরিয়ে বার করে নিয়ে এসেছেন। আমাদের, অর্থাৎ পাঠককুলেরও পরিণত হওয়ার সময় এসেছে। এ এক অন্য গাঁধীজিকে পেলাম, যিনি আমাদের মতো দোষ, ত্রুটি, দুর্বলতায় ভোগেন, আবার উত্তরণের পথও খুঁজে পান।
সর্বানী গুপ্ত
বড়জোড়া, বাঁকুড়া
গাঁধীর বিপরীতে
সংশোধিত ভারতীয় নাগরিকত্ব আইন, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর সেখানে রামমন্দির নির্মাণের মহাযজ্ঞ, হিন্দুত্ব সংস্কৃতির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা, গোহত্যা নিষিদ্ধ করার নামে গণপিটুনি, ‘লাভ জেহাদ’-এর নামে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ— সবই হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রগঠনের পদধ্বনি, যা গাঁধীবাদের সম্পূর্ণ বিপরীত এবং সাভারকর ও গোলওয়ালকরের হিন্দুত্ববাদের নীল নকশার হুবহু প্রয়োগ। গাঁধীজি বলেছেন, বর্ণাশ্রম ধর্মে কোথাও হিন্দু-মুসলিম কিংবা বামুন-দলিত বিয়েতে কোনও বাধা নেই। ব্যক্তির পরিপূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে নির্বাচন করার, কে কাকে ভালবাসবে বা বিয়ে করবে। এই উদার চিন্তাকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে তিনি বলেন, কে কার সঙ্গে বসে খাওয়াদাওয়া করবে, এ নিয়ে কোনও ফতোয়া চলবে না। তাঁর মতে, হিন্দু-মুসলিম, ব্রাহ্মণ-হরিজন পাশাপাশি বসে নিশ্চয়ই খাবে। সারা জীবনই তিনি অস্পৃশ্যতা এবং জাতিভেদের প্রবল বিরোধিতা করেছেন, তা কারও অজানা নয়।
হিন্দ স্বরাজ বইয়ে বাপু বলেছেন, গরুর উপযোগিতা দেবত্বে নয়, গো-পুজোয় নয়। তিলক, মন্ত্র, তীর্থযাত্রার মধ্যেও হিন্দু ধর্ম নেই। বরং হিন্দু ধর্ম হল মনুষ্যত্বের সেবা। তিনি রাখঢাক না করেই বলেছেন, “গরু বাঁচাতে গিয়ে যারা মুসলিম হত্যা করে, তাদের মতো অমানুষ আর কেউ নেই। উন্মত্ত হিন্দু জনতা একটা গরুকে বাঁচায় না। তারা মানুষ মারে এবং তাতে গো-হত্যার প্রবণতা আরও বেড়ে যায়।” তিনি খোলাখুলি বলেছিলেন যে, আইনসভায় গো-হত্যা নিষিদ্ধ করা গো-রক্ষা নয়। গো-মাংসভোজীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কোনও পথ নয়। বরং গো-রক্ষার পথ হল গো-প্রজননের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মানা, গো-চারণভূমির বিস্তার এবং গো-খাদ্যের পর্যাপ্ত উৎপাদন। মহাত্মা গাঁধীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সর্ব ধর্ম সমন্বয়বাদ, জাতীয়তাবাদ, জাতিভেদ বিলোপ এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতার মতবাদ আজ অপরিহার্য।
শামসুল আলম
নেওয়ার্ক, ক্যালিফর্নিয়া
প্রাদেশিক?
শ্রাবণী স্বপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠির (‘সঙ্কীর্ণ’, ৪-১১) প্রতিবাদ করে বলতে চাই, ‘অবাঙালি’ শব্দটি অপরকে তাচ্ছিল্য করতে ব্যবহার করা হয় না। এই পত্রলেখকের জন্ম ও প্রথম জীবন হিন্দি বলয়ে। সেখানে ‘বঙ্গালিয়া’ বলে ব্যঙ্গ করা হত। পশ্চিমবঙ্গ বাংলাকে সর্বত্র আবশ্যক না করে হিন্দি, উর্দুকে সরকারি ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছে। এর পরও ‘অবাঙালি’ শব্দে প্রাদেশিকতা, সঙ্কীর্ণতা আবিষ্কার করা হচ্ছে!
ঠিক যেমন চিনা আগ্রাসনের জন্য তিব্বতি উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থল ভারত, মায়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল বাংলাদেশ, তেমনই দেশভাগের শিকার বাঙালিদের দয়া করে ‘আশ্রয়’ দিয়েছে ভারত— তা-ই কি বলতে চান লেখক? ভারতেরই অংশ ছিল পূর্ববঙ্গ। স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রাণ দিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গের অগণিত মানুষ, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাঘা যতীন, বিনয় বসু, সূর্য সেন, প্রীতিলতা ওয়াদেদ্দার প্রমুখ। যখন সেই স্বাধীনতা এল, তখন ধর্মের ভিত্তিতে ভারত তথা বাংলাকে ভাগ করে হিন্দু বাঙালিদের রাতারাতি স্বদেশেই ‘বিদেশি’তে পরিণত করে দাঙ্গাবাজদের মুখে নিক্ষেপ করা হল! প্রাণ-সম্মান বাঁচাতে পূর্ববঙ্গের বাঙালিরা ভারতীয়ত্বের অধিকারে এই দেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। ভারতের উপর নেহরুর যে অধিকার ছিল, নরেন্দ্র মোদীর যে অধিকার আছে, বাঙালি উদ্বাস্তু ও তাঁদের বংশধরদের একই অধিকার ছিল এবং আছে।
কাজল চট্টোপাধ্যায়
সোদপুর, উত্তর ২৪ পরগনা