ছেলেবেলায় বাবা অফিস থেকে ফিরলে আমার প্রথম প্রশ্নই ছিল, “বাবা, খবরের কাগজ এনেছ?” বাবা কাঁধে ঝোলা ব্যাগ থেকে খবরের কাগজ দিতেই প্রায় হুমড়ি খেয়ে বসে একেবারে পিছনের পাতায় চলে যেতাম। খেলার খবরের পাতায়। আগে ভাল করে ছবিগুলো দেখে তার পর লেখাগুলো পড়তাম। আর যদি ভারত ক্রিকেটে জেতে, তা হলে তো কথাই নেই। কত বার যে কাগজ পড়তাম, তার ইয়ত্তা নেই। এর পরেই চলে আসতাম কমিকসের পৃষ্ঠায়।
মা যখন বলতেন, “কাল কাগজওয়ালা আসবে, সব কাগজ বিক্রি করে দেব। দেখছিস না কাগজগুলো হলুদ হয়ে যাচ্ছে? পরে কিন্তু দাম পাব না,” বলার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হত কাগজ কাটিং যেটুকু বাকি আছে, সেরে ফেলার প্রস্তুতি। খবরের কাগজ থেকে কত যে খেলোয়াড়ের ছবি কেটেছি, বলে শেষ করা যাবে না। সেই সময় খাতা সেলাই করে খবরের কাগজ দিয়ে মলাট দিতাম। তার উপর কপিল দেবের ছবি মারতাম। সেটাও কাগজ কেটেই পাওয়া।
লোকাল আসতেই হয়তো বারুইপুর স্টেশন থেকে লোক ভর্তি গেল। এক জন যদি খবরের কাগজ নিয়ে বসে, অমনি অন্য চার তাসুড়ে বলবে, “দাদা, কাগজ গোটান। তাস খেলতে অসুবিধা হচ্ছে।” কিন্তু ভদ্রলোকটিকে কি কাগজ পড়ানো থেকে সরিয়ে আনা গেল? একেবারেই না। বরং খবরের কাগজ ভাঁজ করে করে ডায়েরির পাতার মতো করে পড়তে লাগলেন।
আমরা লেখাপড়া শেষ করে যখন কাজে যোগ দিলাম, তখন মোবাইলের যুগ শুরু হয়নি। একটা খবরের কাগজের সব ক’টা পৃষ্ঠা ভাগ করে পড়তাম। সোমনাথদা প্রথম পৃষ্ঠা পড়ছে। পড়তে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, “এই হারু ছয়ের পাতা দে।” “কেন? তুমি কাগজ কিনেছ বলে কি তোমার নাকি? কাল থেকে অন্য কম্পার্টমেন্টে উঠো।” “না রে ভাই, আমি কি সে কথা বলেছি?” সবাই মিলে ভাগ করে পড়লে যে কী আনন্দ, তা বলে বোঝানো যাবে না! এখন তো কোনও সম্পাদকীয় লেখা নিয়ে ট্রেনে তর্কাতর্কি তেমন ভাবে হয় না। কিন্তু আমাদের কলেজ জীবন থেকে চাকরির শুরুতে এমন হামেশাই হত। এটা না হলে ভাত হজম হত না।
আমার মা সকালে উঠেই বলেন, “খবরের কাগজ দিয়ে গিয়েছে তো?” ঈশানী দত্ত রায়কে বলতে চাই, আপনারা অনুজ কিংবা অগ্রজ সব স্তরের সাংবাদিকরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, তার মাখনটা পেয়েই আমরা তুষ্ট। সেই স্পর্শের প্রতিস্পর্ধায় আমরা এখনও বলতে পারি, “হ্যাঁ আমি জোর দিয়েই এই কথা বলতে পারি, কারণ আমি কাগজ পড়ে জেনেছি।”
প্রদীপ
বারুইপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা
কোথায় সাহস?
ঈশানী দত্ত রায়ের ‘স্পর্শের প্রতিস্পর্ধা’ (২৮-৩) পড়লাম। দেখলাম, আনন্দবাজার পত্রিকা-র ১০০ বছর পূর্তির বিশেষ ক্রোড়পত্রও। “সত্যকে ছাপার অক্ষরে স্থায়ী ভাবে প্রকাশ করার স্পর্ধা”— নিঃসন্দেহে এই সাহসই সংবাদপত্রের নিরপেক্ষতার ভিতকে স্তম্ভে পরিণত করে তার উপর গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু সংবাদপত্র আজ কতটা নিরপেক্ষ? সেই প্রশ্নই পাঠকদের মুখে মুখে। “আমি বাজি ধরে বলছি কথাটা ঠিক, কাগজে লিখেছে”— না, এখন আর সেই চ্যালেঞ্জ কেউ করে না। ছাপার অক্ষর আর সত্যের সাক্ষ্য নয়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য নানা নীতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। কেউ সরকার পক্ষের বক্তব্যকে বিজ্ঞাপনের লোভে সত্য প্রমাণ করছে, কেউ বা ঠিক উল্টো। এই সংবাদ পড়ে চ্যালেঞ্জ নেওয়া যায়? এতে ‘অখণ্ড আস্থা’ রাখা যায়?
এই মুহূর্তে ভূরি ভূরি সংবাদপত্রের নাম নেওয়া যায়, যেগুলি সম্পূর্ণ পক্ষপাতদুষ্ট, সরকার মুখাপেক্ষী, অথবা সরকার-বিরোধী বলে পরিচিত। সেখানে সত্য কোথায়? সংবাদপত্রের সাহস কোথায়? সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে সেখানে শুধু সুবিধা ভোগ করা।
এতে সমাজমাধ্যমের উপর বিদ্বেষ ছড়িয়ে কী লাভ? সমাজমাধ্যমের সমস্ত সুবিধা উপভোগ করে সংবাদপত্র। সমাজমাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা নিজেদের প্রচার করে, ডিজিটাল ব্যবস্থার মধ্যে নিজের অস্তিত্বের প্রমাণ রেখে, সমাজমাধ্যমকে বিদ্বেষ ছড়ানোর দায়ে দোষী করে সংবাদপত্রের বিকাশ হয়? সমাজমাধ্যমই এখন সংবাদপত্রের দৈন্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে, তাদের পক্ষপাতকে জনসমাজে তুলে ধরেছে। প্রতিযোগিতায় সংবাদপত্র দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে, এই উত্তর সম্পাদকীয় তা-ই প্রমাণ করল। আমরা যারা সমাজমাধ্যম অনুসরণ করি, তারা জানি ‘ফেক’ আর ‘সঠিক’ সংবাদের মূল্যায়ন। সংবাদপত্রের নামের সঙ্গে যখন নির্দিষ্ট দল বা সরকারের বিজ্ঞাপনের লোভ জুড়ে যায়, তখন সে দায় কে নেবে? ১০০ বছরের আনন্দবাজার পত্রিকা সংবাদ জগৎকে কলুষমুক্ত করুক না। সত্যকে ছাপার অক্ষরে স্থায়ী ভাবে প্রকাশ করার সাহস সকল সংবাদপত্রের হোক। সংবাদ হোক নিরপেক্ষ।
দেবাশীষ দত্ত
কলকাতা-৬৩
স্বাধীন কতটা?
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অনালোচিত বিষয় নিয়ে ঈশানী দত্ত রায়ের ‘স্পর্শের প্রতিস্পর্ধা’ প্রসঙ্গে কিছু প্রতিক্রিয়া জানাতে চাই। আজকের অধিকাংশ যুবসমাজই সংবাদপত্র বিমুখ, এমনটাই ধারণা ছিল আমার। সে ভুল ভাঙল, কারণ এক সমীক্ষায় জানা গেল যে, এখনও ৫২% মানুষ এতে আগ্রহী। বিষয়টি আশাব্যঞ্জক, সন্দেহ নেই। কিন্তু সংবাদপত্র সম্বন্ধে আশঙ্কা অন্যত্র। কাগজ কর্তৃপক্ষ বর্তমানে কতখানি স্বাধীনতা ভোগ করেন, সে নিয়ে জনমানসে সন্দেহ তীব্র। কারণ, খবরের কাগজও তো শেষ পর্যন্ত একটি ব্যবসা, এবং ব্যবসা মানেই নানা প্রকারের ভ্রুকুটি ও চাপের সম্ভাবনা বিদ্যমান। সাহস দেখাতে গেলেও ন্যূনতম ভারসাম্য রক্ষা করতেই হয়। শুধু ন্যায্য কথা বলতে গেলে সমূহ বিপদের ঝুঁকি থেকেই যায়। তবুও গণতন্ত্র রক্ষায় ও স্পষ্টবাদিতায় যথেষ্ট সাহসী হওয়া কি এই সময়ে সম্ভব? সংবাদপত্র সমাজের প্রতিবিম্ব হলেও দিগ্দর্শকও বটে। ফলে সামাজিক দায়িত্ব পালনও অতি অবশ্য কর্তব্য।
খবরের কাগজের আকর্ষণ নির্ভরশীল তথ্য, পরিবেশনের গুণ ও সাহিত্য গুণের উপর নির্ভর করে। সংযোজিত হয়েছে চমকপ্রদ গ্রাফিকের গুণও। ফলে টিভি বা অনলাইন নিউজ় পোর্টাল দিয়ে কাজ চললেও, খবরের কাগজের আকর্ষণ অমোঘ। আলোচ্য লেখাটিতে শঙ্খ ঘোষের লিখিত বয়ানের ও অবিন ঠাকুরের ‘ছবি লেখার চেষ্টা’-র উল্লেখ অত্যন্ত সুপ্রযুক্ত।
কল্যাণ সেনগুপ্ত
কলকাতা-৫৪
ঠোঙা
ঈশানী দত্ত রায়ের ‘স্পর্শের প্রতিস্পর্ধা’ নিবন্ধে প্রথম অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ঘটনাটি পড়ে প্রায় আড়াই দশক আগের একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৪-এর জানুয়ারি মাস। তখন আমি রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ে কমার্সের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র। স্থানীয় হিন্দি ও ইংরেজি কাগজে সবে লেখালিখিতে হাতেখড়ি হয়েছে। সুরকার রাহুল দেব বর্মন প্রয়াত হলেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিন-চার পৃষ্ঠায় একটি লেখা তৈরি করে সাইকেল চালিয়ে ছয়-সাত কিলোমিটার দূরে একটি স্থানীয় হিন্দি দৈনিক কাগজের অফিসে গিয়ে সহকারী সম্পাদকের টেবিলে লেখাটি রেখে দিয়ে চলে আসি। তা প্রকাশিতও হয়। মাসখানেক পরে বাজারে গিয়েছি ডিম কিনতে। দোকানদার একটি খবরের কাগজের ঠোঙা বার করে ডিমগুলি ভরতে লাগলেন। যে ঠোঙাতে আমার সেই ‘বিখ্যাত’ রচনা। চুপচাপ দাম মিটিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। ব্যাপারটা
জানাতে বাবা বললেন, “তুই কি নিজেকে বিখ্যাত সাংবাদিক ভেবেছিলি নাকি, যে তোর লেখা লোকে সংগ্রহ করে রাখবে? তোর ভাগ্য ভাল যে, কাগজটা তোর সামনে অন্য কোনও কাজে লাগেনি।” সেই দিন উপলব্ধি করলাম, মূল্যায়ন ঠোঙাতেই সম্ভব।
অভিজিৎ রায়
বারিডিহ, জামশেদপুর