স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস মহাশয় অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছেন বলে কিছু মানুষের সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। কোনও প্রাক্তন বিচারপতি বা প্রশাসককে কেন উপাচার্য পদে বসানো হবে, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলা হচ্ছে শুধু কোনও শিক্ষাবিদই ওই পদের যোগ্য হতে পারেন। সেই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। প্রথম কথা, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সরাসরি ছাত্রদের শিক্ষাদানে নিযুক্ত নন। তিনি শিক্ষা সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার অধিকারী হবেন, সেটি বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাঁর প্রধান দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বিশাল একটি প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করা এবং তার ভিতরের শিক্ষা, পাঠ্যসূচি, সুরক্ষা, শৃঙ্খলা, কর্মচারীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ থেকে দাবি-দাওয়া ইত্যাদি অজস্র বিষয়কে পরিচালনা করা। আচার্য শুধু সব কিছু পর্যালোচনা করেন এবং সফল ছাত্র ও গবেষকদের পুরস্কৃত করেন এবং সমাবর্তনে রাষ্ট্রের তরফে আশীর্বাদ করেন। দৈনন্দিন কাজের পরিচালনা করতে আসেন না। সেই জন্য উপাচার্য পদে শুধুমাত্র শিক্ষাবিদ হতে হবে, এমন কোনও নিয়ম ধার্য করা যায় না।
যাঁরা শিক্ষাজগৎ থেকে এর আগে ওই পদে বসেছিলেন, তাঁরা ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় মানুষ। কিন্তু একটা বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকে পরিচালনা করার শক্তি সর্বদা তাঁরা দেখাননি। তার ফলে ছাত্র থেকে কর্মচারী, সুরক্ষা থেকে টাকাপয়সা তছনছ ইত্যাদি ঝামেলা আর রাজনৈতিক দলাদলিতে তাঁরা নাস্তানাবুদ হয়েছেন। এ বার আসি মাননীয় বিচারপতিদের প্রসঙ্গে। যাঁরা হাই কোর্টের বিচারপতি পদে বসেন, তাঁরা কি দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞ আইন এবং ন্যায়-নীতি বিশেষজ্ঞ নন? তাঁরই তো শাসনব্যবস্থা চালাতে বেশি যোগ্য হওয়ার কথা। আর আজকের পশ্চিমবঙ্গে ক’জন শিক্ষাবিদ আছেন, যাঁরা জ্ঞান-বিজ্ঞান আর রাজনৈতিক নিরপেক্ষতার সঙ্গে সততা নিয়ে মানুষের শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেন? তা ছাড়া বিচারপতিদের উপাচার্য পদে আসীন হওয়া এই বাংলায় নতুন কী করে হল? দেশের অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অতি শ্রদ্ধেয় উপাচার্যদের তালিকা দেখুন।
স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (ছবি) থেকে স্যর গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, চারুচন্দ্র বিশ্বাস (যিনি ছিলেন বিচারপতি, পরে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী), প্রধান বিচারপতি সুরজিৎ লাহিড়ী এবং এলাহাবাদ হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি বিধুভূষণ মালিক প্রমুখ শ্রদ্ধেয় উপাচার্য হিসাবে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির ভিত্তিকে দৃঢ় করে দিয়ে গিয়েছেন। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ভারতের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুধীরঞ্জন দাশ। কেউ কি তাঁকে কম রাবীন্দ্রিক জ্ঞানসম্পন্ন বলতে পারেন?
এ ছাড়া ডক্টর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ডক্টর বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখও উপাচার্য হিসাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। এই ইতিহাস দেখলে প্রধান বিচারপতি শুভ্রকমল মুখোপাধ্যায়কে রবীন্দ্রভারতীর উপাচার্যরূপে দেখে আমাদের আনন্দিত হওয়ার কথা। আশুতোষ মুখোপাধ্যায় একাধারে উপাচার্য এবং প্রধান বিচারপতি উভয় দায়িত্ব সামলেছিলেন। ত্রিগুণা সেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কলকাতার মেয়র এক সঙ্গে ছিলেন।
শক্তিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, মেরিল্যান্ড, আমেরিকা
বীর সৈনিক
সোনালী দত্তের ‘নাম নেই, শুধুই সংখ্যা’ (৪-৮) শীর্ষক প্রবন্ধে ‘নিজেরাই পরাধীন, তবু লড়াই করতে হচ্ছিল অন্য দেশের মানুষের স্বাধীনতার অধিকার রক্ষায়, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে’ লাইনটি পড়ে মনে পড়ল রণাঙ্গনে চন্দননগরের কিছু সৈন্যের কথা। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ তথা ভারতভঙ্গ প্রতিরোধী বাঙালির চিন্তনে-মননে ছিল দেশপ্রেমের অনন্য উত্তরাধিকার। চন্দননগর তখন ফরাসিদের পরাধীন। কিন্তু ব্রিটিশ বিরোধী যুদ্ধের আঁচ এসে লাগল চন্দননগরে। ১৯০৭ সালে ফ্রেজ়ারের রেলগাড়ি বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মুরারিপুকুর বাগানবাড়ির বিপ্লবীরা। চন্দননগরে থেকে বারীন্দ্রকুমার ঘোষের নেতৃত্বে ডাইনামাইট বসিয়ে ফ্রেজ়ার সাহেবকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সঙ্গে ছিলেন প্রফুল্ল চাকী, উল্লাসকর দত্ত, বিভূতিভূষণ সরকার। এই বিপ্লবী প্রচেষ্টা অবশ্য ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯০৮ সালে ফরাসি মেয়রের ঘরে চন্দননগরে তৈরি বোমা ফেলার কেন্দ্রে ছিল চারুচন্দ্র রায়, ভোলানাথ দাস, মতিলাল রায়, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ, বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের পরিকল্পনা। ১৯০৮ সালে কানাইলাল দত্ত ‘পলিটিক্যাল মার্ডার’ করে ফাঁসির দড়ি বরণ করলেন, তিনিও ভারতের স্বাধীনতা-যুদ্ধের তকমা-বিহীন অকুতোভয় বিপ্লবী সৈনিক। এ সব যুদ্ধ বলা যাবে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক হতেই পারে। কিন্তু ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধের এক বৈপ্লবিক অংশ শুরু হয়েছে চন্দননগরের মাটিতে। যখন শুরু হয়েছে, ঠিক তখন ভারতের বাইরে মহাযুদ্ধের রণাঙ্গনেও পাওয়া যাচ্ছে চন্দননগরের সাহসী সৈনিকদের।
১৯০০ শতকের প্রথম থেকেই ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব, ইউরোপে পুঁজিবাদের সঙ্কট তীব্র হয়। দেশকালের আঙ্গিক ও চরিত্র বদলের পরিণতিতে শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তৈরি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর পল্টনে হাবিলদার নজরুল ইসলাম ১৯১৭-১৯২০ সালে যুদ্ধ করেছেন ব্রিটিশের সেনা হিসাবে। ১৯১৬ সালে ফ্রান্সে হয়েছিল ব্যাটল অব ভার্দুন। ফ্রান্স ১৯১৫ সাল থেকে এশিয়া থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে। ঔপনিবেশিক ভারতের পাশে ঔপনিবেশিক ছোট্ট চন্দননগরে এক স্বতন্ত্র চিত্র ছিল।
১৯১০ সালে জুলাই এসএন কোম্পানির জাহাজে কলকাতার উট্রাম ঘাট থেকে চন্দননগরের সচ্ছল কায়স্থ পরিবারের পুত্র যোগীন্দ্রনাথ সেন ইংল্যান্ডের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্য। মহাযুদ্ধের ঘটনাচক্রে তিনি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিলেন। পড়ুয়া মেধাবী যোগীন্দ্রনাথ সৈনিক হবে শুনে চন্দননগরে বাবা-মা আকুল। দাদা যতীন্দ্রনাথের মাধ্যমে মা’কে চিঠিতে লিখলেন, “আপনারা আমাকে মার্জনা করিবেন, আমি বাঙালীর গালে চুনকালি দিতে পারিব না।” ১৯১৫ সালে মাতৃভূমি চন্দননগর তথা ভারত ছেড়ে রাসবিহারী বসু জাপানের উদ্দেশে রওনা দিলেন সশস্ত্র সংগ্রামের উদ্দেশ্যে। রাসবিহারী চন্দননগর ছেড়ে অত্যন্ত গোপনে যাওয়ার খবরটুকুও পাননি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় অনেকেই। তিনি গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি’, যা তুলে দিয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্রের হাতে। রাসবিহারী মারা গেলেন জাপানে। স্বেচ্ছাসৈনিক হারাধন বক্সী ইউরোপের রণাঙ্গন থেকে ফিরে দারুণ এক বই লিখে ফেললেন, লড়ায়ের নতুন কায়দা (১৩৩২ বঙ্গাব্দ, প্রকাশক রামেশ্বর দে, চন্দননগর)।
মহাযুদ্ধ বা দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য ভয় পাননি চন্দননগরের হিন্দু বাঙালি ফরাসি প্রজা। ১৯১৬ সালে ১৬ এপ্রিল ফ্রান্সের রণক্ষেত্রে যান ফণীন্দ্রনাথ বসু, তারাপদ গুপ্ত, রমাপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ মোট আটাশ জন (সংক্ষিপ্ত চন্দননগর পরিচয়, হরিহর শেঠ, পৃ ১৩১-১৩২)। এই স্বেচ্ছাসেবক-বাহিনী গঠনে উৎসাহ দিয়েছিলেন রাজা বা নবাব নয়, চন্দননগরের সচেতন মানুষ মতিলাল বসু, তিনকড়ি বসু, হরিহর শেঠ, মণীন্দ্রনাথ নায়েক প্রমুখ। বিদেশের রণকৌশল শিখে স্বদেশে চন্দননগরে প্রয়োগের সম্ভাবনা ছিল। যদিও তা ঘটেনি।
বর্তমানের স্লোগান— যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই। তাই এই ইতিহাস লিখতে হলে খুব সাবধানে বিশ্বশান্তির দাবি স্বীকার করে সে-কালের বিভিন্ন যুদ্ধের বিবরণ লিখতে হবে।
শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি